[আমার সহ ব্লগার নিবিড় এর একটা পোষ্ট Click This Link আমার এই গল্পের অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে। এই পোষ্টটি তাই নিবিড় কে উৎসর্গ করা হলো]
আমার মা সবার চেয়ে আলাদা, একদম অন্যরকম। এ কথাটা সুযোগ পেলেই আমি বলি।
ফাদার বেঞ্জামিন অবশ্য হাসেন, হাত দিয়ে আমার চুল গুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে বলেন-রাইট য়্যু আর। অল দ্য মাদারর্স আর ভেরি স্পেশাল টু দেয়ার সান। স্পেশাল শব্দটার উপর একটু জোর, চোখটা কুচকে একটু ছোট করা, কথাটা প্রতিবার বলার সময় ফাদারের সাদা দাঁতে হাসির একটা ঝিলিক দেখা যায়। পর্তুগালের লিসবন শহর থেকে আসা ফাদার বেঞ্জামিন এর ইংরেজি উচ্চারন আমার কছে মজা লাগে, এটা অন্য ফাদারদের মত নয়।
রাজেন্দ্রপুরের এই হাসপাতাল আর সাথে যুক্ত চিলড্রেন হোম, আমার একদল খেলার সাথী এই তো আমার দুনিয়া। আজ থেকে ঠিক ৮ বছর ৯মাস আগের এক ভোরবেলায় অভুক্ত, পরিশ্রান্ত, প্রচন্ড জ্বরে আর ততোধিক মৃত্যুর ভয়ে আক্রান্ত এক তরুণী এসে আশ্রয় নিয়েছিল এই হাসপাতালে। সেদিনের সেই ভীত অসহায় তরুণীটি ছিলেন আমার মা। সালটা ১৯৭১, পুরা দেশ জুড়ে মরন পণ লড়াই, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। চারদিকে লড়াইএর স্ফুলিঙ্গ, প্রতিরোধের আগুন—প্রতিক্রিয়ায় নেমে আসছে জুলুম, অত্যাচার আর নৃশংসতা।
নভেম্বরের এক পড়ন্ত বিকালের ঘটনা সেটা। শহর জুড়ে পাকবাহিনী তখন প্রায় কোনঠাসা, দিশাহারা হানাদার বাহিনী তার আস্তানা গুটিয়ে, যতদুর সম্ভব ক্ষয়ক্ষতি করে পাশের শহরের দিকে পিছু হটছে। পড়ন্ত সেই বিকালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর এক লরি এসে দাড়িয়েছিল বড় রাস্তাটার ধারে, বোঝাই লরী থেকে বন্দুকের গুতায় রাস্তায় নামানো হয়েছিল একদল ভীত সন্ত্রস্ত মানুষকে, দীর্ঘ দিনের অত্যাচার ক্লিষ্ট- এক দঙ্গল বিধ্বস্ত নারী- যন্ত্রের মতো তারা সৈন্যদের হুকুম তামিল করছিলো। তার পর তাদের সার বেধে এক লাইনে দাড় করিয়ে......
আমার মা সম্ভবত এতই দুর্বল ছিলেন যে, শরীরে গুলি লাগার আগেই উনি মাটিতে পড়ে যান, চাপা পড়েন এক গাদা মৃত লাশের নীচে। সেখান থেকে আমার মাকে এই হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে পৌছতে কে সাহায্য করেছিল, আদৌ কেউ করেছিল কিনা--এক সপ্তাহ পরে জ্ঞান ফিরে পাওয়া মা অবশ্য তা মনে করতে পারেন না। চিকিৎসা শুরু করতে গিয়ে ডাক্তাররা শুধু টের পেয়েছিলেন, আমার মা প্রায় আট সপ্তাহের গর্ভবতী...... বিস্মিত ডাক্তাররা আবিস্কার করেন--মা’এর প্রায় মুমুর্ষ অবস্থা, শারিরীক প্রতিরোধের শেষ সীমায়, অথচ গর্ভস্থ শিশুটি রীতিমত সুস্থ এবং সবল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আমার মা প্রতি মুহুর্তে মরে যেতে চাইতেন, না ওষুধ- না পথ্য। সব বিষয়ে ডাক্তারদের সাথে চুড়ান্ত অসহযোগিতা- ইচ্ছামৃত্যুর এক নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা।
অথচ আমি বেড়ে উঠছিলাম পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য আর পুষ্টির সাথে-- মার শরীরকে শুষে নিয়ে। লড়ছিলাম আমিও- আমার মাতৃজঠরের হক্ক আদায় করতে, আমাকে শেষ করে দেবার আমার মায়ের যাবতীয় তৎপরতার বিরুদ্ধে। আমি চিৎকার করে মাকে বলতাম--চারিদিকে এত রক্ত, এত হত্যা, আমার ভয় করে মাগো। তোমরা সব কিছুকে ধ্বংস করে দেওয়ার নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছো। তবুও দেখ-এরপরেও আমি জীবন হয়ে বেঁচে থাকতে চাই, আমি জন্ম নিতে চাই......। তোমার প্রিয়জনের হত্যা, তোমার নারীত্বের অপমান, তোমার শারিরীক লাঞ্ছনার পরেও আমি ভুমিষ্ঠ হতে চাই- বেচে থাকতে চাই তোমার সন্তান হিসাবে......
আমাকে শারিরীক অবয়ব আর কাঠামোর মাঝে প্রতিস্থাপিত করো মা, তোমার প্রতি যাবতীয় অমানবিকতার বদলা যাতে নিতে পারি।
বিস্তর রক্তপাত, কাটাছেঁড়া, ক্ষত চিহ্ন আর অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে আমার জন্ম হলো, দিনটা ছিল মে মাসের ১৮ তারিখ, ১৯৭২ সাল... পুনরাবৃত্তি হলো যেন কয়েক মাস আগে ডিসেম্বরের ১৬তারিখে যেভাবে পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ-- বিস্তর রক্তপাত, কাটাছেঁড়া, ক্ষত চিহ্ন আর অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে......
জন্মের পরে আমার মুখের দিকে মা কখনও তাকান নি। আমাকে কখনও ছুঁয়েও দেখেন নি, আমি কেদে উঠলে সে আওয়াজে তার মনে কোন ভাবান্তর তৈরি হত না... আমি অবশ্য এ জন্য কিছু মনে করিনি- নার্সদের কোলে কোলেই বেড়ে উঠছিলাম, হাসিখুশি এক শিশু হিসাবে।
ততদিনে দেশের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসছিল-স্বাভাবিক জীবন যাত্রার প্রস্তুতি- নতুন ভাবে সবকিছু গড়ার উদ্যোগ শুরু হচ্ছিল। কারন জীবনের দাবীই হলো সামনে এগিয়ে চলা, থেমে থাকা নয়। একদিন আমার মায়ের পরিবারের লোক জনও এসে হাজির হলো, মাকে বাড়ী ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে। আমি রয়ে গেলাম ফাদার বেঞ্জামিনের হেফাজতে।
বেশ কয়েক বছর পার হয়ে গেছে- আমি স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি- বেড়ে উঠছি সেই হোমের চার দেয়ালের মাঝে-আমার অন্যান্য খেলার সাথীদের মাঝে-ফাদার বেঞ্জামিনের তত্ত্বাবধানে।
এর মধ্যে আবার দেখা হয়ে গেলো আমার মায়ের সাথে। সেদিনটার কথা আমার বেশ মনে আছে-- আমাদের হাউস মাদার আমাকে সকাল সকাল গোসল করিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছিল, সবাই জানতো আমার জন্য এটা একটা বিশেষ দিন। সেদিন সকাল থেকেই আমার খেলার সাথীদের সবার মাঝে চাঞ্চল্য, ঈর্ষা কাতর দৃষ্টিতে আমাকে দেখছি্ল সবাই। দুপুরের দিকে আমার ডাক পড়ল ফাদার বেঞ্জামিনের রুমে।
ফাদারের রুমের বিশাল টেবিলটার এক কোনে মা বসে ছিলেন। পরণে হালকা রঙ্গের শাড়ী, হাত দুইটা মুঠো করে টেবিলে রাখা। চোখে মুখে এক ধরনের বিহবলতা। আমার চিনতে একটুও কষ্ট হয়নি। যদিও এতদিন দেয়ালের ছবিতে, বইয়ের পৃষ্ঠায় যে সব মায়েদের ছবি দেখেছি, আমার মা দেখতে একটুও তাদের মতো নয়। আমি শুধু মিলিয়ে দেখতে চাইছিলাম দ্য ভিঞ্চির ম্যডোনার সাথে আমার মায়ের মিল কতটুকু, বইয়ের পৃষ্ঠায় যে পেইন্টিংস এর সাথে আমি দিনের পর দিন কথামালা বুনে গিয়েছি—পড়ার অবসরে, গ্রীস্মের একলা দুপুরে কিংবা ঘুম আসতে না চাওয়া কোন কোন তীব্র পূর্ণিমার রাতে।
আমাকে দেখে মা উঠে এসে আমার হাত ধরলেন, তারপর মাটিতে হাটু গেড়ে বসে আমাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন। এক নীরব যন্ত্রনা মাখা কান্নায় তার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। বড়রা কেন যে বোঝে না- কান্না জিনিষটা এত ছোঁয়াছে। মনটা এত স্যাঁতসেতে করে দেয়। আমি আজ কিছুতেই কাঁদতে চাইনা যে।
দিনের পর দিন আমি কি এই দিনটার অপেক্ষায় থাকিনি? কবে আমি ফিরে যাবো আমার মায়ের কাছে- আমার ছোট্ট হাতে তার আঙ্গুল চেপে ধরে হাঁটব পৃথিবীর রাস্তায়! আনাচে কানাচে সহ চিনে নিবো দুনিয়ার সব ঘোর প্যাঁচ।
আমাকে দীক্ষা দাও মা, যাতে করে হতে পারি পিতৃ হন্তারক।