আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে !
পরাধীনতা, শোষণের কবল থেকে জাতিকে প্রথম স্বাধীন ও মুক্ত হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি প্রত্যয়ী ও বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছেন, জাগ্রত করেছেন জাতীয়তাবোধ। তার কলম শাসকের অস্ত্রের চেয়ে বেশি শক্তিমান ছিল। তিনি ছিলেন মানবতার কবি। তিনি বিদ্রোহী, তিনি সংগ্রামী, তিনি প্রেমিক, আবার তিনিই শান্তির বার্তাবাহক।
আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ বাংলাদেশের জাতীয় এ কবির ১১৪তম জন্মবার্ষিকী। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের এ দিনে (১৮৯৯ সালের ২৪ মে) তিনি কলকাতার বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে পরাধীন জাতির মুক্তির বাণী নিয়ে ধূমকেতুর মতো জন্মগ্রহণ করেন। তাই এ জাতির নিজেকে নতুন করে সৃষ্টি করার দিনও ১১ জ্যৈষ্ঠ।
নজরুলের মহা সৃষ্টি থেকে কয়েকগুচ্ছ
শিশু মানসের কবি :
'' ও মামা অমনি জামা
অমনি মাথায় ধামা,
দেবেনা বিয়ে দিয়ে !
মামি মা আসবে এ ঘর
বাস্ ! কি মজার খবর
আমি রোজ করবো বিয়ে ''
কিংবা বুবুর বে'তে ছোট ভাইটির আকুতি :
'' মনে হয় মন্ডা মেঠাই
খেয়ে জোর আয়েশ মেটাই
ভালো ছাই লাগেনা ভাই
যাবি তুই একেলাটি ...
বুবু তুই সেথায় গিয়ে
যদি ভাই যাস ঘুমিয়ে
জাগাবো পরশ দিয়ে
রেখে যাস জীয়ন কাঠি
যে কবির মনে বসত করে ছোট্ট খুকি :
“ কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?-
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকল্গুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
কাঠবেড়ালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল?
দেখনি তবে? রাঙাদা'কে ডাকবো? দেবে ঢিল!
পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা!
তাইতো তার নাকটি বোঁচা!
হুতমো-চোখী! গাপুস গুপুস!
একলাই খাও হাপুস হুপুস!
পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!
হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!
ইস। খেয়োনা মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!
আমিও খবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও!
কাঠবেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি' হবে?
বৌদি হবে? হুঁ, রাঙা দিদি?
তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঁ !
এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো?
ফ্রকটা নেবে? জামা দু'টো?
আর খেয়ো না পেয়ারা তবে,
বাতাবি নেবুও ছাড়ুতে হবে!
দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ যে ছুট? অ-মা দেখে যাও!-
কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!! ”
কিংবা দুরন্ত কিশোরের কবি :
‘‘ বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম, একটু দাড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা মড়াত করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।
আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল! …
সেকি ভাই যায় রে ভুলা-
মালীর ঐ পিটুনিগুলা!
কি বলিস ফের হপ্তা!
তৌবা-নাক খপ্তা…!
ফুল ও প্রকৃতি প্রেমী কবি :
ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল-
ঝিঙে ফুল।
গুল্মে পর্ণে
লতিকার কর্ণে
ঢল ঢল স্বর্ণে
ঝলমল দোলে দুল-
ঝিঙে ফুল।
পাতার দেশের পাখী বাঁধা হিয়া বোঁটাতে,
গান তব শুনি সাঁঝে তব ফুটে ওঠাতে।
পউষের বেলা শেষ
পরি' জাফরানি বেশ
মরা মাচানের দেশ
ক'রে তোল মশগুল-
ঝিঙে ফুল।
শ্যামলী মায়ের কোলে সোনামুখ খুকু রে
আলুথালু ঘুমু যাও রোদে-গলা দুকুরে।
প্রজাপতি ডেকে যায়-
'বোঁটা ছিঁড়ে চ'লে আয়।'
আসমানের তারা চায়-
'চ'লে আয় এ অকূল!'
ঝিঙে ফুল।।
তুমি বল-'আমি হায়
ভালোবাসি মাটি-মায়,
চাই না ও অলকায়-
ভালো এই পথ-ভুল।'
ঝিঙে ফুল।।
কিংবা পড়া ফাঁকি দিতে কড়া শাসন করা বাবার প্রতি খোকা :
“আমি যদি বাবা হতাম
বাবা হতো খোকা
না হলে তার নামতা পড়া
মারতাম মাথায় টোকা ”
বাবার মনে খোকা :
“ খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে
আমি যদি পারি বাসা নিতে ! ”
দুষ্ট ছেলেদের মানসে কবি :
“অ মা তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং ?
খ্যাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা, নাক ডেঙাডেং ড্যাং!
ওঁর নাকটাকে কে করল খ্যাঁদা র্যাঁদা বুলিয়ে!
চামচিকে- ছা বসে যেন ন্যাজুড় ঝুলিয়ে!
বুড়ো গরুর টিকে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং!
অ মা আমি হেসেই মরি, নাক ডেঙাডেং ডেং! ”
রসূল প্রেমিক কবি :
‘‘খেলেগো ফুল্লশিশু
ফুল কাননের বন্ধু প্রিয়,
পড়েগো উপচে তনু
জোৎস্না চাঁদের রূপ অমিয়
সে বেড়া হিরক নড়ে
আলো তার ঠিকরে পড়ে ... ’’
ডুবন্ত জাতির কান্ডারি কবি :
‘‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,
" কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসেকোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা',
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
কবি লিখে যান: ‘‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।’
নারী জাগরণের কবি :
‘‘ নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নর সমঅধিকার
মানুষের গড়া প্রাচির ভাঙ্গিয়া করিয়াছি একাকার ”
সাম্যের গান গেয়ে যান যে কবি :
“ সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।”
বাংলা ও বাঙালির অহংকার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একদিকে অনন্ত প্রেম, অন্যদিকে বিদ্রোহ। কী কবিতায়, কী গানে, উপন্যাসে, গল্পে সর্বত্রই মানবমুক্তির প্রেমময় বাণী ও দ্রোহের বাণী। দুই-ই ঝঙ্কৃত হয়েছে জাতীয় কবি নজরুলের সৃষ্টিতে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, কুসংস্কার, হীনম্মন্যতার বিরুদ্ধেও শিখিয়েছেন রুখে দাঁড়াতে।
চরম দারিদ্র্য ও বহু বাধা অতিক্রম করে একসময় তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা হয়ে ওঠেন। কবিতায় বিদ্রোহী সুরের জন্য তার পরিচিতি বিদ্রোহী কবি।
নজরুল দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েও ছিলেন অসাম্য, অসুন্দর ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অক্লান্ত বিদ্রোহী চির উন্নত শির। 'জ্যৈষ্ঠের ঝড়' হয়ে এসেছিলেন এই চির বিদ্রোহী-প্রেমিক কবি। বাংলা কাব্যে এক নতুন যুগের স্রষ্টা নজরুল পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে মুক্তির বাণী বয়ে এনেছিলেন তার কাব্যে। সূচনা করেছিলেন এক নতুন যুগের। 'অগ্নিবীণা', 'বিষের বাঁশী' আর 'ভাঙ্গার গান' ‘যৌবনের জয়গান’ গেয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন তিনি গোটা উপমহাদেশের মানুষকে।
১৯২১ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে সে সময়ে ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছেন। ব্রিটিশ বিরোধী কবিতার জন্য করেছিলেন কারাবরণ। কিন্তু কখনওই ঔপনিবেশিক শাসনের কাছে মাথা নত করেন নি। ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য উজ্জীবিত করতে বারবার গেয়েছেন ''বল বীর, বল উন্নত মম শির। শির নেহারি আমারি নতশির, ওই শিখর হিমাদ্রির।'' বাংলা গানের জগতে নজরুল সুর ও বাণীর ক্ষেত্রে ঘটিয়েছেন এক অনন্য বিপ্লব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৪ মে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে ঘোষণা করা হয় জাতীয় কবি হিসেবে। ১৯৭৬ সালে মৃত্যুবরণ করলে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।
মৃত্যুর আগে তিনি লিখেছিলেন- “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে হতে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।
কবি নজরুল আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তার অবর্তমানে তোমাদের মনে একটি প্রশ্ন আসতেই পারে। আর তা হলো- কি করলে কবির প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে। এ বিষয়ে কবি নিজেই একটা নির্দেশনা দিয়ে গেছেন তার ভক্তদের উদ্দেশ্যে। তিনি বলেছেন, "যেদিন চলে যাবো সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা, কত কবিতা বেরোবে আমার নামে, দেশপ্রেমিক, ত্যাগী, বীর বিদ্রোহী-বিশেষণের পর বিশেষণ। টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পর মেরে-বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের দিনে তুমি যেন যেয়ো না-যদি পারো চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটা কথা স্মরণ করো।"
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:২৪