( ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে নেওয়া)
আমার স্ত্রীর সন্তান হবে। সমস্ত পরিবার আনন্দে ভাসছে। এই পরিবারের শেষ সন্তান ছিল আমার ভাতিজী। তার বয়স এখন ১৪ বছর। বাড়ির ছোট ছেলের বউ এমনিতে একটু বেশী আদর পেয়ে থাকে। তার পর দীর্ঘ দিন পর পরিবারে নতুন অতিথি আসবে তাই বৌয়ের যত্ন আত্তির যেন কমতি না হয় সে দিকে সবার সযত্ন খেয়াল। শহরের সবচেয়ে নামকরা গাইনি ডাক্তারের কাছে নিয়মিত যাতায়ত শুরু হল। কিছুদিন পর পর রক্ত প্রসাব পরীক্ষা আল্ট্রাসনগ্রাম চলতে থাকলো। ডাঃ কম্পিউটারে দেখে সম্ভাব্য প্রসব তারিখ জানালেন ১৬ মে। অষ্টম মাসে গিয়ে ডাক্তার সাহেবা সুখবর দিলেন পুত্র সন্তানের। পরিবারের খুশির পালে নতুন হাওয়া লাগলো। মুখে মুখে সবাই ছেলে মেয়েকে সমান বললেও প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে অধিকাংশের অন্তরে থাকে পুত্র প্রত্যাশা, এটাই আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক চিত্র।
এপ্রিল মাসে ডাঃ জানালেন সম্ভাব্য তারিখের এক সপ্তাহ আগেই সিজার করতে হতে পারে। কারন হিসেবে বললেন সিজার টাই বেশী নিরাপদ, কোন টেনশন ঝক্কি ঝামেলা নাই। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। মে মাসের ৪ তারিখ ছিল নিয়মিত চেকআপের। চেক আপ শেষে ডাঃ সাহেবা জানালেন আগামী কালকেই সিজার করতে হবে। সবার তো মুখ শুকিয়ে গেল সন্তানের অমঙ্গল চিন্তায়। ডাঃ অভয় দিয়ে বললেন, এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা নেই, কিন্তু শিশুটি এখন সম্পূর্ণ ম্যাচিউরড, সিজার না করলে ক্ষতি হবে এবং অপেক্ষা করলে দায়িত্ব নিতে হবে নিজেদের। আমরা সবাই মুখ চাওয়া চায়ি করে রাজি হয়ে গেলাম। না রাজি হয়ে উপায় নেই। তিনি সবার নির্ভরযোগ্য ডাঃ। মে মাসের ৫ তারিখেই সিজার করা হল। পরদিন সকালে অন্য এক ডাঃ এসে দেখে গেলেন, কিন্তু আমাদের নিয়মিত সেই গাইনি সাহেবা আর এলেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল সিজার শেষেই তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন তিন দিনের এক সেমিনারে যোগ দেবার জন্য। যাই হোক কোন সমশ্যা ছাড়াই সবার দোয়ায় আমার স্ত্রী সুস্থ অবস্থায় পুত্র সন্তান নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
প্রথম সন্তান থেকে তিন বছর পরে দ্বিতীয় সন্তান নেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন ডাঃ সাহেবা। আমরা সেটাও মেনে চললাম। তিন বছর পর আবার আমার স্ত্রীর সন্তান হবে। গতবার সিজারের পর ডাঃ ঢাকায় চলে যাওয়ায় এবার তার প্রতি আস্থা না করে অন্য ডাঃ খোঁজ করলাম। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন সবাই সেই আগের গাইনির কথাই বললেন। আবার ও গেলাম তার কাছে। আগের মতই তিনি তারিখ জানালেন ১৭ জুলাই। এবারও জানালেন সম্ভাব্য তারিখের এক সপ্তাহ আগে পরে সিজার করা দরকার হতে পারে। কিন্তু জুলাইয়ের এক তারিখে বললেন আজকেই সিজার করতে হবে। আবার আমাদের আতংক। নির্ধারিত তারিখের ১৬ দিন আগে। তাহলে শিশুটিতো পরিপূর্ণ হাবে না। স্বাস্থ্য বিষয়ক বেশ কিছু ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখলাম গর্ভে শিশুর বয়স ৩৮ সপ্তাহ না হলে সিজার করা যাবে না, যদি না কোন গর্ভকালীন জটিলতা দেখা দেয়। আমার স্ত্রীর কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। ডাঃ কোন কারন না বলে শুধু অভয় দিলেন। আমাদের আবারও রাজি হতে হল। এবার কোল আলো করে এক কন্যা সন্তান এলো। সন্তান সুস্থ থাকলেও গর্ভে যে সে পরিপক্কতা পায়নি, তা তার পাপড়িবিহিন চোখ দেখেই বলে দেওয়া যায়।
আমার এই বাস্তব অভিজ্ঞতার গল্পটা এখন আমাদের দেশের সবার পরিচিত এক দৃশ্য। একটু সবচ্ছল সচেতন পরিবারের সন্তান আর সিজার ছাড়া হয়না বললেই চলে, কারন তাঁরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। কয়েকদিন আগে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে দেশের ক্লিনিক গুলতে ৮০% শিশুর জন্ম হয় সিজারিয়ানে। অথচ বিশ্বের যে দেশগুলো চিকিৎসা বিজ্ঞানে উন্নত তাঁদের শেষ চেষ্টা থাকে স্বাভাবিক প্রসবের।
স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের সে সুফল তা নিশ্চয় সকল ডাঃ জানেন, কারন এখন পর্যন্ত শুধু মেধাবীরাই ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পান এবং তাঁদের কে নিশ্চিত ভাবে সিজারিয়ান আর স্বাভাবিক প্রসবের সুবিধা অসুবিধা পড়ানো হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এই গণহারে সিজার তাঁরা কেন করে থাকেন, শুধুই কি অতিরিক্ত আয়ের জন্য? দেশের প্রথম সারির মেধাবী উচ্চ শিক্ষিত মানুষ গুলোর কাছে জাতি নিশ্চয় বিবেক বর্জিত আয় প্রত্যাশা করেনা। এখানে ক্লিনিক গুলোর একটা ভুমিকা থাকে বলেই চিকিৎসার মত মহান পেশা কে ব্যবসা বানিয়ে চলছে দালালি, হয়রানি। কিন্তু অর্থ থাকলেই ক্লিনিক বানানো সম্ভব হলেও ডাক্তার বানানো যায়না।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১৬ সকাল ৯:১৬