অঞ্চল সম্পর্কিত ধারণা
যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভালো। রাস্তঘাট এককথায় চমৎকার। ঢাকা থেকে রাণীশংকৈল যেতে শুধুমাত্র দিনাজপুর থেকে রাণীশংকৈল পর্যন্ত রাস্তাটা একটু সরু। তাও আমার পটুয়াখালীর রাস্তার তুলনায় বেশ বেশ ভাল। পাবলিক যানবাহন তুলনামূলক কম। প্রায় সব বাড়িতে প্রাইভেট যানবাহন বিশেষকরে মোটরসাইকেল আছে। মোটরসাইকেল না থাকলে সাইকেলতো থাকবেই। একটামাত্র পরবিার নিয়েই বেশিরভাগ বাড়ি। ঘরগুলো সাধারণত একতলা, চারপাশে দেয়াল, ওপরে টিন। মাঝখানে উঠোন, চারপাশে স্কুলের মতো ঘর। সবটুকুই একটা সংসারের নিজস্ব। আমার এলাকায় অনেকগুলো পরিবার বা ঘরের উঠোন-পুকুর অংশীদারিত্বের। অবশ্য সফরের সময় আমরা যতগুলো বাড়িতে ঢুকেছি, তারমধ্যে নিরেট বা প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়ি ছিল না।
এইখানকার একটা আঞ্চলিক ভাষা আছে। কয়েক আলিফ টান দিয়া সবাই কথা বলে। মানুষগুলা বেশিরভাগই সহজ-সরল। অমায়িক টাইপের ধান্ধাবাজ এইখানে কম।
ঘুরাঘুরি শুরু......
১. কুলিখ নদী এবং জমিদার বাড়ি
মুকলদের বাসায় প্রায় পরিত্যাক্ত ভাঙ্গা-টাঙ্গা একটা মোটর সাইকেল পাওয়া গেল। মুকুল ভাল ড্রাইভার। আমি মাঝখানে, শেষে আমান। প্রথমেই গেলাম কুলিখ নদী। নামটা অনেকেই জানেন। সাধারণ জ্ঞানে পড়েছেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশকারী একমাত্র নদী। উত্তরবঙ্গের কোনো নদীর সর্বাঙ্গে পানি দেখি নাই। কুলিখেও পানি নাই। কিছুদূর পরপর গর্তের মত আছে, সেখানে পানি।
কুলিখের তীরেই রাজা-রাণীর পরিত্যক্ত ভবন। ভাঙ্গাচোরা, ক্ষয়ে ক্ষয়ে পরতেছে। ভিতরে বিষ্টার গন্ধ। জমিদার বুদ্ধিনাথের ছেলে টংকনাথ চৌধুরীর স্ত্রীর নাম ছিল জয়রামা শঙ্করী দেবী। ‘রানীশংকরীদেবী’র নামেই ‘রাণীশংকৈল’। রাণী খুব রূপসী ছিল। কুলিখে যখন গোসল করত, অন্য সবার নদীর ধারে কাছে আসা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু কেউবা দূরে গাছের ডালে উঠে, কেউবা অন্যভাবে লুকিয়ে রাণীর রূপ দেখত। রাণী গোসল করত কুলিখে, প্রকাশ্যে; আর পাবলিক গোসল করত রাণীর রূপে, দূর থেকে ।
২. রামরাই দিঘি এবং খুনিয়া দিঘি:
ঠাকুরগাওয়ের সরচেয়ে প্রাচীন ও বড় দিঘি। ভাল লেগেছে। রাণীশংকৈল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, মোটামুটি গ্রামের মধ্যে। এইটা আবার নাকি উল্লেখযোগ্য ডেটিং স্পট।
খুনিয়া দিঘি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি বধ্যভূমি। পাক বাহিনীর নির্মমতার জ্বলন্ত সাক্ষী। হাজার-হাজার বাঙ্গালীকে এই দিঘির পাড়ে গুলি করে এবং বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। । দিঘিটা এখন অনেক ছোট হয়ে এসেছে। একটা স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে দিঘির পাড়ে।
নাস্তা-পানি, খাবার-দাবার, আপ্যায়ন
মুকুলদের বাড়িতে বেশ ভাল খাবার-দাবারের আয়োজন হয়েছিল। ফলফলাদিও ছিল বেশ। তবে সবার আফসুস, আম-কাঁঠাল বা লিচু-র সিজন তখন ছিল না। আহা, এইসব কথায় আমার আর আমানের লোভ যেমন বেড়েছিল, সাথে সাথে বেড়েছিল আফসুসও। ধুর! এই অফসিজনে না আসলেই পারতাম।
মুকুলদের ঘনিষ্ট আত্নীয়-স্বজন সব কাছাকাছি দূরত্বে থাকে। দুই ঘন্টা সময় নিয়ে গেলে সবার সাথে দেখা করা সম্ভব। সবাই ব্যাপক আদর করল, ব্যাপক খাওয়া-দাওয়া। পেটে আর কত কুলোয়!
অবশ্যই পাগলার প্রসঙ্গ বলতে হবে
আমরা রাণীশংকৈল গিয়েছিলাম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগে। দেখলাম একটা পাগল ঘুরে বেরায়। সবাই ইয়ার্কি-ফাইজলামি করে। শুনলাম, সে কোন একটা ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান মেম্বার। কি কারণে পাগল হয়ে গেছে জানি না। আমরা রাতে আড্ডা দিচ্ছিলাম ৫-৬ জন মিলে। আমাদের কাছে আসল। কেউ একজন একটা বিষয় নিয়ে খোচা দিল, অমনি তার বুলি ছুটল। টানা ৫-৭ মিনিট ইংরেজিতে বকাবকি করল। ইন্ডিয়ারে গালির ওপর গালি। দার্শনিক নানা মন্তব্য করতে থাকল। একটা মন্তব্য এরকম, ‘স্মৃতি হল বন্ধন আর বিস্মৃতি হল মুক্তি’। সবাই হাসতে থাকল। আমরা হাসব কী, অবাক হয়ে গভীর দার্শনিকতায় ডুবে গেলাম। হায়রে মানুষ, মানুষের নিয়তি, পরিণতি!
আবার ঘুরাঘুরি.......
পরদিন আবার ঘুরাঘুরি শুরু হল। মুকুলের বড়বোনের বাসা পাশের উপজেলা পীরগঞ্জে। দুলাভাই ব্যাবসা করে। শালাবাবু বন্ধুদের নিয়ে আসবে বলে নিজের মোটরসাইকেল তেল-টেল ভইরা পুরা রেডি করে রেখেছেন। গুড দুলাভাই।
ছোট ভাইগ্নাটা মজার। আমার গায়ে লাল-সবুজের টি-শার্ট, আমার নাম দিল ‘বাংলাদেশ মামা’। আমানের নাম দিল ‘সুন্দর মামা’। ভাগ্নিটা প্রাইভেট পড়তে গেছিল। জরুরি তলবে চলে আসল। হারমোনিয়াম বাজাতে শিখেছে, আমাদের একটা গান গেয়ে শুনালো।
দুলাভাইয়ের মটরসাইকেলে আমাদের সফরের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায় শুরু হল। ফুল স্পিডে মটরসাইকেল চলছে, সুন্দর রাস্তা, দু’পাশে বিস্তীর্ন সবুজ আর সবুজের বিছানা, মানুষজন কম, একবার গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও নামল, ওয়াও। সেই অভিজ্ঞতা একান্তই আমাদের তিনজনের। সেই অনুভুতিগুলোর, সেই সুখগুলোর বর্ণনা দেওয়া যায় না।
৩. হাটুজলের নাগর নদী এবং বিনা ভিসায় ইন্ডিয়া
ধর্মগড় সীমান্তে একটা নদী আছে, নাগর নদী। নদীটাই বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ার সীমানা। নদীর ওপারে অনেক জায়গার পর কাটাতারের বেড়া দেখা যাচ্ছে। লোকজন কম। দেখলাম একমহিলা অনেকগুলো গরু নিয়ে নদী পার হয়ে গেলেন। আমরাও পার হলাম। হাটুজল। ওপারে উঠে অনেকদূর গিয়ে একটা ছেলেকে পেলাম। কথা বলে জানা গেলো সে ইন্ডিয়ান। আরো জানলাম আমরা ইন্ডিয়ার ভূখন্ডে ঢুকে গেছি। বাংলাদেশি ছোট একটা মেয়ে গরু চড়াচ্ছে। বলল, ‘পুলিশ আইলে আমরা পালাই’। ২০১০ এর জানুয়ারিতে যখন ইন্ডিয়া গেছিলাম, ভিসার জন্য কী দৌড়ঝাপ-ই না লাগছিল! আমি দ্বিতীয়বার আর আমান-মুকুল প্রথমবার ইন্ডিয়া ঢুকলাম ভিসা ছাড়াই।
৪. প্রাচীন সূর্য্যপুরী ঐতিহ্যবাহী আমগাছ
আনুমানিক বয়স ২০০ বছর। প্রায় ৩ একর জায়গায় ওপর গাছটি দাড়িয়ে আছে। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে এইটা নাকি সবচেয়ে বড় আম গাছ। সতর্কবাণী সমৃদ্ধ একটা নোটিশ আছে। ছবিটার লেখা পড়লে ব্যাপক মজা পাবেন।
ঐদিন বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা ছিল। যাওয়ার পথে একটা দোকানে দেখে গেলাম বাংলাদেশ ব্যাটিং করছে। ফেরার পথে দেখি খেলা শেষ। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। এরপর যে কয়টি জায়গায় ঘুরেছি, মজা পাই নাই। মনের ভিতর ক্ষোভ থাকলে ঘুইরাও মজা নাই।
পরদিন দিনাজপুরে আসলাম। পুরোদিন দিনাজপুর ঘুরলাম। আসার পথে টিকিট কাটার টাকা দিল আমান। আহ শান্তি।
সবচেয়ে কম খরচে টোটাল সেলিব্রেশন।
থ্যাঙ্কু মুকুল।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ৯:২০