১ম পর্ব
http://www.somewhereinblog.net/blog/murtala31
২য় পর্ব
http://www.somewhereinblog.net/blog/murtala31/29654620
৩য় পর্ব
উর্দুর প্রতিও তাদের মনোভাব ছিল বিদ্বেষপূর্ণ। তাদের এই মনোভাবের তীব্রতা এতোই বেশি ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানে কেবল বাংলায় লেখা সাইনবোর্ডই শোভা পেত। উর্দু বা ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডগুলো হয় নামিয়ে ফেলা হত নয়তো ধ্বংস করে ফেলা হত। পুরো প্রদেশ জুড়েই এমন টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে বাঙ্গালিদের অসুখী সম্পর্ক কারোরই নজর এড়ানো সম্ভব ছিল না। এই পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী মনোভাবের বাস্তব উদাহরণ হিসেবে বাঙ্গালি দোকানদারদের আচরণের কথা বলা যেতে পারে। অবাঙ্গালি ক্রেতা দোকানে এলে এরা তাদেরকে পাত্তাই দিতে চাইত না। এমনকী কোন কোন দোকানী তাদের কাছে মালামাল বিক্রিতেও অনীহা দেখাত। প্রকৃতপক্ষে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই বাঙ্গালি ক্রেতাদের অগ্রাধিকার দিত, অবাঙ্গালিদের উপেক্ষা করে অবজ্ঞা দেখাত। তখনকার পরিবেশটা এমনই চোখে পড়ার মত অবন্ধুসুলভ ছিল যে ঢাকায় নেমেই আমার মনে হল আমি নিজের দেশেই একজন পশ্চিম পাকিস্তানী অনুহূত আগুন্তুক। আমরা ঢাকা ছেড়ে চলে যাবার দু’সপ্তাহ পরেই সেখানে পুরোদমে সরকার বিরোধী দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সাহেব আত্মপ্রসাদের সাথে যে আশ্বাসবাণী আমাদের শুনিয়েছিলেন তা সহসাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে আমদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিল।
সব ভাল জিনিসেরই শেষ থাকে। দশ মাস পর ধরে চলার পর ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাদের কোর্সটিও শেষ হয়ে গেল। ১৯৬৮ এর মাঝামাঝি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ শরীফ (পরবর্তীতে চেয়ারম্যান, জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ) স্টাফ কলেজের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান। যুদ্ধ কোর্সটির প্রতি তার ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল। তিনি কোর্সটির ঘষা মাজার পেছনে অনেক সময় ব্যয় করেন। কোর্স শেষে সমাপনী বক্তব্য দেয়ার বদলে তিনি আমাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা স্বাক্ষাৎকার নেন। তিনি কোর্সে অসাধারণ কৃতিত্বের আমাকে জন্য অভিনন্দন জানান। শুধু তাই নয় তিনি চিফ ইন্সট্রাকটর পদে বিগ্রেডিয়ার মোহাম্মদ রহিম (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এর স্থলে আমাকে দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব দেন। চিফ ইন্সট্রাকটর মোহাম্মদ রহিম তখন তার মেয়াদ পূরণ করে পোস্টিং এর অপেক্ষায় ছিলেন। প্রস্তাবটি লোভনীয় হলেও আমি তা ফিরিয়ে দেই। স্টাফ কলেজের ট্যাকটিকাল (১৯৫২-৫৫) এবং স্টাফ উইংস (১৯৫৮-৬১) এ আমার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। তাই আমি নতুন কোন বিভাগে পোস্টিং পেতে আগ্রহী ছিলাম। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ শরীফ আমার অনুরোধটি রাখেন। আমাকে লাহোরে হেডকোয়ার্টাস এর সাথে আর্টিলারি ২ কোরের কমান্ডার করে পাঠান হয়।
এ পর্যায়ে আমি একটি ছোট্ট অথচ ভিষণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা বলে নিতে চাই। এই ঘটনাটি পরবর্তীকালে আরো কিছু ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে হেডকোয়ার্টাস আর্টিলারি ২ কোর গড়ে তোলার কাজে আমি রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত জেনারেল হেডকোয়ার্টাস এ যাই। সেখানে এক সন্ধ্যায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসানের সাথে সৌজন্য স্বাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আমি তার বাসায় যাই। সেসময় তিনি সবেমাত্র চিফ অব জেনারেল স্টাফ হয়েছেন। তার পূর্বসূরী ছিলেন মেজর জেনারেল ইয়াকুব খান। ইয়াকুব খান বহুদিন ধরে আর্মাড ডিভিশন, কমান্ড এবং স্টাফ কলেজের প্রধান হিসেবে কাজ করে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। এছাড়া তিনি চিফ অব জেনারেল স্টাফ পদেও কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেছিলেন। হঠাৎ করেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ইম্পেরিয়াল কলেজের সামান্য একজন ছাত্র হিসেবে পাঠানো হয়। তাকে ক্ষমতার পথ থেকে সরিয়ে দিতেই এধরনের আনাড়ি এবং শিষ্টাচারবিহীন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসানের এই ক্ষমতাময় নতুন পদ পাবার পেছনে তার উপরস্থ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অবদান ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় জেনারেল গুল হাসানের সাথে দেশের সমকালীন অস্থিরতা এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ হল। তিনি সরাসরিই আইয়ুব খানের ছেলেদের সমালোচনা করলেন। তার মতে, আইয়ুবের ছেলেরা অসৎ উপায়ে টাকা পয়সা হাতিয়ে বাবার দুর্নাম ছড়াচ্ছে। এক পর্যায়ে গুল হাসান বেশ নাটুকে ভঙ্গিতে গোপন কথা ফাঁস করে দিয়ে বললেন, “ বুড়ো মোরগটাকে বললাম, অনেক হয়েছে। আইয়ুব আর তার খয়ের খাঁ দের রক্ষা না করে এবার চলুন আমরা সামরিক আইন জারি করে নিজেদের হাতেই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণভার তুলে নেই।” কথাটি জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ইঙ্গিত করে বলা যিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৬৯ এর ২ ফেব্রুয়ারি স্ত্রীসহ আমি হজ্ব পালন করতে সৌদি আরব যাই। হজ্বের বদৌলতে মাগরেব (উত্তর আফ্রিকার পশ্চিম অঞ্চল যেখানে পশ্চিম সাহারা সহ মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া এবং মৌরতানিয়া অবস্থিত) থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত বিভন্ন দেশের মুসলমানদের সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়। তাদের মতে আইয়ুব খান বিশ্বের দরবারে পাকিস্তানের এমন একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধিশালী মুসলিম ইমেজ তৈরি করেছেন যা কারো পক্ষেই অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। তাই আইয়ুব সরকার বিরোধী দাঙ্গা হাঙ্গামায় পাকিস্তানকে ক্রমশ দূর্বল হতে দেখে তারা যারপরনাই হতাশ। তারা বেশ খোলাখুলি ভাবেই বলল যে পাকিস্তানীরা মারাত্মক রকমের ভুল করতে যাচ্ছে। এবং আবেগের বশে করা এ ধরনের ভুলের ফলে ভবিষ্যতে তাদের অবশ্যই পস্তাতে হবে। ভারতীয় মুসলমানদের সাথেও আমার দেখা হয়।তারা অন্যদের চেয়ে আরো বেশি হতাশা ব্যক্ত করল। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশে সংখ্যালঘু হয়ে অশেষ দুর্দশা সহ্য করা এই মানুষগুলোর কাছে পাকিস্তান ছিল সমস্ত আশা ভরসার স্থল। পাকিস্তানের শক্তিমত্তা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল তাদের গর্ব, প্রেরণা আর সাহসের বাতিঘর। সেই পাকিস্তানের নৈরাজ্যকর ভবিষ্যত কল্পনা করে তারা ছিল অতি মাত্রায় শঙ্কিত। হজ্ব শেষ করে আমরা বাগদাদে বেড়াতে যাই। সেখানেই খবর পেলাম আইয়ুব খান পদত্যাগ(২৫ মার্চ, ১৯৬৯) করেছেন। আইয়ুব খানের বিদায়ের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি নিজেকে একই সাথে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন।
হজ্ব থেকে ফেরার পর হেডকোয়ার্টারস মার্শাল ল জোন “বি” (পশ্চিম পাকিস্তান) এ আমার ডাক পড়ে। এটা ছিল আমার পুরোনো হেডকোয়ার্টারস কোর ৪।
আগেই বলেছি এই কোরটি গঠনের প্রথম থেকেই আমি জড়িত ছিলাম। সেখানে যাবার পর সিনিয়র স্টাফ অফিসারদের একজনের মাধ্যমে চমকপ্রদ খবর জানতে পারলাম। খবরটি হল, প্রথমে নাকী আইয়ুব খানের সমর্থনেই জোনারেল হেড কোয়ার্টারস থেকে মার্শাল ল’র নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। তবে খানিক বাদেই সে সিদ্ধান্ত বদল করা হয়। জেনারেল ইয়াহিয়ার আশেপাশের লোকজন তাকে কান ভাঙ্গানি দেয়। তাকে বোঝানো হয় আইয়ুবকে টিকিয়ে রাখতে মার্শাল ল জারির চেয়ে আইয়ুবের পদত্যাগেই তার লাভ বেশি। ইয়াহিয়া তাদের কানপড়ায় প্রভাবিত হয়ে আইয়ুবকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম. আত্তিকুর রাহমান এর কাছে এই গল্পের সত্যতা জানতে চাইলাম। তিনি দৃঢ়ভাবে গল্পটি প্রত্যাখ্যান করে বললেন যে তিনি উপর থেকে কেবল মাত্র একটি আদেশ পালনেরই নির্দেশ পেয়েছিলেন। আর সেই আদেশে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করা হয়েছিল।
ছুটি শেষে আমি লাহোরে হেডকোয়ার্টাস অর্র্টিলারি ২ কোর এ আমার কর্মস্থলে ফিরে আসি। এর কিছুদিন পরেই আমার বদলীর নির্দেশ আসে। আমাকে ১০৭ নম্বর বিগ্রেডকে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। ঘটনাটি খুবই আকস্মিক ছিল। আমি তখন ঝিলোমে আমার একটি ইউনিট পরিদর্শনে ব্যস্ত। সেখানেই বদলির খবরটি আমি পাই। তখন আমার আশেপাশের লোকজন এমনকী আমিও ১০৭ নম্বর ব্রিগেডের অবস্থান সম্পর্কে জানতাম না। তার পরের দিন আমি মংলায় (পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত) কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমার পদোন্নতির খবর নিশ্চিত করলেন। অতএব আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের যশোর অঞ্চলের দিকে রওনা হতে হল। আমাকে বলা হল যশোর থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর আমাকে ঢাকা যেতে হবে। সেখানে মেজর মুজাফ্ফরউদ্দীন ঢাকা অঞ্চলের দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দেবেন।
লাহোরে এসেছিলাম তিন মাসও হয়নি। জিনিসপত্র সব প্রায় গোছানোই ছিল। আমি সময় নষ্ট না করে লাহোর থেকে অনেক অনেক দূরে আমার নতুন গন্তব্যে রওনা হয়ে গেলাম। নতুন দায়িত্ব নিতে আমি এতোই মুখিয়ে ছিলাম যে ঢাকায় ব্রিফিংয়ের জন্য থামলামও না। সোজা যশোরে এসে ১০৭ ব্রিগেডের কমান্ড গ্রহণ করলাম। বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে খুলনা বিভাগের সহ-সামরিক আইন প্রশাসকের পদটিও আমাকে দেয়া হল। সামরিক আইন বজায় রাখার জন্য রুটিন ধরা খুঁটিনাটি কাজতো ছিলোই, এর পাশাপাশি আমার দায়িত্ব ছিল আমার এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা।
যশোর এলাকাজুড়ে একটি অদ্ভূত সমস্যা ছিল। এই বিভাগের সাথে ভারতের পশ্চিম বাংলার বিস্তৃত খোলা সীমান্ত ছিল। প্রাকৃতিক কোন বাধা বিপত্তি না থাকায় পুরো সীমান্ত জুড়েই অবাধে দুই পারের মানুষের যাতায়াত ছিল। যশোর থেকে ভারতের পশ্চিম বাংলা প্রদেশের রাজধানী ক্যালকাটা (এখন কোলকাতা) ছিল মাত্র ৪০ মাইল। তার উপর যশোরের ২০ ভাগ লোকই ছিল হিন্দু ধর্মের মানুষ। এই দুইয়ের যোগসূত্র আমাদের চিরশত্রু ভারতকে পাকিস্তানের মাটিতে অবৈধ অনুপ্রবেশ, নাশকতা এবং অন্তর্ঘাতমূল কর্মকা- ঘটানোর সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছিল। এছাড়া খুলনায় বিরাট সংখ্যক শ্রমিক বসবাস করত। তাদের বিক্ষুব্ধতাও ঐ অঞ্চলে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী ছিল। সেখানকার পয়সাওয়ালা হিন্দু সম্প্রদায় এদেরকে হাতে রাখার জন্য দেদারসে খরচ করত, অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ডে এদেরকে উষ্কানী দিত। আওয়ামী লীগের পান্ডারা, এমনকী কম্যুনিস্ট দলগুলোও এদের উপর ছড়ি ঘুরাতো। আর সীমান্তের ওপাশ থেকে এ সব কিছুর সমর্থন ও উৎসাহ যোগাত ভারত।
যশোরে আমি মাস তিনেক ছিলাম। এসময়টাতে তেমন কোন বড় ধরনের ঘটনা ঘটেনি। তবে পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত, বিস্ফোরণমুখ। বোঝা যাচ্ছিল সামনে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। মার্শাল ল ভেঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান তখন পুরো এলাকা চষে বেড়াচ্ছিলেন। একের পর এক জনসভায় আগুন ঝরানো বক্তৃতা দিয়ে তিনি এলাকার মানুষগুলোকে তাতিয়ে তুলছিলেন। শেখ মুজিবর রহমানের বিপরীতে স্থানীয় মুসলীম লীগ নেতা আবদুস সবুর খান ছিলেন একবারেই নিষ্প্রভ। মুজিব বাঙ্গলিদের বঞ্চনার শাশ্বত অনুভূতি নিয়ে খেলছিলেন। তিনি বাঙ্গালিদের সমস্ত দুঃখ দুর্দশার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করতে থাকেন। সেই সাথে “শালা পাঞ্জাবী”, “শালা বিহারী” রা ছিল তার আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ধারনা ছিল মুজিবকে ঘাটানো হলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়বে। তাই তিনি মুজিবকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার নির্দেশ জারি করেছিলেন। এই অঘোষিত ক্ষমার সুযোগ নিয়ে মুজিব বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। লোকে লোকারণ্য জনসভাগুলোতে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্বিচারে তুলোধুনা করতে থাকেন। এভাবে তিনি বাঙ্গালিদের মনে অবাঙ্গালিদের সম্পর্কে তীব্র ঘৃণার মনোভাব ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত তার সভায় প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করত। কথার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে তারা মুজিবের মিথ্যা রটনার বড়শীতে টপাটপ গেঁথে যেত।
অন্যদিকে বাঙ্গালি সামরিক অফিসারেরা নিজেদের তৈরি খোলসের ভেতর নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল। তারা তাদের পশ্চিম পাকিস্তানী সহকর্মীদের সাথে খুব কমই মেলামেশা করত। তাদের পরিবারেরাও পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতো। প্রতি বিকেলে তারা ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে নিজেরা নিজেরা গল্প গুজব করত। পুরোপুরি বাঙ্গালীদের আড্ডা হওয়ায় সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানীরা যোগ দিতে পারতো না। ফলে আড্ডার বিষয়বস্তু সম্বন্ধেও কোন কিছু জানা সম্ভব হত না। বিগ্রেড কমান্ডার বা তার পরিবারের সদস্যরা বন্ধুসুলভ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেলেও বাঙ্গালি অফিসারদের পক্ষ থেকে কোন আন্তরিক সাড়া পাওয়া যেত না। বাঙ্গালিদের সমস্ত কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম দস্তগীরের কমান্ডে থাকা ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। মনে পড়ে, কোন এক তুচ্ছ ঘটনায় গোলাম দস্তগীর লাহোর থেকে আগত ২৭ বেলুচ রেজিমেন্ট এর খৃষ্টান কমান্ডিং অফিসারের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করেন। ওই ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলাটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না। তবে এই ঘটনা প্রমাণ করে যে বাঙ্গালিদের ভেতর বিদ্বেষের বিষ কতটা প্রখর ছিল। এই বিদ্বেষই পশ্চিম-পাকিস্তান বিরোধী মনোভাবকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিল। এমনকী অভিজাত সুসৃঙ্খল একটি সামরিক বাহিনীর সিনিয়র অফিসারদেরও বিদ্বেষের এই বিষ গিলে খেয়েছিল।
আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলাম যে, আওয়ামী লীগের বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব নেতারা ছিল তাদের কারোরই জনসভা করে জাতীয় ঐক্য এবং অবিভক্ত পাকিস্তানের কথা বলার মত সাহস বা সামর্থ নেই। শেখ মুজিবের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার মত কোন নেতাই তখন ছিল না। শেখ মুজিব মিথ্যা পরিসংখ্যান আর হিসাব দিয়ে জনসাধারণকে বুঝাচ্ছিলেন যে কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক আয় দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন ঘটছে। এমনকী কেন্দ্রীয় সরকারের কোন দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও এসব মিথ্যার কোন প্রতিবাদ জানানো হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের ভ্রমণ করার সময়েই আইয়ুব আমলে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ফলাফল খুব সহজেই চোখে পড়েছিল। কিন্তু এই অকাট্য প্রমাণের পক্ষে একটি কথা বা বাক্যও কোথাও বলা হলো না। মুজিবের প্ররোচনায় সাধারণ বাঙ্গালীরা পৃথিবীর বুকে “সোনার বাংলা” নামের এক স্বর্গ তৈরির অলীক স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। স্বল্প কিছু খনিজ সম্পদ আর বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দেশটির ভবিষ্যত কল্পনা করাটা বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন কারোর পক্ষে কঠিন কিছু না। কিন্তু সেসময় বাঙ্গালিদের বাস্তব জ্ঞান পুরোপুরি লোপ পেয়েছিল। সে কারণে তারা বুঝতে পারছিল না যে আলাদা হয়ে গেলে তাদের দেশটির পক্ষে ক্ষুধা, দারিদ্র ছাড়া আর কিছুই দেয়া সম্ভব হবে না। যাই হোক, আবেগ যখন যুক্তিকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যায় তখন মানুষের সকল বিচার বুদ্ধি লোপ পায়। ফলে তারা পেছনে না তাকিয়েই চোখ বুজে সামনের দুর্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। (চলবে)
** অপারেশন সার্চলাইট এর মূল অপারেশনাল ডিটেইলস সহ বইটি মোট নয়টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। প্রথম পরিচ্ছেদের এখানেই সমাপ্তি। আগামী পর্ব তে থাকবে “১৯৭০ এর নির্বাচন”।
১১/০৮/২০১২
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১২ সকাল ১০:৩৬