বাংলার ইতিহাসে ঈদ উদযাপন বরাবরই একটি উৎসবমুখর পরিসরে সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষত, সুলতানি আমলে ঈদ ছিল এক বিস্ময়কর উত্সব, যেখানে জনসাধারণের অংশগ্রহণে গঠিত হতো ঈদ আনন্দ মিছিল। ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই মিছিল একসময় বিস্মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বুকে এই ঐতিহাসিক প্রথার পুনর্জাগরণ ঘটেছে। এই প্রথার পুনঃপ্রতিষ্ঠা কেবলমাত্র একটি ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার নয়; বরং এর অন্তর্নিহিত অর্থ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং ধর্মীয় তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এটি এক বহুমাত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতিচিত্র।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: বাংলার সুলতানদের ঈদ উৎসব
বাংলার সুলতানি আমল (১২০৪-১৫৭৬) ছিল এক স্বতন্ত্র ইসলামি সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক কৌশলের বিকাশের যুগ। দিল্লির সুলতানি প্রভাব থেকে পৃথক, বাংলা নিজের মতো করে এক ইসলামি সমাজ বিনির্মাণ করেছিল, যার অন্যতম প্রকাশ ছিল ঈদ আনন্দ মিছিল। ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, ঈদের দিন সুলতানরা দরবার খুলে দিতেন, সাধারণ জনগণের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন এবং বিশাল শোভাযাত্রার আয়োজন করতেন। বাদ্যযন্ত্র, পতাকা, সজ্জিত হাতি ও ঘোড়ার বহর এবং সৈন্যদের প্রদর্শনীসহ এই মিছিল ছিল একপ্রকার শাসনব্যবস্থার শক্তির প্রতীক। সাধারণ মানুষ এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করত, যা এই উৎসবকে একটি সর্বজনীন রূপ দান করত।
ঐতিহ্যগত ও সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জনা
ঈদ আনন্দ মিছিল বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে এক গভীর সাযুজ্য বহন করে। বাংলা বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রা যেমন এক সামাজিক সংহতির প্রতীক, ঈদ আনন্দ মিছিলও ঠিক তেমনই এক সমাবেশ, যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধন একসূত্রে গাঁথা হয়। ইতিহাসের পাতায় এটি ছিল শাসকের প্রজাদের প্রতি স্নেহ ও সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম।
বাংলার সাংস্কৃতিক বিকাশে এই মিছিলের ভূমিকা আরও গভীরতর। এটি কেবলমাত্র এক ধর্মীয় উৎসবের আনন্দ উদযাপন নয়, বরং বাঙালি মুসলমান সমাজের আত্মপরিচয় ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা প্রকাশ করে। সাম্প্রতিক সময়ে এই মিছিলের পুনরুজ্জীবন একটি সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ, যা প্রমাণ করে যে, আমাদের সমাজ ইতিহাসকে ধরে রাখতে এবং ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করতে আগ্রহী।
ধর্মীয় তাৎপর্য ও অনুশীলন
ইসলামের মৌলিক শিক্ষা অনুযায়ী ঈদ হলো আনন্দ, সংহতি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। নবী মুহাম্মদ (সা.) ঈদে খুশি প্রকাশ করতে বলেছেন, এবং এদিন উৎসব করার অনুমতি দিয়েছেন। যদিও ইসলামে সরাসরি শোভাযাত্রার উল্লেখ নেই, মুসলিম শাসকদের দ্বারা পরিচালিত উৎসবগুলোতে এমন আয়োজনের দৃষ্টান্ত রয়েছে।
বাংলাদেশে ঈদ আনন্দ মিছিলের পুনঃপ্রবর্তন এক দিক থেকে ইসলামের মানবিক, উদার ও সামাজিক দিকগুলোর প্রকাশ ঘটায়। এটি ধর্মীয় অহিংসতার প্রতিচিত্র, যা উৎসবের মাধ্যমে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বার্তা বহন করে। তবে এটি যেন অযথা জাঁকজমকপূর্ণ বা বাহুল্যপ্রিয়তায় রূপ না নেয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।
সাম্প্রতিক প্রভাব ও মূল্যায়ন
বর্তমান সময়ে এই মিছিলের পুনরুজ্জীবন সমাজের বিভিন্ন স্তরে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একদিকে, এটি বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে পুনরায় জাগ্রত করছে, যা গবেষকদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঘটনা। অন্যদিকে, কেউ কেউ এটিকে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠীগত শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে দেখছেন। এ ধরনের আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়, কারণ ধর্মীয় অনুশীলন যখন রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তখন তা সহজেই বিভাজনের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
ঈদ আনন্দ মিছিলের পুনর্জাগরণ নিছক এক ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার নয়; এটি বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনার এক নবজাগরণ। এটি একদিকে যেমন অতীতের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করছে, অন্যদিকে এটি আমাদের সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করছে। তবে এর যথাযথ পরিচালনা ও উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এটি বিভাজনের বদলে সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে থাকে। ইতিহাসকে ধারণ করা এবং তাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করাই আমাদের দায়িত্ব।
সবাইকে ঈদ মোবারক!