আমার স্মৃতিতে নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধ (২য় পর্ব)
২৭ মার্চ ১৯৭১ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। একজন বাঙালী সামরিক অফিসারের কন্ঠ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা তখনকার সময় স্বাধীনতার সংগ্রামে আমাদেরকে উজ্জীবিত করেছিল।
নোয়াখালীতে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। প্রথমে ফেনীতে পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ যুদ্ধ হলো। মাইজদী থেকে আমরা শত শত ছাত্র-জনতা ফেনীতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছিলাম।
২৬ মার্চ থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত নোয়াখালী জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সংবাদপত্র বিহীন নোয়াখালীতে পৌরসভার সাইক্লোষ্টাইল মেসিন দিয়ে আমরা গোপনে “বুলেটিন” ছাপিয়ে খবর প্রচার করতাম। পশ্চিম মাইজদীর চক্রবর্ত্তী বাড়ীতে ছিল আমাদের “বুলেটিন” ছাপানোর গোপন স্থান। সেজন্য রাজাকার বাহিনী অভয় চক্রবর্ত্তীকে ধরে সেনাবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিলে তাঁকে নৃশংসভাবে চৌমুহনী টেকনিক্যাল স্কুলে এনে হত্যা করে।
২৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাক হানাদার বাহিনী লাকসাম থেকে সড়ক পথে নোয়াখালীতে প্রবেশ করে। আমরা একদল যুবক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের ত্রিপুরা চলে যাই। আগরতলায় ফ্রাষ্টম হোস্টেল নামক ক্যাম্পে ন্যাপ (মোঃ) ছাত্র ইউনিয়ন কমিউনিষ্ট পার্টির যৌথ উদ্যোগে যৌথ গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ সংগঠিত করার কাজ চলে। আমরা কমান্ডে প্রথমেই ২৪ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে আমি আগরতলা থেকে আসামের তেজপুরে প্রশিক্ষণে চলে যাই। প্রশিক্ষণ শেষে আমি ২৪ জনের ১০২ নং গেরিলা গ্রুপ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। এবং গেরিলা রিক্রুট করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দিতে থাকি। তৎকালীন নোয়াখালী সদর মহকুমা বর্তমান নোয়াখালী লক্ষীপুর জেলার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আমি যৌথ গেরিলা বাহিনী পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার বাহিনীর মোট ১০ জন গেরিলা শহীদ হয়েছেন। ১১ নভেম্বর বেতিয়ারায় শহীদ হন ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা।
১ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমি চাটখিলের দৌলতপুর থেকে ৮০ জনের গেরিলা বাহিনী সোমপাড়ায় আবদুল্যার বাড়ীতে যাত্রা বিরতি করে ভোর রাতে মান্দারী শত্রুক্যাম্পে এককভাবে আক্রমণ চালাই এবং যুদ্ধ করে মান্দারী মুক্ত করি।
৩ ডিসেম্বর মান্দারী বাজারের চতুর্দিক ঘেরাও করে মান্দারী হাই স্কুল মাঠে এক বিরাট সমাবেশ করি। ১ ডিসেম্বর মান্দারী মুক্ত করে আমরা যখন দত্তপাড়া হাই স্কুল মাঠে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম তখন ঐ এলাকার ৬ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল সাহাবুদ্দিনের কমান্ডে মান্দারী অভিমুখে যাওয়ার সময় পাক মিলিশিয়া বাহিনীর গুলিতে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় লাভ করলাম। ৩ জানুয়ারী ১৯৭২ নোয়াখালী কোর্ট বিল্ডিং এর সম্মুখে পেন্ডেল তৈরি করে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রশাসনের নিকট আমাদের যৌথ গেরিলা বাহিনীর অস্ত্র জমা দিয়েছি। ঐদিন অস্ত্র জমা দেয়ার সময় ততকালীন জেলা প্রশাসক জে. এল. দাসের অনুরোধে কোর্ট বিল্ডিং এ উপস্থিত থাকা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আমাদের অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত ছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং ভারত থেকে পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের যৌথ গেরিলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃহত্তর নোয়াখালীতে ৪৫০ জনে উন্নিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ভিয়েতনামের কলাকৌশলে আমাদের গেরিলা বাহিনী মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিল।
৯ মাস সশস্ত্র লড়াইয়ের পর ৭ ডিসেম্বর বীর বেশে যুদ্ধ করতে করতে মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালী শহর মুক্ত করলেন। মাইজদী ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে ক্যাম্প স্থাপন করলেন কমান্ডার মোশারফ হোসেন। মাইজদী পি.টি.আইতে স্থাপিত হয়েছিল আমার কমান্ডের ন্যাপ কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ক্যাম্প। আমাদের আরেকটি ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল চৌমুহনী বিসিক বিল্ডিং এ। পি.টি.আই গেইটে “মুক্ত নোয়াখালী” নামে যে সৌধটি দাঁড়িয়ে আছে এটি ৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত হওয়ার স্বাক্ষর বহন করে। নোয়াখালী মুক্ত দিবস হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ প্রজন্মের প্রেরণার উৎস।
(শেষ)
► লেখক: অ্যাডভোকেট সারওয়ার-ই-দীন
মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবি, নোয়াখালী।
► নোয়াখালী জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত স্মারক স্বাধীনতা ২০০৩ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশকালঃ মার্চ ২০০৩।