সবুজ এর বয়সী প্রতিটি ছেলে নতুন জামা পড়ে বাবার হাত ধরে ঈদের নামাজ পড়তে ঈদগাহ যাচ্ছে। শুধু সবুজেরই যাওয়া হচ্ছে না। তার কোন নতুন জামা নেই। নতুন জামা নেই, কথাটা ঠিক না। ছিল একটা জামা। বাবা ঈদের দিন পড়ার জন্য সবুজের পছন্দের লাল রংয়ের একটা জামা কিনে দিয়েছিল। খুশিতে আত্মহাড়া সবুজ ঘুম থেকে উঠেই জামাটা গায়ে দিয়েছে। বাবা-মা কে সালাম করেছে। তারপর গ্রামে ঘুরতে বের হয়েছে। নতুন জামা পড়ার আনন্দে সে খাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল। বেলা বাড়তেই ক্ষিদেটা জানান দিল। উপায় না দেখে বাড়ি ফিরে এসছিল সে। ৮ বছরের সবুজের পক্ষে বাড়ির আবহাওয়া টের পাওয়া কঠিনই ছিল। মা উঠানে বসে কাঁদছে। বাবার কোন দেখা নাই। সবুজ মাঝে মাঝেই মা কে কান্না করতে দেখে। তাই মায়ের কান্না সে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিল। মায়ের সামনে দাড়িয়ে বলেছিল, ”মা, খিদা লাগছে। ভাত দে”
পরের ঘটনা সবুজ স্বপ্নেও কোন দিন ভাবেনি। মা কোন কথা না বলে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিয়েছিল সবুজের গালে। তারপর একটানে গা থেকে নতুন জামাটা খুলে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল সবুজের ছলছল চোখের সামনেই। এত দ্রুত সবকিছু ঘটেছিল যে, সবুজ কিছু বুঝে উঠতে পারে নাই। যখন বুঝল তখন তার প্রিয় জামা আগুনে পুড়ছে।
সবুজের বাবা রহিম মিঞা, কুখ্যাত চোর। গ্রামের সবার মতে চুরি বিদ্যাকে সে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তাই কখোনো ধরা পরে না। বছর খানেক আগের কথা। সবুজের মায়ের কান্নাকাটি আর সবুজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে মওলানা সাহেবের কাছে গিয়ে তওবা করে “আর কোনদিন চুরি করবে না।“ তারপর শহরে গিয়ে কাজ নেয়। কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছে। এবার ঈদে তাই পরিশ্রমের টাকা দিয়ে ভাল দেখে একটা শার্ট কিনে দিয়েছিল। সার্টটা শুধূ ভাল নয়। বেশ ভাল। তার মত গরীবের জন্য অনেক টাকা দাম । ঈদের দিন সবুজ যখন নতুন জামাটা পড়ে খেলতে গেল, নিজের অজন্তেই চোখে পানি চলে এসেছিল রহিম মিঞার। কি সুন্দর দেখাচ্ছে তার ছেলেকে। সবুজের মা ঈদ উপলক্ষ্যে সেমাই রান্না করছিল। পাশে গিয়ে বসে বলেছিল, “দেখছ, তোমার পোলারে তো রাইজপুত্তুরের মতন দেহা যাচ্ছে।” খুশিতে সবুজের মায়ের চোখও চিকচিক করে উঠেছিল। বলেছিল, ”যাও, ডুব (গোছল) দিয়া আস। খায়া নামাজ পড়তে যাও।” রহিম মিঞা খুশি খুশি ভাব নিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলেছিল, ”আর এটু পরে যাবনে। ভালই তো আছি।” কিন্তু তার এই ভাল থাকা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নাই। চেয়ারম্যান বাড়ির দুইজন কামলা চেচাতে চেচাতে তার বাড়িতে ঢুকে তাকে মারতে মারতে চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে নিয়ে গেল।
তার অপরাধ!!!!! চেয়ারম্যানের নাতী-নাতনীর জন্য চেয়ারম্যান জামা কাপড় কিনে দিয়েছিল। সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। চেয়ারম্যানের নাতী তার জন্য কেনা সেই সার্টটাটাই পড়ার জন্য বায়না ধরেছে। ঈদের জন্য তাকে কিনে দেয়া অন্য সার্টগুলো সে পড়বে না। কিছুক্ষণ আগে সবুজকে সেই সার্ট পড়ে ঘুরতে দেখা গেছে।
চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে দিয়েই গ্রামের প্রধান রাস্তা। সেই রাস্তার পাশে বড় আম গাছটায় রহিম মিঞাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা গেল। নাক ফেটে রক্ত আসছে। সারা শরীরেও মারের দাগ। রাস্তা দিয়ে সারী সারী লোক ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছে। ঝুলন্ত রহিম মিয়াকে দেখে সবাই বলতে লাগল, ”আবার চুরি করছস!! তুই ভাল হবি না?”
চেয়ারম্যান আজমত খান বারান্দায় বসে তামাক টানছে। তামাকের প্রচলন চলে গেলেও তার খুবই পছন্দের কাজ তামাক টানা। আরাম কেদারায় বসে তামাক টানার মজাই আলাদা। নিজেকে জমিদার জমিদার মনে হয়। তবে আজ এই মুহুর্তে তামাক টেনে মজা পাচ্ছেন না। বারান্দা থেকে আম গাছটা দেখা যাচ্ছে। রহিম মিঞা নিথর হয়ে ঝুলছে। বড় ধরনের ভুল হয়ে গেছে তার। সব কিছুই পাওয়া গেছে। রহিম মিঞা চুরি করে নাই। ভাল ভাবে না খুজে, সবুজের গায়ে একই সার্ট দেখেই তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী কয়েক ঘন্টা চোরকে ধরা আর শাস্তি দেয়া নিয়ে সবাই এত ব্যস্ত ছিল যে খুজে দেখার সময়ও হয় নাই। কিছুক্ষণ আগে সব জামা কাপড়ই পাওয়া গেছে। চেয়ারম্যান আজমত খান তার এক কামলাকে ডেকে নির্দেশ দিলেন। তাকে একটুও অনুতপ্ত মনে হল না।
নদীর পাড়ে সবুজ মন খারাপ করে বসে আছে। দুই চোখে অশ্রু। হটাৎ বাবার কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল সে। রহিম মিঞা ছেলেকে বললেন, ”এখানে বসে আছিস বাপ। ভাত খাবি নে?” সবুজ ঘার ফিরিয়ে বাবাকে দেখল। বাবার চোখে পানি। সবুজ দৌড়ে বাবার বুকে মুখ লুকাল। অভিমানী সবুজ জানতে চাইল, ”বাজান, ওরা তোমারে ছাইড়া দিল?” রহিম মিঞা চোখ মুছতে মুছতে বলল, “ছাড়ব না কেন রে বাপ? আমি কি চুরি করছি?”
”তাইলে ওরা তোমারে মারল কেন?” জানতে চাইল সবুজ। রহিম মিঞা কষ্ট হাসি হাসল। সবুজ অভিমানী স্বরে বলল, ”বাজান, মা আমার জামা পোড়ায়া দিছে”। রহিম মিঞার চোখে আবারও পানি চলে এল। চোখ মুছে বলল, “চোরের পোলার দামী জামা পড়া লাগে না রে বাপ”। সবুজের জেরা তবুও শেষ হয় না। বলে, ”বাজান, চোর বড় অপরাধী না ডাকাইত?” রহিম মিঞা অবাক হয়ে জানতে চাইল, “কেন রে বাপ?” সবুজ চোখ মুছতে মুছতে বলল, ”তুমি চুরি করছ মনে কইরা তোমারে শাস্তি দিল। কিন্তু যারা ঈদের দিন আমগরে ঈদের খুশি ডাকাতি করল, তাগোরে কোন শাস্তি হইব না?”