গত বছর বড়দিনের ছুটিতে এক বাংলাদেশী প্রবাসি পরিবারের সাথে দেখা হয়েছিল।তাঁদের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে ক্লাস সেভেন আর ছোটটি ক্লাস থ্রীতে।নিতান্তই শিশু-কিশোরী।ফিলিপাইনে বাংলাদেশী প্রবাসি খুব কম,তারপর ফ্যামিলিসহ বাস করছেন এমন সংখ্যা হাতে গোনা।তাই বাংলায় আলাপ করার মত মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার।আর আমার কিছুটা শিশু প্রীতি থাকায় আলাপ শুরু করলাম বাচ্চা দুটোর সাথে।
জানলাম এক বছর হল এদেশে এসেছে।এর মধ্যে এদশের রাষ্ট্রীয় “তাগালগ” ভাষা অনেকটাই রপ্ত করেছে।বাংলাদেশে তাদের দাদা দাদী,নানা নানী,খালা,ফুফু,চাচা সহ অনেক আত্মীয় ও বন্ধু বান্ধব আছে।ওদেরকে খুব মিস করে।কিন্তু স্কুলে যেতে ভাল লাগত না।আমি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম,স্কুলে কোন সমস্যা? ছোট মেয়েটি জবাব দিল,দেশে অনেক পড়তে হয়।খুব সকালে ঘুম থেকে জেগে শুরু হয় হোম টাস্ক,তারপর বাসায় টিচার,স্কুল আবার কোচিং,বাসায় ফিরে আরেক টিচার।বড়টি যোগ করল,সপ্তাহে একদিন শুক্রবার মাত্র ছুটি তাও যেতে হয় গানের ক্লাসে।টিভির সামনে গেলেই বকুনি খেতে হতো।বাসায় আত্মীয়স্বজন এলে তাঁদের সাথে গল্প করার সুযোগ হতোনা।সারাক্ষণ পড়ার জন্য তাগাদা থাকতো।
আর এখানে নাকি তাদের এক তাগালগ শিক্ষার টিচার ছাড়া আর কোন প্রাইভেট টিচার বা কোচিং সেন্টারে যেতে হয়না।ক্লাসের পড়া প্রায় ক্লাশেই শেষ হয়।সামান্য কিছু হোম টাস্ক থাকে বাসার জন্য। বাসায় ফিরে টিভি দেখতে পারে খেলতে পারে।সপ্তাহে দুইদিন ছুটি,গ্রীষ্মকালে পুরো দুই মাস ছুটি। আর স্কুলেও নাকি অনেক মজা হয়।টিচাররা নাকি হেঁসে হেঁসে মজা করে পড়ান,কখনো রাগারাগি করেন না।আমাদের শিশুর কাছে এ যেন রুপকথার গল্প।
আমি স্থির হয়ে বসে ওদের কথাগুলো শুনছিলাম।ভাবছিলাম কোমলমতি এই শিশুরা কতটা মানুষিক কষ্টই না পেয়েছে।নিজের দেশ,ভাষা,আত্মীয় স্বজন সব কিছু ত্যাগ করেও খুশি বিদেশের ভিন্ন ভাষার এক স্কুল পেয়ে,মনের মত আনন্দদায়ক এক পড়াশোনার পরিবেশ পেয়ে।মনে হচ্ছিলো ওরা আমার কাছে অভিযোগ করছে আমাদের শিশু শিক্ষার বৈরি অবস্থার জন্য।অথচ আমি নিজেও কিছুটা সেই পেরেশানি মুলক শিক্ষার মধ্যে বড় হয়েছি।সময়ের সাথে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক কিছু সুষম পরিবর্তনের পাশাপাশি শিশুদের উপর পড়াশুনার চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ।ছোট ছোট শিশুরা যখন ঘুম ঘুম চোখে বড় ব্যাগের বোঝা পিঠে নিয়ে দৌড়ায় তখন মনে হয় ছোট ছোট সৈনিক যুদ্ধের রসদ নিয়ে যুদ্ধের মাঠে ছুটছে। শুনেছি বড় শহরে কিছু আধুনিক স্কুলে নাকি বাচ্চাদের মনের মত পরিবেশে পড়ানো হয়।কিন্তু সেটাত অধিকাংশের সামর্থ্যের বা সুযোগের বাইরে।দরকার সার্বজনীন এক জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতি।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আজকের এই করুন অবস্থার জন্য দায়ী মুলত শিক্ষা পদ্ধতি,মেধাবী ও সৃষ্টিশীল শিক্ষকের অভাব এবং অভিভাবকদের প্রতিযোগিতা মুলক যান্ত্রিক মানুষীকতা।