‘ত্রেছ এ্যামিগোস ভায়াজিন্তি’। আসলে আনকমন কিছু না। ‘থ্রি ফেন্ডস ট্রাভেলারস’- এইটাকে পর্তুগিজ ভাষায় গুগল তরজমা করেছে। আমি, আমান আর মুকুল- এই তিন বন্ধু একসঙ্গে দেশের বহু এবং বিদেশের কিছু জায়গা সফর করেছি। তিনজনের দলের একটা নাম দরকার। গুগল আমাকে সাহায্য করেছে। আনকমন নামে মানুষজনের আগ্রহ থাকে। ব্রান্ড হয়ে যায়। আইন বলে, আনকমন নামের ট্রেডমার্ক পাওয়াও সহজ।
বাংলা নববর্ষে ক্যাম্পাসের গাদাগাদি বিরক্তিকর লাগে। এত এত মানুষের সঙ্গে ঠেলাঠেলি ভাল লাগে না। সময় কম। টাকা-পয়সাও কম। কাছের কোনো জেলায় যেতে হবে। একক জেলা হিসাবে আরো একটা যোগ হবে আমাদের সফর তালিকায়। তাই মুন্সীগঞ্জ। আমাদের সিদ্ধান্তগুলো হঠাৎ করেই হয়। মুন্সীগঞ্জ যাব ঠিক করলাম জুমার নামাজের পর। গুলিস্তান পার্কের দক্ষিণ পাশে ধুলায় অন্ধকার একটা জায়গা থেকে বাসে উঠলাম সন্ধ্যারও আগে।
বাসে ওঠার পর আবার সেই পুরোনো পদ্ধতি অনুসরণ। যেখানে যাচ্ছি সেখানে পরিচিত কে বা কারা আছে। আমাদেরতো টাকা-পয়সা কম। তাই পরিচিত লোকজন পেলে ব্যাপক সুবিধা হয়। এরআগে মানিকগঞ্জ, শেরপুর, মৌলভিবাজারে চরম সুবিধা পেয়েছি। মুন্সীগঞ্জে বন্ধু ইফরানকে পাওয়া গেল। বাহ। আলিশানভাবে রাতে থাকা-খাওয়া, সকালের নাস্তা। রাতে নদীর তীরে জম্পেস আড্ডা। ইফরানদের গোছানো পরিবার, চমৎকার বাসা-সবমিলিয়ে অসাধারণ।
ইদ্রাকপুর কেল্লা
ঘুরতে নামলাম পরদিন পহেলা বৈশাখ। প্রথমে শহরের মধ্যেই ইদ্রাকপুর কেল্লা। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে সেনাপতি ও বাংলার সুবেদার মীর জুমলা কর্তৃক ১৬৬০ সালে বিক্রমপুরের এই অঞ্চলে ইদ্রাকপুর কেল্লা নামে এই দুর্গটি নির্মিত হয়। মগ জলদস্যু ও পর্তুগীজদের আক্রমন হতে এলাকাকে রক্ষা করার জন্য এই দূর্গটি নির্মিত হয়। জনশ্রুতি আছে এ দূর্গের সাথে ঢাকার লালবাগের দূর্গের সুড়ঙ্গ পথে যোগাযোগ ছিল। এইগুলো জেলা তথ্য বাতায়নে লেখা আছে। আরো লেখা আছে, ঐতিহাসিক এই দূর্গটি সংস্কার করা একান্ত প্রয়োজন। এইটাই আসল কথা। সুন্দর কেল্লা কারা যেন বেদখল করে আছে। কেল্লার ওপরে উঠে দেখি মহিলাদের আর বাচ্চাদের ছোট ছোট কাপড়-চোপড় শুকাতে দেওয়া।
ইফরানসহ আমরা চারজনে একটা অটো ভাড়া করলাম। গন্তব্য মহাকালী ইউনিয়ন, কেওয়ার গ্রাম। ৮০০ বছর আগে বাগদাদ থেকে পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য হযরত হোসেন শিকদার (রাঃ) আসেন এখানে। শিকদার সাহেবের মাজারটিকে চিহ্নিত করেছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ পেশোয়ারী (র)।তিনি মারা যান ১৯৯৩ সালে। তার নির্মিত মসজিদ আছে এখানে। বাৎসরিক উরস হয়।
শিকদার সাহেবের কবর অনেক লম্বা।
আরো অনেক জায়গা বাকি আছে। অটোরিক্সা চালকের সঙ্গে চুক্তি হল সবগুলা জায়গায় সে নিয়ে যাবে। ৩৪০ টাকা দিতে হবে।
কাছাকাছিই বার আউলিয়ার মাজার। ৯৭৪ সালে আরব দেশ হতে পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য তারা এখানে আসেন। এইখানে ১৯৬০ সালে জারি করা একটা ‘নির্দেশ’ বড় করে ভুল বানানে সাইনবোর্ড আকারে লেখা আছে। মুন্সীগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক এ কে এম কমরুদ্দীন নির্দেশে স্বাক্ষর করেছিলেন।
আইনের পোলাপাইন, তাই এইখানে আমাদের আগ্রহ জন্মেছে।
অতীশ দীপঙ্করের পন্ডিত ভিটা খুজতে গিয়া ভুল করে দুইটা জায়গায় চলে গেছি। এক জায়গায় মেলা চলছে। ভালই। আর আরকে জায়গায় প্রাচীন ভাঙ্গা বাড়ি-টারি। পরে শুনলাম, ভাঙ্গা বাড়িতে একসময় ডাকঘর ছিল। ৯৮২ সালে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে ৪ মাইল পশ্চিম/দক্ষিণ কোনে বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
অতীশ দীপঙ্করের বাসভবনটিই এখন পন্ডিতের ভিটা হিসাবে খ্যাত।এইখানেও বৈশাখি শাড়ি পড়া লোকজনের অভাব নাই।
সুখবাসপুর দীঘি
সুখবাসপুর দীঘি যেতে বেশি সময় লাগল না। এখানে এসে বড় রাস্তা পেলাম। এই রাস্তায় বিক্রমপুর যাওয়া যায়। সেখানে যাওয়া হয় নাই। সুখবাসপুর ছিল অভিজাত এলাকা। তখন রাম ও পাল রাজাদের রাজধানী ছিল রামপাল। অভিজাত এলাকার মানুষের পানীয় জলের কষ্ট নিবারনের জন্য খনন করা হয় সু-বিশাল সুখবাসপুর দীঘি।অভিজাত লোকজন সর্বকালেই সুবিধাপ্রাপ্ত।
বল্লাল সেনের দীঘি বলে এখন আর কিছু নাই। সামান্য একটা পুকুর আছে, আর বাকীটা বিল। আমাদের পটুয়াখালীর ভাষায় বলে ‘কোলা’। একলোক সেখানে গোসল করছিল, আমাদের তাচ্ছিল্য শুনে ক্ষেপে গেল। বলল, ‘এরচেয়ে বড় দীঘি সারা বাংলায় নাই; হাজার হাজার বছর আগে এই দীঘি হয়েছে’। দীঘিটি খনন করেন বিক্রমপুরের রাজধানী রামপালের রাজা বল্লাল সেন। একটা কিংবদন্তি আছে। বল্লাল সেনের মা প্রজাসাধারণের পানীয় জলের কষ্ট নিবারনের জন্য তার সন্তান বল্লাল সেনকে একটি দীঘি খননের আদেশ দেন। বল্লাল সেন মাকে আশ্বাস দেন যে, মা যতটুকু হেঁটে যেতে পারবেন ততটুকু খনন করা হবে। মা পরের দিন সকালে দক্ষিণ দিক হাটতে শুরু করেন। বল্লাল সেন দেখলেন মা অনেক দূর চলে যাচ্ছেন। বল্লাল সেন অসুস্থতার সংবাদ মাকে পাঠালেন। পুত্রের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে মা ফিরে আসেন। রাজবাড়ীতে মা যতটুকু জায়গা অতিক্রম করেছিলেন ততটুকু দীর্ঘ দীঘি খনন করা হয়েছিল।এই গল্প শোনার পর মুকুল বলল, দেখছো আগের রাজা-বাদশাহরা কত রসিক ছিল!
দীঘির পাড়েই শহীদ বাবা আদমের মাজার ও মসজিদ। হিজরী ৮৮৮ সালে বাবা আদম নামে একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারক মুন্সীগঞ্জে আসেন। বাবা আদমের সঙ্গে রাজা বল্লাল সেনের ১৮ দিন ব্যাপী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বল্লাল সেন পরাজিত হন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে মাগরিবের নামাযের সময় বাবা আদম নামাজে দাড়ালে রাজা বল্লাল সেন তাহাকে তরবারির আঘাতে হত্যা করেন। বাবা আদম শহীদের অনুচরেরা সে স্থানেই তাকে সমাহিত করেন এবং স্থানের নাম রাখা হয় দর্গা বাড়ী। দর্গা বাড়ীতেই শহীদ বাবা আদমের সমাধির পশ্চিম-উত্তর কোনে বাংলার জনগন শাসসুদ্দীন ইউসুফ শাহ বাবা আদম এর খানকা শরীফের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য সুলতান জালালউদ্দীন আবু জাফর শাহ এর পুত্র মহান মালিক কাফুরকে নির্দেশ দেন। ১৪৭৯ সালে মালিক কাফুর সু-দৃঢ় বিস্তীর্ণ পাথর ভিতের উপর দুইটি স্তম্ভের কাঠামোতে মজবুত ফিলানের উপর ভর করে ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি বেশ সুন্দর। এখানে জনশ্রুতি আছে মসজিদের ভিতরে ভিত্তি পাথরের স্তম্ভ দু’টি জিন জাতি স্থাপন করে দিয়েছ। মসজিদটি পুরাকীর্তির নিদর্শন স্বরূপ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রনাধীন আছে। মসজিদের ইমাম সাহেব আধুনিক আছেন। ছবি তুলতে চাইলে রাজি হয়ে আরো জানালেন প্রযুক্তির অগ্রগতি ইসলাম প্রচারে অবদান রাখছে। তার নিজের ওয়াজের সিডি পাওয়া যায় বাজারে।
দুপুরের মধ্যে সফর শেষ হয়ে এলো। মুক্তারপুর ব্রিজের গোড়ায় অটো থামল। ইফরান বিদায় নিল।
দেখলাম হাতে সময় আছে। নারায়নগঞ্জ ঘুরে যাই। মুকুলের শরীর ভাল ছিল না। ঔষধের ওপর চলছিল। আমাদের সফল রুল আনুযায়ী, শরীর বা মন খারাপ টাইপের কিছুর চান্স নাই। এইসব বললেই পানিশমেন্ট। নারায়নগঞ্জ শহরটাকে ছোট মনে করেছিলাম। আসলে তা না। বিবি মরিয়মের মাজারে গেলাম। হাজীগঞ্জ কেল্লায় গিয়ে ক্লান্ত আমরা অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। বিকালের ফুরফুরে বাতাস গা জুড়িয়ে দিল।
প্রতিটা সফরে আমরা আসলে পুরাকীর্তি দেখার চেয়ে প্রকৃতি-মাটি-জল-মানুষ দেখায় গুরুত্ব দেই। কিন্তু এই সফর পুরাকীর্তিনির্ভর সফর।
জেলা তথ্য বাতায়নের ওয়েবসাইট ভাল জিনিস। কোন জেলায় কোন কোন পুরাকীর্তি আছে মূলত এইসব তথ্যে ভরপুর। কিন্তু সময় কাটানোর জন্য যে আরো সুন্দর প্রকৃতি আছে, মনভোলানো আনেক জায়গা আছে, উপভোগ করার মত বহুত কিছু আছে-এইসব তথ্য সেখানে নাই। মুন্সীগঞ্জে সবচেয়ে ভাল কি, এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, রাতে নদীর তীরে বসে থাকা; দক্ষিণবঙ্গের লঞ্চগুলো টিপটিপ আলো জ্বালিয়ে শব্দ করে যায় সেগুলো দেখা আর মুক্তারপুর ব্রিজের উপর থেকে মুন্সীগঞ্জ শহরসহ আশপাশ দেখা-এটাও অবশ্যই রাতে।
নারায়নগঞ্জেও প্রচুর মানুষের ভিড়। বৈশাখ উদযাপনের নামে বিশ্রি গাদাগাদি। মুকুলের চেহারায় ততক্ষণে অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। একটা তরমুজ কিনে খেলাম। পরাণ ঠান্ডা হয়ে গেল। তোলারাম কলেজের নাম শুনেছি বহুত, গিয়া দেখি পিচ্চি একটা ঘিঞ্জি ক্যাম্পাস।
চাষাঢ়া স্টেশন থেকে সন্ধায় ট্রেনে উঠলাম। ৬ টাকায় ঢাকা ফেরত আসলাম।
ও ভাল কথা, থ্যাঙ্কু য়ু ইফরান।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১২ রাত ১:৪৯