বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা, গণতন্ত্রের সংকট, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রেক্ষাপটে নতুন রাজনৈতিক দিগন্ত উন্মোচনের জন্য একটি সঠিক পদ্ধতির অনুসন্ধান প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে মূলত তিনটি পন্থা সামনে আসে:
১. সংসদের মাধ্যমে সংস্কার
২. গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন
৩. গণভোটের মাধ্যমে সরাসরি জনগণের মতামত গ্রহণ
এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে কোনটি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কার্যকর হবে তা বোঝার জন্য ইতিহাস ও বাস্তবতা বিচার করে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
১. সংসদীয় পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধন: সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতা
সংসদ আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি প্রচলিত প্রতিষ্ঠান। বর্তমান সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সংসদীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সংবিধান সংশোধন সম্ভব। কিন্তু এ ব্যবস্থায় সংবিধানের আমূল পরিবর্তন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষত যখন একটি পক্ষীয় সংসদ বা সংকীর্ণ রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান থাকে।
সমস্যাগুলো হলো:
সংসদ যেহেতু একটি দলীয় কাঠামোর অধীন, তাই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়।
বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতিতে অতীতে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ক্ষমতাসীন দলের সুবিধার্থে ব্যবহৃত হয়েছে (যেমন: চতুর্থ সংশোধনী, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল, ষোড়শ সংশোধনী ইত্যাদি)।
বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল একটি বৃহৎ কাঠামোগত সংস্কার চাইছে, যা শুধুমাত্র সংসদীয় সংশোধনের মাধ্যমে সম্ভব নয়।
সংসদীয় সংস্কারের উপযোগিতা:
যদি সংসদে সকল দলের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় এবং একটি ইনক্লুসিভ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তবে এটি কার্যকর হতে পারে।
তবে বর্তমান একদলীয় বা সীমিত প্রতিযোগিতামূলক সংসদীয় ব্যবস্থায় এটি বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব।
ফলাফল:
শুধুমাত্র সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মত নয়।
২. গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার: আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা
গণপরিষদের ঐতিহাসিক উদাহরণ:
ইতালি (১৯৪৬): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হয়ে গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়।
তুরস্ক (১৯২১, ১৯২৪, ১৯৬১, ১৯৮২): প্রতিটি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন সংবিধান গণপরিষদের মাধ্যমে তৈরি হয়।
চিলি (২০২১): সামরিক একনায়কতন্ত্র থেকে বেরিয়ে গণপরিষদ গঠন করে নতুন সংবিধান তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কলম্বিয়া (১৯৯১): গৃহযুদ্ধ পরবর্তী শান্তি ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তার জন্য গণপরিষদ গঠন করা হয়।
ফিলিপাইন (১৯৮৭): মার্কোস শাসনের পতনের পর নতুন সংবিধান তৈরির জন্য গণপরিষদ নির্বাচিত হয়।
গণপরিষদের প্রধান বৈশিষ্ট্য:
১. জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা: নির্বাচিত প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সংবিধানের খসড়া তৈরি হয়।
২. বিশদ আলোচনার সুযোগ: জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য বিভিন্ন মতামত সংগ্রহ করা হয়।
৩. একটি স্থায়ী ও সময়োপযোগী সংবিধান প্রণয়ন: যা রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বাংলাদেশের জন্য উপযোগিতা:
সংবিধানের কাঠামোগত সংস্কারের জন্য এটি কার্যকর হতে পারে।
তবে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি করার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে, যা বর্তমান বাস্তবতায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।
ফলাফল:
গণপরিষদ একটি ভালো পদ্ধতি, তবে তা যদি খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়, তবে তা রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।
৩. গণভোট: সবচেয়ে কার্যকর সমাধান?
গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সরাসরি মতামত নেওয়া হয় এবং এটি জনগণের সর্বোচ্চ ম্যান্ডেট বহন করে।
গণভোটের সফল উদাহরণ:
কেনিয়া (২০১০): সংবিধান সংস্কারের জন্য গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সম্মতি নেওয়া হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকা (১৯৯৬): বর্ণবাদী শাসনের পর নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান জনগণের ভোটে অনুমোদিত হয়।
ফ্রান্স (১৯৫৮): চার্লস দে গলের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার গণভোটে পাশ হয় এবং নতুন রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি হয়।
স্কটল্যান্ড (২০১৪): স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
তিউনিসিয়া (২০১৪): আরব বসন্তের পর গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণভোট:
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যদি সংবিধানের একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে, তবে তা গণভোটে উপস্থাপন করা যেতে পারে।
সকল পক্ষের একমত হওয়ার পর জনগণকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
একটি গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ গণভোট হলে জনগণের সর্বোচ্চ ম্যান্ডেট নিশ্চিত হবে।
গণভোটের সুবিধা:
১.জনগণের সরাসরি মতামত নিশ্চিত করা: একে কেউ রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট বলতে পারবে না।
২.নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের স্বীকৃতি: এটি জনগণের সম্মতিতে গৃহীত হওয়ায় ভবিষ্যতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে।
৩.দ্রুত বাস্তবায়ন: নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংসদ গঠনের চেয়ে এটি দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ:
সরকার পক্ষ গণভোটকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে পারে।
প্রচার ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সঠিক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছাতে নাও পারে।
ফলাফল:
গণভোট সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে, তবে এটি অবশ্যই স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হতে হবে।
কোন পদ্ধতি সবচেয়ে উপযুক্ত?
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় সংসদীয় পদ্ধতি তেমন কার্যকর নয়, কারণ এটি ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে থাকে। গণপরিষদ কার্যকর হতে পারে, তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া হওয়ায় রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। গণভোট সবচেয়ে গণতান্ত্রিক ও কার্যকর পদ্ধতি, তবে এটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
প্রস্তাবিত পথ:
১. জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটি সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করবে।
২. এই প্রস্তাব গণভোটে উপস্থাপন করা হবে এবং জনগণের সম্মতি নেওয়া হবে।
৩. সংবিধান পাশ হলে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নতুন সরকার গঠিত হবে।
এতে জনগণের সর্বোচ্চ ম্যান্ডেট নিশ্চিত হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে এবং একটি নতুন, গণতান্ত্রিক ও ইনক্লুসিভ রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে উঠবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:৩১