আমার শৈশবের ঈদ বিষয়টা নিয়ে লিখতে বসে অনেক কিছুই একসাথে মনে পরে যাচ্ছে। আব্বার সরকারী চাকুরীর সুবাদে করাচীতে পাচঁ বছর থেকে আমরা তখন সদ্য ঢাকায় এসেছি । সে সময়টা ঢাকা কিছু এলাকা ছাড়া বলতে গেলে ছিল গ্রামের মতই। অন্তত আমরা যে এলাকাটিতে ছিলাম।
সে সময় বাচ্চাদের মাঝে ছিলনা সালামীর তত জনপ্রিয়তা, ছিলনা সালামির পয়সা দিয়ে ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে চটপটি খাওয়া, ছিলনা বিনোদনের কোন সুযোগ।
তবে দিনটি ছিল অন্যদিনের চেয়ে আলাদা। তখন আমার বোন ছিল একটা ভাই ছিল অনেক। তাই মেয়েদের কথা বলতে পারবোনা। মনে পরে আমি বড় ছেলে হওয়াতে আব্বা আমাকে নিয়ে যেত ইদের কেনাকাটা করার জন্য সদরঘাট বাজারে। তখন সস্তায় কাপড় কেনা আমাদের মত মানুষের জন্য সদরঘাটই ছিল শপিং এর জায়গা। দুই আনা বাস ভাড়া । আমার হাফ।
সে সময় রেডীমেইড জামা কাপড়ের চেয়ে দর্জির বানানো কাপড়েরই চল ছিল বেশি। শার্ট আর হাফ প্যন্টের কাপড় কিনতাম। পাঞ্জাবী কেন জানি পছন্দ করতাম না । এখন দেশ বিদেশের কত শপিং মলে ঘুরে কত ব্র্যন্ডেড কাপড় চোপর কিনি , কিন্ত সদরঘাটের বাজার থেকে দরাদরি করে কেনা সেই শার্ট প্যন্টের কাপড় কেনার স্মৃতি ভুলতে পারিনা
মনে পড়ে ঈদের জামাত পরতাম বাসার কাছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের মাঠে। মনে পরে সেই ছোটবেলায় একবার জামাত শেষে বৃষ্টিতে ভিজে আছাড় খেয়ে পরে জামা কাপড় কাদায় মাখামাখি করে বাসায় ফিরেছিলাম কাঁদতে কাঁদতে।
মনে পরে আমার মা আমাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতো ঈদের সারাটি দিন।কারন আমরা তখন ভাই বোন ছিলাম পাঁচ জন। মনে পড়েনা আম্মা কখনো ঈদে নতুন শাড়ি নিয়েছিল কিনা। শুধু দেখতাম ঈদ এলে আম্মার সারাদিন রান্না নিয়ে ব্যস্ততা।
ঈদ এলে আব্বা কেন জানি আমাদের চুল কাটাতে নাপিতের দোকানে নিয়ে যাওয়াটা জরুরী মনে করতেন। আমাদের কিন্ত ভীষন বিরক্ত লাগতো এই চুল কাটা পর্ব।।
প্রথম শ্রেনীর সরকারী চাকরী করা সৎ অফিসার আমার আব্বার সংসারে অত স্বচ্ছলতা ছিল না। বেশ টানাটানির মধ্যেই চলতো। কিন্ত এ নিয়ে আমরা কখনোই আফসোস করি নি। হয়তো সে সময় মধ্যবিত্ত শ্রেনী এত ভোগবাদী ছিলনা। ছিলনা তুলনা করার এত সুযোগ।
সে সময় ঈদে আমাদের মহল্লার সব বাসাতেই বেড়াতে যেতাম । আমাদের পাড়াটিও তখন এত ঘিঞ্জি ছিল না, শুধু পনের বিশটা টিনের বা সেমি পাকা বাসা। প্রতিবেশীদের সবাইকে ঘনিষ্ঠ ভাবে চিনতাম। এখনকার মত পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে তাও চিনি না সেমন অবস্থা ছিল না। মনে পরে সবার বাসায় বেড়ানোর সাথে সাথে সারাদিন ধরে চলতো শেমাই জর্দা খাওয়া। বিকেলে আব্বা আমাদের ভাই বোনদের নিয়ে যেত রমনা পার্কে। চিড়িয়াখানায়। আমার জীবনের প্রথম চিড়িয়াখানা দেখা এই ঈদের দিনেই।
আসলে ঈদের আনন্দের প্রথম স্বাদ বাবা মা এর কাছ থেকেই পাওয়া। আজ তারা কেউই জীবিত নেই।তাই চেষ্টা করি এই ঈদ বা তার পরদিন তাদের কবর জিয়ারত করতে। আমাদের কবরে হয়তো কেউ যাবে না। না যাওয়ার সম্ভাবনা নয় ভাগের এক ভাগ। কারন আমরা ভাই বোন নয় জন আর আমার একটাই সন্তান।