ছুটি শেষ, আবার ফিরে যেতে হবে প্রবাস জীবনে। রাত ১১.৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট যোগে যাত্রা শুরু হবে। ভোর রাতে সিঙ্গাপুর, সেখানে ৪ ঘন্টার ট্রানজিট, এর পরের ফ্লাইটে ম্যানিলা, সেটাই আমার গন্তব্য।রাত ৯টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই ড্রাইভার দৌড়ে গিয়ে একটি ট্রলি এনে মাল সামানা তুলে দিয়ে বিদায় নিল।
ট্রলি ঠেলে ২নম্বর গেটের দিকে যাচ্ছি। লক্ষ্য করলাম, ট্রলি ঠেলে নিতে বেশ শক্তি লাগছে। অথচ ব্যাগের ওজন খুব বেশী নয়। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম ট্রলির একটি চাকা ঘুরছেনা। বাধ্য হয়ে ট্রলি বদলালাম। গেটে পৌঁছতেই সিকিউরিটি পাসপোর্ট টিকেট দেখে প্রবেশ পথ ছেড়ে দাঁড়ালেন। ব্যাগ তুলে দিলাম এক্সরে মেশিনে।
ওপাশ থেকে জানতে চাইলো-
আপনার ব্যাগে কি আছে?
- অনেক কিছু আছে, যেমনঃ জামা কাপড়, মশলা, মুড়ি চানাচুর, চা ইত্যাদি।
- কলম জাতীয় কি কিছু আছে?
- হ্যাঁ, বেশ কিছু কলম আছে। ম্যাটাডর বল পয়েন্ট কলম।
- এত কলম কি করবেন?
- ম্যানিলায় আমার সহকর্মীদেরকে উপহার দেবার জন্য নিয়েছি। ওঁরা এই কলম খুব পছন্দ করে।
- কিন্তু এত কলমতো নিতে পারবেন না!
- খুব বেশিতো নয়, এটা যে ব্যবসার জন্য নয় সেটা নিশ্চয় বুঝবেন। এই কলম বিক্রি করলে টিকেটের এক শতাংশ মুল্যও আসবে না। আর কোথাও লেখা দেখিনি কয়টি কলম নেয়া যাবে বা যাবে না। ব্যবসার জন্য বা বিক্রির উদ্দেশ্যে হলে নিশ্চয় কয়েক কার্টুন নিতে হতো, এই ব্যাগের মধ্যে পুরে নেওয়া সম্ভব হতো না।
লোকটি এবার এগিয়ে এসে ব্যাগটি খুলতে বললেন। কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ খুলে দিলাম। সব কিছু ওলটপালট করে দেখলেন। সবই ব্যাক্তিগত ব্যবহারের যিনিস আর অই কলম। এবার পাশে এসে জানতে চাইলেন বিদেশে আমার কাজ কি। বলতেই খুশি হয়ে বললেন।
- ও তাহলেতো ইনকাম বেশ ভালো। আমাদেরকে চা পানি খাবার জন্য কিছু দিয়ে যান।
- কেন? আপনারাতো এখানে চাকরি করছেন আর সরকার আপনাদের বেতন দেয়!
- বুঝেনইতো সামান্য বেতন, বলে হে হে হে করে হাসলো।
সঙ্গে আছে সামান্য কিছু টাকা আর ডলার, বেশী টাকাতো নেবার নিয়ম নেই। আর এই টাকাও তো দরকার হতে পারে কিছু খাবার কিনতে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঝামেলা এড়াবার জন্য একশটাকা বের করে দিলাম, ভাবলাম অনেককেই তো সাহায্য করি। এটাও না হয় সাহায্য দিলাম। উনি আরও একশ চাইলেন। দিয়ে দিলাম। কাছে রইলো কিছু ডলার আর শদুয়েক টাকা।
বোর্ডিং পাশ নেবার সময় আমার ফেরত টিকেট চাইলেন।
- আমিতো ছুটিতে এসেছিলাম। আর আমি ওখানকার ৯জি ভিসা নিয়ে বাস করছি , আমার জন্য ফেরত টিকেট প্রযোজ্য নয়। এই আমার ভিসা রেজিস্ট্রেশন এছিআর কার্ড।
উনি আমার মুখের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে বিরক্ত হয়ে, তাকিয়ে বললেন,
- আপনিতো অইদেশের নাগরিক নয়, তাই যেতে হলে আপনাকে ফেরত টিকেট নিয়ে যেতে হবে।
- আমি বেশ কয়েক বছর নিয়মিত যাতায়ত করছি, কখনও ফেরত টিকেট দরকার হয়নি। আপনিকি কাইন্ডলি অন্য কারো সঙ্গে কথা বলে দেখবেন?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন পাশের টেবিলে। ফিরে এসে কথা না বলে বোর্ডিং কার্ড ইস্যু করে হাত বাড়ালেন। বোর্ডিং কার্ডে চোখ পড়তেই দেখলাম, বোর্ডিং শুরু হবে ১২.২০ মিনিটে। ভাবলাম হয়তো ভুল হয়েছে। জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, ফ্লাইট ডিলে আছে। কিন্তু কতক্ষন ডিলে জানতে পারলাম না।
এরপর ইমিগ্রেশন। ভ্রমন করতে করতে পাসপোর্টের পাতা শেষ হওয়ায় সাথে নতুন পাসপোর্ট জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও আমার নাম ঠিকানা জানতে চাইলেন। সুবোধ বালকের মত জবাব দিলাম। এবার জানতে চাইলেন কেন আমি এম আর পি পাসপোর্ট না নিয়ে হাতে লেখা পাসপোর্ট নিয়েছি। জানালাম নতুন পাসপোর্ট ম্যানিলায় নিয়েছি আর সেখানে এম আর পি শুরু হয়নি। কপাল ভালো, উনি আর কথা না বাড়িয়ে ঘচাং করে সীল বসিয়ে দিলেন।
রাত কেবল ১০টা , কত সময় বসে থাকতে হবে জানিনা। বিমানের সময়সূচী সংবলিত একটি মনিটর কে সামনে রেখে বসলাম। শুরু করলাম ফোনে কথা বলা। রাত ১২টার দিকেও মনিটরে বোর্ডিং ওপেন না দেখে একজন কে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম আরও দেরি হবে। এদিকে মোবাইলে চার্জ শেষ, কোথাও কোন প্লাগ পয়েন্ট পেলাম না। একপাশে দেখলাম একটি পানির মেশিন মুখ ধুবড়ে পড়ে আছে আর প্লাগ পয়েন্ট ফাঁকা, লাগিয়ে দিলাম চার্জার। এক জন দৌড়ে এসে জানালেন ওখানে চার্জ করা নিষেধ । পানির পিপাসা পেয়েছে। আশে পাশের পানি ফিল্টারের যা অবস্থা দেখলাম, তাতে আর সে পানি পান করা হয়ে উঠলো না। দোকানে গিয়ে কিনে নিলাম এক বোতল পানি।
এর পর যেতে হবে প্রকৃতির ডাকে। দীর্ঘদিন যাতায়ত করলেও আমাদের বিমান বন্দরের এই বিশেষ ঘরটিতে যাওয়া দরকার হয়নি। আজই প্রথম। দরজার কাছাকাছি হতেই রেল স্টেশনের প্রসাবখানার গন্ধ পেলাম। নাক বন্ধ করে কাজ শেষ করে বের হলাম। ভাবলাম বর্তমান সময়ে কোন ভদ্র বাড়ির বাথরুমেও কোন দুর্গন্ধ থাকেনা। আর এটাতো দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর!
রাত ১টার দিকেও নোটিশ বোর্ডে কোন খবর না দেখে এগিয়ে গেলাম বোর্ডিং গেটের দিকে। অনেক যাত্রী বোর্ডিং নিয়ে নিয়েছে। হাতে শুধু একটি কম্পিউটার থাকায় ঝামেলা বিহীন বোর্ডিং শেষ হল। বোর্ডিং রুমে যেতেই ফ্লাইট দেরি হবার জন্য হোটেল রূপসী বাংলার একটি নাস্তার প্যাকেট ও পানির বোতল হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল। মনে মনে বেশ খুশি হলাম। ধন্যবাদ দিয়ে একটি যায়গা খুজে বসলাম।
রাত ১.৩০। বিমানে বোর্ডিং শুরু হবে। যাত্রীরা হইহই করে উঠে দাঁড়ালো তাদের আর কোন নিয়ম মানার ধৈর্য্য নেই। সবাই যেন এক সাথে বিমানে উঠবে। বিদেশী যাত্রীদের চোখে মুখে বিব্রতার ছাপ। এঅবস্থায় কি করবে বুঝতে পারছে না বা কি হয়েছে সেটাই বোঝার চেস্টা করছে। ঠিক একই অবস্থা দেখেছিলাম বিমান থেকে নামার সময়। তখন ভেবেছিলাম দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় দেশের টানে আপনজনের টানে তাড়াহুড়ো করে নামতে চাইছে। এখন বুঝলাম আমরা এক শ্রেনীর মানুষ শৃঙ্খলাও নিয়মহীন জীবনেই অভ্যস্থ।
অনেক হই হুল্লোড় শেষে বিমানের সিটে এসে বসলাম। শরীরজুড়ে ক্লান্তি। সিটিবেল্ট বেঁধেই কম্বল্টায় মুখ ঢেকে হারিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।