বাইরে পুলিশের সাইরেন শোনা যাচ্ছে। সময় শেষ হয়ে আসছে। আর দেরী করা সম্ভব নয়। যা করার খুব দ্রত করতে হবে। চোখে সীমাহীন ভয় আর আতংক নিয়ে রক্ত মাখা ছুরি হাতে দাড়িয়ে আছে মামুন। অজানা ভয়ে কেপে উঠল আমার মন। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল কোমরে লুকানো ডেজার্ট ঈগল এর দিকে। দামী এই বিদেশী পিস্তলটা আমি উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম দাদা ভাইয়ের কাছে। দাদা ভাই, গড ফাদার দাদা ভাই। যে ছিল আমার মত হাজার তরুনের স্বপ্ন ছিনতাই করে সন্ত্রাসী বানানোর কারিগর। রহস্যময় ব্যাক্তি এই দাদা ভাই। যখন যে দল ক্ষমতায়, তার সাথে মিশে যায়। দাদা ভাইয়ের অস্ত্রের ক্ষমতা কাজে লাগতে সব দলই সমান আগ্রহী। দাদা ভাই তাই সব সময়ই আইন-আদালতের ধরা ছোয়ার বাইরে। প্রথম থেকেই যার চোখ পরেছিল মামুনের উপর। অনেক চেষ্টা করে মামুনকে দুড়ে রেখেছিলাম তার শ্যোন দৃষ্টি থেকে। আর মনে হয় সম্ভব নয়। সব শেষ হয়ে গেল। একরাশ ঘৃণা নিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম ডেজার্ট ঈগলের দিকে।
আমি সুলতান। কুখ্যাত সন্ত্রাসী সুলতান। পুলিশের তালিকা ভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। কিন্তু পুলিশের চোখে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে পুলিশের সামনে দিয়েই ঘুরে বেড়াই। আমার পিছনে আছে দাদা ভাইয়ের মত গড ফাদার। আমার ভয় কিসের? কিন্তু আমি তো এমন জীবন চাই নি। বস্তির আর দশটা ছেলের সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়াতাম। কখোনো বাসের হেল্পার হতাম আবার কখোনো হয়ে যেতাম পত্রিকার হকার। টাকার বিনিময়ে অংশ নিতাম মিটিং মিছিলে। হরতাল হলেই হত বাড়তি ইনকাম। অতিরিক্ত দুঃসাহসী ছিলাম। তাই পিকেটিং কিম্বা ককটেল ছোড়ায় আমি ছিলাম অদ্বিতীয়।
আমি কি করে ভুলব সেই দিনের কথা? পিকেটিং শেষে বাড়তি কিছু টাকা হাতে পেয়ে বসে গেলাম জুয়ার আসরে। প্রথমে কয়েক দান জেতার পরেই হাড়তে শুরু করলাম। প্রথম কয়েক দান আমাকে টোপ গেলানোর জন্য তারা ইচ্ছা করে হেড়েছে বুঝতে পারি নি। অল্প সময়ের মধ্যেই সব হাড়িয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। খালি হাতে বাড়ি ফেরার কথা ভাবতেই ভয়ে শিউরে উঠল আমার সারা গা। বাবা আমাকে আস্ত রাখবে না। কি করব ভেবে পাচ্ছি না। এমন সময় সবুজ প্রস্তাব দিল। বলল তাদের সাথে গেলে আমার লাভ হবে। কি কাজ জানতে চাইলে সবুজ বলল, “ছিনতাই”। আমি চমকে উঠলাম। কিন্তু সবুজ নির্বিকার। যেন কিছুই নয়, ছিনতাই অতি সাধারণ একটা কাজ। প্রথমে রাজি ছিলাম না। কিন্তু বাবার রুদ্র মূর্তি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই রাজি হয়ে গেলাম। সবুজ আমার হাতে ৩ ইঞ্চি ফলার একটা ধারালো ছুরি ধরিয়ে দিল। আমার কাজ অতি সামান্য। ছুরিটা দেখিয়ে ছিনতাইয়ের স্বীকার লোকটিকে ভয় দেখানো। বাকি কাজ সবুজ ও তার অন্যান্য বন্ধুরা মিলে করবে। কিন্তু হায়! সবাই যে ভাবে ভাবে সবকিছু কি সেভাবে হয়? আমরা ভুল জায়গা বেছে নিয়েছিলাম। ছিনতাইয়ের আশায় যেখানে লোকটির পথ রোধ করে দাড়িয়ে ছিলাম তার পাশেই ছিল টহল পুলিশ। আমাদের হুমকি ধামকি কোন কাজেই এল না। আমাদের শিকার ছুরি দেখে “বাঁচাও, ছিনতাইকারী...... পুলিশ ........ পুলিশ ....” বলে চিৎকার শুরু করল। অভিজ্ঞ সবুজ আর তার বন্ধুরা মুহুর্তেই গা ঢাকা দিল।
আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। লোকটা সেই সুযোগে জাপটে ধরল আমায়। বাশি বাজাতে বাজাতে ছুটে আসছে পুলিশ। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি লোকটার হাত থেকে ছাড়া পেতে। ধস্তধস্তিতে ডান হাত ছাড়াতে পেরেছি। আর উপায় নেই। বাধ্য হয়েই ছুরি চালালাম লোকটার পাজোর বরাবর। আলগা হয়ে গেল আমার বাধন। আমার পালানো উচিৎ। কিন্তু পালাতে পারছি না। চোখে সীমাহীন ভয় আর আতংক নিয়ে রক্তাক্ত ছুরি হাতে দাড়িয়ে আছি আমি। যেমনটা আজ মামুন দাড়িয়ে আছে আমার সামনে।
খুনের অপরাধে ফাসি হয়নি আমার। কিশোর বলে ফাসির সাজা থেকে মাফ পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বেঁচে থেকে যে শাস্তি পেলাম সেটা ফাসির চেয়েও কোন অংশে কম নয়। আমি জেল খাটা কয়দী। খুন করে জেলে গিয়েছিলাম। আমার মানুষ পরিচয়ের চেয়ে এই পরিচয়টাই সবার কাছে বড় হয়ে দেখা দিল। জন্মদাতা পিতাও আমাকে ঠাই দিতে অস্বীকৃতি জানাল। কোথাও কোন কাজ মেলেনা। মেলেনা মাথা গোজার ঠাই। এমনই এক দিন দেখা হল সবুজের সাথে আবার। আবারও প্রস্তাব দিল সবুজ। না, এবার ছিনতাইয়ের নয়। এবার তার সঙ্গী হবার। চাঁদাবাজি আন খুন খারাপিতে তার সাথে থাকার। নিরুপায় আমি সবুজের সঙ্গী হলাম। ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লাম দাদা ভাইয়ের সম্রাজ্যে।
না, কোন সিনেমার কাহিনী নয়। এটা আমার জীবন কাহিনী। বাস্তব এবং সত্য। যেটা আমি অস্বীকার করতে পারি না। কোন এক সময় রাস্তায় পিকেটিং করা সুলতান এখন কোমরে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে কিম্বা মিটিং মিছিলে গোলমাল হলেই ডাক পরে আমাদের। মুখে রুমাল বেধে গুলি চালাই। যত লাশ পরে রাজনীতির মাঠ ততই গরম হয়। আজ যে দলের হয়ে অস্ত্র ধরি পরের দিন তাদের বিপক্ষেই গুলি চালাই। মুখে রুমাল বাধা। কে চিনবে আমাদের? কে বুঝবে আমরা কোন দলের? আমরা কোন দলের নই। দাদা ভাইয়ের নির্দেশে অস্ত্র চালাই। যে সে অস্ত্র নয়। বিদেশী অস্ত্র। ঢাকা ভার্সিটির হলে থাকা অবস্থায় এক ভাই দেখে বলেছিল ডেজার্ট ঈগল নাম। ইসরায়েলে তৈরি। দাদা ভাইয়ের উপহার। যে উপহারটার প্রতি মামুনের অনেক লোভ ছিল। মাঝে মাঝেই ছুয়ে দেখত। আমি নিষেধ করতাম, ও শুনত না।
মামুন, আমার মামুন। আমার কলিজার টুকরা। ভাই নয় তবুও যাকে ভাইয়ের চেয়েও বেশি ভালবাসি আমি। একটা কুখ্যাত সন্ত্রসীর বুকেও যে মায়া মমতা লুকিয়ে থাকতে পারে, মামুনকে পেয়েই সেটা বুঝেছি। দাদা ভাইয়ের নির্দেশ মত খুন করে লাশ গুম করতে গিয়ে মামুনের সাথে প্রথম দেখা। লাশটা বস্তায় ভরে ইট বেধে রামপুরা ঝিলে ডুবিয়ে দিয়ে ফিরছি। এমন সময় সবুজ প্রথম দেখে মামুনকে। ময়লা ফেলার ডাস্টবিনের পাশে লুকিয়ে আছে দশ এগার বছরের একটা ছেলে। আমাদের দেখেই দৌড়ে পালাতে গেল সে। চিলের মত ছো মেরে সবুজ ধরে ফেলল তাকে। খুনের সাক্ষী বাচিয়ে রাখতে নেই। আমি তাকালাম ছেলেটার মুখের দিকে। মায়া কাড়া চোখ দুটো কি যেন বলছে। অনেক বলে কয়ে সবুজের হাত থেকে রক্ষা করলাম তাকে।
মামুন, ছোট্ট মামুন। আমার ভাই। হৃদয়ের সবটুক ভালবাসা উজার করে দিলাম তাকে। আমার মত তারও সবাই থেকেও নেই। বাবা মায়ের সাথে ঢাকায় বেড়াতে এসে হাড়িয়ে গেছে ৫ বছর আগে। বাবা মা কারো কথাই মনে করতে পারে না সে। আমার নিঃস্বঙ্গ জীবনে সেই হয়ে উঠল বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। পিকেটিং এর কাজে মামুন ছিল খুবই দক্ষ। কেন জানি নিজের ছায়া খুজে পেলাম মামুনের মাঝে। জোড় করে তাকে সরিয়ে রাখলাম পিকেটিং কিম্বা মিটিং মিছিল থেকে। মিছিলে ভাড়া খাটানোর কারনে ঝগড়া হয়ে গেল এক সময়ের বন্ধু সবুজের সাথে। এর মাঝেই কেটে গেল আরো ৫টি বছর। আমার অজান্তে সবুজের প্ররোচনায় মামুন যোগ দিল দাদা ভাইয়ের বাহিনীতে। আমি কিছুই জানি না। মামুন দাদা ভাইয়ের প্রশিক্ষন সেন্টার থেকে পিস্তল চালানো শিখল। মাঝে মাঝেই দেখতাম আমার ডেজার্ট ঈগল হাতে নিয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সন্দেহ হল আমার। জেরার মুখে সব স্বীকার করল সে। শুনে আমার বুকটা ফেটে গেল। কড়া পাহারায় রাখতে শুরু করলাম আমি। সবুজের ধারে কাছে যেতে দেই না। যেতে দেই না দাদা ভাইয়ের ধারে কাছে।
মামুন, আমার ছোট্ট ভাই। বড় হয়ে গেছে। ভালবাসে বস্তিরই একটা মেয়েকে। মেয়েটাও ভালবাসে মামুন কে। বিয়ে করতে চায়। আমার অমত ছিল না। তাই বাধা হয়ে দাড়াইনি তাদের ভালবাসায়। কিন্তু আজ আমি কি শুনলাম? শরীর ভাল ছিল না বলে সন্ধার সময়ই চাদর মুরি দিয়ে শুয়ে ছিলাম। সবুজ এসে জোড় করে টেনে তুলল। বলল, মামুন যে মেয়েটাকে ভালবাসে সেই মেয়েটার নাকি অন্য আরো ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। মেয়েটা তার অন্য আর এক প্রেমিকের সাথে নির্জনে দেখা করতে গেছে। মামুন সেটা জেনে গেছে। একটু আগে সবুজ মামুনকে সেদিকেই যেতে দেখেছে। আমার মনের মাঝে কু ডাক ডেকে উঠল। দেরী না করে ছুটলাম সেদিকে। পিছন ফিরে তাকালে হয়ত সবুজের কুটিল হাসিটা দেখতে পেতাম।
ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলো এসে পরেছে সবুজের মুখের উপর। হাতে ধরা ছুরির ফলা বেয়ে টপটপ করে পড়ছে তাজা রক্ত। পাশেই প্রাণহীন এক জোড়া যুবক যুবতীর লাশ। আজ থেকে ২০ বছর পূর্বে এমনই এক রক্তাক্ত লাশের পাশে দাড়িয়ে ছিলাম আমি। সেদিনের মত আজও ছুটে আসছে পুলিশ। কে খবর দিয়েছে কে জানে? কিছুক্ষনের মধ্যেই হাজির হবে তারা। গ্রেপ্তার করবে মামুন নামের ভয়াবহ এক খুনিকে। যাকে আমি নতুন জীবন দেবার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। পুলিশের হাতে বন্দি মামুনের ফাসি হবে। নয়ত জেল থেকে বের হবে আর এক নতুন সুলতান হিসেবে। এ হতে পারে না। আমার মামুন, ছোট্ট মামুন। সুলতানের জীবনে অনেক কষ্ট। সুলতান হিসেবে বেঁচে থাকার এই কষ্ট সে সহ্য করতে পারবে না। মামুন পারলেও আমি পারব না। একরাশ ঘৃণা নিয়ে আমি তাকিয়ে আছি ডেজার্ট ঈগলের দিকে। দাদা ভাইয়ের দেয়া উপহার। হয়ত মামুনের স্বপ্ন। আমার হাতটা কাপছে। কম্পিত হাতেই তাক করলাম মামুনের দিকে। পুলিসের গাড়ি ব্রেক করার শব্দ শুনলাম। এসে পরেছে পুলিশ। আর দেরী করা যায় না। চোখের পানিতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। আমার মামুন, ভালবাসার ছোট্ট মামুন। তাকে আমি সুলতান হতে দিতে পারি না।