বড় বাজারের সবগুলো বিপণি ঘুরে ক্লান্ত পায়ে শেষ ভরসায় ঢুকেছিল নিউমার্কেটে। নিউমার্কেটের ভিড় ঠেলে ক্লান্ত অবসান্ত মনে বাইরে বের হয়ে আসে শফিক। সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকায়, তারপর আপনমনে নিচা বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
মনের মধ্যে এক অস্থিরতা। মানিব্যাগ ভর্তি টাকা, কিন্তু কিছুই তার মনে ধরছে না। অথচ রাত পোহালেই ঈদ। বাড়ি থেকে বের হবার সময় লাবনী তাকে বার বার করে বলেছে তাদের একমাত্র সন্তান অয়ন এর জন্য ভালো এক জোড়া জুতা কিনতে। বাঁকি বাজার গুলো লাবনী অয়ন কে নিয়ে সেরেছে। জুতা কেনার সময় অনেক দোকান ঘুরেও ভালো কোন সিগনেচার ব্রাণ্ডের জুতা পায়নি বলে কেনা হয়নি। বাড়িতে তার অনেক কাজ। ঘর দোর সাজাতে হবে। দেয়ালের পেইন্টিংস বদলাতে হবে। জানালার পর্দা বদলাতে হবে। আরও কতকি! তাই এই জুতা কেনার ভার শফিকের মাথায়।
শফিক জানেনা আর কোথায় খুঁজবে। আনমনে হাঁটছে, হঠাৎ তার নাকে এক অদ্ভুত গন্ধ লাগে। থমকে দাঁড়ায় সে। এই গন্ধ তার অনেক চেনা। কিন্তু মনে পড়ছেনা। কিসের গন্ধ এটা! এদিক ওদিক তাকায়। নাহ ঠিক বুঝতে পারছে না কোথায় এই গন্ধের উৎস। অথচ গন্ধ আসছে খুব ধারে কাছে কোথাও থেকে। আবারও চার পাশে তাকায়, সামনে মুদি দোকান, তারপাশে সস্তা ধরনের এক জুতার দোকান। ওপাশে কিছু কাপড়ের দোকান। সামনের দিকে কয়েক কদম ফেলতেই শফিক বুঝতে পারে এই গন্ধ জুতার দোকান থেকে আসছে। রাবার স্যান্ডেলের গন্ধ। মুহূর্তেই তার মনে পড়ে যায় শৈশবের কথা। আনন্দ মাখা ঈদের কথা, যে আনন্দ সে অনেক দিন খুঁজে ফিরছে।
বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে স্কুলে যেতে হতো। গ্রাম পার হয়ে গঞ্জের পাশে স্কুল। এই দীর্ঘ পথ অধিকাংশ দিন তাকে খালি পায়ে হেঁটে যেতে হতো। ভাগ্য প্রসন্ন হলে কোন ঈদে এক জোড়া রাবারের স্যান্ডেল পেত। ঈদের আগের হাটবারে শফিকের সময় পার হয় না। কখন বাবা আসবে। একটু পর পর রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। শফিকেরা ছয় ভাই বোন। সে চতুর্থ। শফিকের সাথে তার ছোট বোন শেফালী ও অপেক্ষার প্রহর গনে। সন্ধ্যার আলো নিভে অন্ধকার নেমে আসে। এক সময় বাবাও ফিরে। ঘরের পেছনে পায়ের আওয়াজ পেয়েই শফিক লাফিয়ে ওঠে। বাবা এসেছে। বাবা এসেছে।
শফিক এগিয়ে গিয়ে বাবার হাতে থাকা বাজারের চটের ব্যাগ ধরে। অন্ধকারেই ব্যাগের মাঝে উঁকি দেয়। ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে ক্লান্ত পায়ে ঘরে ঢোকে রমিজ মিয়া। পেছনে পেছনে ঢোকে শফিক। দৌড়ে আসে শেফালী। শুরু করে কাড়াকাড়ি। শফিকের মা ধমক দেন।
রাগ করো না শফিকের মা। ওদের কিই বা দিতে পারি। এই ঈদের জন্যই তো ওরা অপেক্ষা করে থাকে। কিছুই তো দিতে পারিনা। ওদের জন্য দেখ স্যান্ডেল কিনছি। ইচ্ছে ছিলো একটা জামাও কিনবো! দির্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড়ে গামছা নিয়ে কুয়োর পাড়ে যায় রমিজ মিয়া।
শফিক তার স্যান্ডেল জোড়া বুকের সাথে চেপে ধরে পাশের ঘরে দৌড় দেয়। আস্তে আস্তে পলিথিনের প্যাকেট থেকে স্যান্ডেল বের করে। কি সুন্দর একটা গন্ধ। শফিকের অবাক লাগে কয়েকদিন পরলেই এই গন্ধ আর থাকে না। কিন্তু স্যান্ডেল তো নতুনই থাকে। শফিক স্যান্ডেল জোড়া নাকের কাছে ধরে। পাশের ঘর থেকে মা খেতে ডাকে। স্যান্ডেল জোড়া বালিশের নিচে রেখে খেতে যায়। খাওয়া শেষ করেই আবার নিজের ঘরে দৌড়। বিছানায় শুয়ে ঘুম আসেনা। কিছুক্ষণ পরপর বালিশের নিচ থেকে স্যান্ডেল বের করে দেখে। মনের মাঝে এক উথাল পাতাল আনন্দ। ঈদের আনন্দ। সকালে হলে গোসল করে জামা কাপড় পরে এই স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ঈদের নামাজে যাবে। যদিও জামাটা অত্যন্ত পুরনো হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসেনা শফিকের। স্যান্ডেল তো নতুন। এটাই সে বন্ধুদের দেখাতে পারবে।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে স্যান্ডেল বগলে চেপে ঘরের বাইরে আসে। এদিক ওদিক তাকায়। মা রান্না ঘরে কাজে ব্যস্ত। সে ধির পায়ে কুয়োর পাড়ে এসে পরিস্কার এক পাথরের উপর আলতো করে স্যান্ডেল রাখে, যেন ময়লা না লাগে। তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে। তারপর ভালো করে পা মুছে স্যান্ডেল জোড়া পায় দেয়। স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে খুব খেয়াল করে পা ফেলে শফিক, যেন স্যান্ডেলে আঘাত না লাগে। ধীরে ধীরে বাড়ির বাইরে এসে দেখে রাস্তায় তার বন্ধুরা এখনও বের হয়নি। তার আর তর সয়না। তাদের কে নতুন স্যান্ডেল দেখাতে হবে। সে আবার বাড়ি ফিরে আসে। মা সেমাই রান্না করে বারান্দায় মাদুর পেতেছে। শফিক স্যান্ডেল খুলে ডান পাশে রেখে সেমাই খেতে বসে। খাবার ফাঁকে আড় চোখে স্যান্ডেলের দেখে।
দোকানের সামনে শফিক আনমনে তার বাল্যকালের ছবি দেখে। এই এক জোড়া স্যান্ডেল দিয়েই তাকে বছর পার করতে হতো। তাই ছিঁড়ে যাবার ভয়ে অধিকাংশ দিন খালি পায়ে স্কুলে যেত।
ভাইজান স্যান্ডেল নিবেন নাকি?
দোকানির ডাকে সম্বিত ফিরে শফিকের। না মানে হ্যাঁ। শফিক এগিয়ে যায় দোকানের ভেতর।
তা ভাই কি স্যান্ডেল নিবেন?
আপনার কাছে কি রূপসা স্যান্ডেল আছে?
না ভাই সে তো অনেক দিন আগে পাওয়া যেত। আমার কাছে রূপসার চেয়ে ভাল স্যান্ডেল আছে, দেখাই আপনাকে।
দোকানি স্যান্ডেল দেখাতে থাকে। তা ভাই কার জন্যে নিবেন, মানে পায়ের মাপ আছে?
জি মানে ছোট বাচ্চাদের স্যান্ডেল দেখান।
শফিক ভাবে এই স্যান্ডেল অয়নের জন্য বাসায় নিলে লাবনী ঘর বাড়ি মাথায় তুলবে। তার পরও সে ছয় জোড়া স্যান্ডেল কিনে দোকান থেকে বের হয়। আবার সে ফিরে যায় নিউমার্কেটে। অয়নের জন্য বিদেশী এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে বাইরে এসে রিক্সায় ওঠে।
স্যার কই যাইবেন? রিক্সাওয়ালা জানতে চায়।
রেল স্টেশনে চল।
রিক্সা চলতে থাকে। ষ্টেশনের কাছে এসে রিক্সা থেকে নেমে ভেতরে পা বাড়ায়। ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়ে উপচে উঠেছে ষ্টেশন। এর মাঝে কিছু টোকাই ছেলে মেয়ে দৌড়ে গিয়ে হাত পাতছে। কেউ আবার নাছোড় হয়ে পেছন পেছন হেঁটে যাচ্ছে।
শফিক দাঁড়িয়ে থেকে খেয়াল করে এদের অনেকের পায়ে কোন স্যান্ডেল নেই। যাদের পায়ে স্যান্ডেল নেই এমন পাঁচ জন ছেলে মেয়েকে পাঁচ জোড়া স্যান্ডেল দিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে রিক্সায় চাপে বাড়ির পথে।
রিক্সায় বসে শফিক ব্যাগ থেকে বাঁকি এক জোড়া রাবার স্যান্ডেল বের করে। নেড়ে চেড়ে বেশ কয়েকবার দেখে, তারপর কোলের উপর রেখে হাত চাপা দেয়। বিকেল এখন সন্ধ্যার পথে। সূর্য তার দাপট কমিয়ে ক্লান্ত পায়ে পশ্চিমে অস্তমিত। রিক্সার গতিতে নরম বাতাস গতি পেয়েছে। বাতাসের সাথে স্যান্ডেলের গন্ধ মিশে শফিকের নাকে লাগে। অনেক দিন পর সে ঈদের গন্ধ পায়। এক অজানা ভালো লাগায় তার মন ভরে যায়।
__ __ __
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৮