বছরখানেক আগের ভ্রমন যদিও আমার মনে হয় এইতো সেদিনের কাহিনি। ভার্সিটি লাইফের শেষ বছর, ফাইনালের আগে বহুত প্রতীক্ষা, বাধা-বিপত্তির পরে ঠিক হলো যাওয়া। শুধু মেয়ে বলেই হয়ত ঝামেলাটা বেশী হয়েছে। প্রথমে সবাই যাবে শেষে দেখা যায় এ যাবে ত সে যাবে না, অমুকের বাসা থেকে যেতে দেবেনা, তমুকের স্বামী নিষেধ করেছে, কত্ত ফ্যাকরা ! ক্যান্সেল হতে হতে শেষ মুহুর্তে নির্ধারিত টাকার বেশী দিয়ে যাওয়া কনফার্ম করতে হয় আমাদের। বান্ধবী শিল্পা ত্যাড়া ব্যাকা মেয়েদের এবং তাদের অভিভাবকদের রাজী করাতে যে পরিশ্রম করেছে তা আর বলার নয়! সব কষ্ট স্বার্থক। বান্দরবান-কক্সবাজার ট্যুর। পরিবার ছেড়ে জীবনের প্রথমবার এত দূর, বান্ধবীদের সাথেও প্রথমবার। কথা ছিল আমাদের ৯জনের গ্যাং এর ৭জন যাবে, কিন্তু শেষমুহুর্তে ১জন যায়নি। তবে ৬জনেও মজা কম হয়নি।
১৪ অক্টোবর রাত ১০টার পরে গাড়ী ছাড়ল কলেজের গেট থেকে। বাসের মধ্যে সেই লেভেলের নাচাগানা শুরু হল। বসে বসে উপভোগ করলাম। কিছু সময় পরে দেখি আমাদের বাসের সাউন্ড সিস্টেম নস্ট!। মাস্টার্সের আপুদের বাসের হৈ হৈ দেখেতো আমাদের মেয়েদের মন সেই লেভেলের খারাপ। কিছুক্ষন মুন্ডুপাত করে নষ্ট সাউন্ড সিস্টেমকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে এবার শুরু হল একেক জনের মোবাইলের গান বাজিয়ে নাচ।
রাত গভীর হলে আস্তে আস্তে মেয়েদের এনার্জি কমতে থাকে এর মাঝে টের পেলাম আমার গলার স্বর বসে গেছে ঠান্ডায়। আমার গলা একবার বসে গেলে ২ দিনের মাঝে গলা দিয়ে আর কোন শব্দ বের হবে না। ট্যুরে আমাকে বোবা সেজে থাকতে হবে ভেবে আতংকিত হয়ে পড়লাম। আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম আর যাই হোক স্বরটা একেবারে বন্ধ যাতে না হয়। কুমিল্লা হোটেলে নেমে ২কাপ চা খেলাম আগে। পরদিন সকালেও নাস্তার সময় পঁচা কাপ দেখেও নাকমুখ বুজে চা খেলাম এই গলার জন্যে!
যাইহোক কুমিল্লা যে শুরু হয়েছে ত হয়েছেই শেষ আর হয় না! আমি শেষমেষ বলেই ফেললাম বাংলাদেশের অর্ধেক জুড়ে কী কুমিল্লা!
মেয়েদের এনার্জি একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে। কেউ ঝিমায়, কেউ ঘুমায় আর আমার মতন ২/১টা জানলা দিয়ে কোন বাজার, কোন হাটে এলাম তা পড়ে পড়ে ঘোষনা দেয়। কুমিল্লা শেষ হলে এবার শুরু হল চিটাগং! ওরে মারে মাআআআ এদেখি আরেক কাঠি বাড়া! এবার বললাম বাংলাদেশের অর্ধের কুমিল্লা আর বাকী অর্ধেক চিটাগং! কী আর করা এবারো কোন বাজার, কোন এলাকায় এলাম তা দেখছি আর ঘোষনা দিচ্ছি। এমন সময় এলো 'পাদুয়া বাজার' হাসতে হাসতে শেষ! পরে দেখি ওটা আসলে 'পদুয়া বাজার'
এই সেই করে করে অবশেষে পৌছালাম বান্দরবান। শুরু হল আসল ট্যুর। হোটেলে নেমে ফ্রেশ হয়ে নাকে মুখে খেয়ে নেমে এলাম নীলগিরি যাওয়ার জন্যে। এই যে শুরু হল আরেক জার্নি! বসেছিলাম চাঁন্দের গাড়ীর একদম কিনারে! ঝাকিতে গা হাত পা যে ব্যাথা হয়েগেছিল ফিরে সেটা কেবল মাফ করেছি অসম্ভব সৌন্দর্যের জন্যে। এক পাশে পাহাড় দিয়ে আটকানো, একপাশে খাদ। নিচে পাহাড়। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। শত শত ফুট নিচের উচু নিচু পাহাড়, গাছ মনে হচ্ছিল প্রকৃতিকে কেউ যেনো সবুজ শাড়ী পড়িয়ে দিয়েছে কুচি দিয়ে। মুখ দিয়ে শুধু বের হচ্ছিল সুবহানাল্লাহ! এত সুন্দর এত সুন্দর! এটা আসলে যারা গিয়েছে তারাই কেবল বুঝতে পারবে। আমার মনে হয় মুখে কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। প্রথমদিকে মেয়েরা খুব হইহই করলেও আস্তে আস্তে যতই পাহাড়ের উপর উঠছিল তাদের হৈহৈ কমিয়ে প্রকৃতি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
নিচের সবুজ মখমলের শাড়ী পড়া পাহাড় দেখে আমার বার বার মনে হচ্ছিল এখান থেকে লাফ দেই। নিচের মখমলের উপর পড়বো নিশ্চই। বার বার আমার এই লাফ দেওয়ার কথা শুনে এক সহপাঠী এসব কথা না না বলতে বলে এক ধমক দিয়ে বসলো!
এসব দেখে দেখেও একসময় সবাই বিরক্ত, কখন নীলগিরি পৌছাবো। এর মাঝেই আমার মনে হল এক কানে কম শুনছি! অর্থাৎ কান তব্দা দিল! ভাবলাম এটা আমার সমস্যা হয়ত, ঠান্ডা লেগেছে তাই এরকম। কিছুক্ষন পরে দেখি দুই কান তব্দা সাথে খুবই গরম। পাহাড়ে এরকম হবে এটা জানাই ছিল তাও অন্যদের জিজ্ঞেস করলাম ওরা তেমন সাড়া দিল না। ওদের খুবএকটা এরকম হয়নি হয়ত অথবা খুব হৈহৈ করায় টের পায়নি।
যাইহোক অবশেষে নামলাম নীলগিরি ! নামতে নামতেই ঝপ করে এক খন্ড মেঘ আমাদের মাঝ দিয়ে গেল এবং শির শির করে পড়ল পানি! আহ সেই সময়ের সেই অনুভূতি ! সম্ভবনা আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা! একটাই কথা বলবো, "গিয়ে দেখে আসুন"
আমার বান্ধবীরা ক্যামেরায় প্রাকৃতিক ছবি তোলার চাইতে নিজেদের ছবি তোলায় বেশি ব্যস্ত থাকে আর আমি চার পাশে এত এত সুন্দরে বিমোহিত যে মোবাইলের গ্যালারিতে নেওয়ার চাইতে নিজের মনের গ্যালারি পূর্ণ করায় বেশী মনোযগী ছিলাম ফলে মানুষ ছাড়া তেমন কোন ছবিই নাই।
ক্লান্ত হলে বসে পড়তে পারবেন এখানে
ভাবছেন এরকম খালি কেন! কেউ কী ক্লান্ত ছিলনা এখানে? আরে মশাই এসব হল পুরাতন। নতুন গুলো দেখেন কীরকম বুকড
(মানুষ ছাড়া একটাও ছবি নাই )
নীলগিরি থেকে ফেরার পথে উপজাতি দোকানে পাহাড়ী পেঁপে খেতে খেতে আমি বললাম এখান থেকে ফ্রেশ এর ২লিটার এর বোতল কিনে নিয়ে যাই। বান্দরবান এর হোটেলে যেই পানি দেয় সেটার স্বাদ ভয়াবহ কষ! আমাদের দেখাদেখি দেখলাম প্রায় সবাই ২লিটার করে বোতল কিনে নিল।
পথে ঝর্না দেখতে নেমে শপিং টপিং করে হোটেল।
দুপুরে খাওয়ার পরে যাওয়া হল নীলাচল। নীলাচলের সৌন্দর্য আমার কাছে নীলগিরিে চাইতে বেশী মনে হয়েছে। আর নীলাচলের আসল সৌন্দর্য, চরম সৌন্দর্য দেখা যায় সন্ধ্যায় এবং যদি থাকে মেঘলা আকাশ তবে সৌন্দর্যের সাথে বজ্রপাতের ভয়ও বহুগুনে বাড়িয়ে তোলে।
একবার ভাবুন ত সূর্য বিদায় নিচ্ছে, আপনি দাড়িয়ে আছেন রেস্ট হাউসের দোতলার বারান্দায় রেলিং ধরে আপনার থেকে অনেক নিচে, সামনে এরকম একটি দৃশ্য
আপনি ই বলুন আমার মন যে বার বার লাফ দেই লাফ দেই বলেছে, খুব দোষের কিছু বলেছে! (ছবি: নেট কালেক্টেড)
এরকম সুন্দর সিড়ি বেয়ে নেমে আপনি অনেক নিচে যেতে পারবেন, মনে হয় যেনো পাহাড়ের বুকে মুখ লুকাচ্ছি
সূর্য ডোবার পরে নিচে দূরে পাহাড়ে বুকে যখন টিমটিম করে আলো জ্বলছিল বোঝা যাচ্ছিল ওখানে কোন শহর আছে। আমার মনে হচ্ছিল আমি যদি ওখানে যেতে পারতাম! গেলে অবশ্য দূর থেকে যেই সুন্দর অত লাগত না। আবেগে আরকি এসব মনে হয় তখন। আপনি গেলে আপনারও আবেগ এরকম টগবগ করে ফুটবে।
ফেরার সময় খুব বিদ্যুত চমকাচ্ছিল। এমনিতেই বিদ্যুত চমক আমার প্রচন্ড ভয় লাগে আর তো পাহাড়ে ! নিরাপদেই অবশেষে ফিরেছি।
রাতে আমরা ৬জন একরুমে থাকার জন্যে রুম পেয়েছি। পাশাপাশি বিশাল দুই খাট, মাঝে সাইড টেবিল। কে কার সাথে ঘুমাবে এই ভেবে ঠিক হল দুই খাট একত্রে করা হবে। যেই ভাবা সেই কাজ! কিন্তু হোটেলের ফার্নিচার এত্ত বিশাল, আর এত্ত ভারি! বাপ্রে বাপ! বহুত কষ্টে একসাথে করা হয়। সব চাইতে মজার ব্যাপার হল আমরা পরদিন যে খাট আগের মত করবো তা আর মনে ছিল না। কক্সবাজার হোটেলে গিয়ে মনে পড়ে আমরা বান্দরবানে খাট ওরকম করে এসেছি !
**************
যাগগে পরদিন যাওয়া হল মেঘলা রিসোর্ট। এটাও সুন্দর তবে নীলগিরি, নিলাচলের কাছে কিছুই না।
ঝুলন্ত সেতু দিয়ে পার হতে খুব মজা পেয়েছি। সেতুর মাঝে গিয়ে সবাই ইচ্ছা করে লাফিয়ে সেতু ঝুলানোর চেষ্টা
সম্ভবত কেবল কার থেকে তোলা সেতুর ছবিটা
কেবল কারে বসে তোলা আরেকটি ছবি। প্রকৃতি আসলেই অতুলনীয়
**********************
মেঘলা যাওয়ার আগে সকাল সকাল যাওয়া হয়েছিল স্বর্ন মন্দির। সকালের উজ্জল রোদে এই মন্দির যে কী পরিমান সুন্দর লাগে, ওঠার সময়, বিশেষ করে ওঠার পরে যেই কষ্ট হবে সেটা পুষিয়ে যাবে এর সৌন্দর্য দেখে!
বিশ্বাস না হলে আসুন আমার সাথে, আমি দেখাচ্ছি
এটা নিচে থাকতে মন্দিরের দিকে যাওয়া হচ্ছিল হেটে হেটে
মানুষ ছাড়া ছবির বড়ই অভাব !
গুগুল ঘেটে যেসব ছবি পেয়েছি তা দেখালে আপনারা যেতেই চাইবেন না।
উল্টে আমার কাছে টাকা চাইবেন এতক্ষন যে বকবক শোনালাম তার জন্যে তার চেয়ে এখানেই আজ শেষ করি।
চুপি চুপি একটা কথা বলি। মন্দিরে আমাদের মতই বয়সি বা একটু কম হবে এরকম কিছু ছেলেকে দেখি কেউ ভেতরে যাচ্ছে, কেউ বারান্দায় বসে ওদের গুরুর কাছে ধ্যান করছে। সম্ভবত এরা ধর্মীয় শিক্ষা দিক্ষা নিচ্ছিল। আমরা ফাজিলের দল ওসব কিউটি কিউটি ছেলের পেমে পরে গিয়েছিলাম।
**************
নটে গাছটি মুড়োয়নি, আমার গল্প শেষ হয় নি।
আজ পাহাড়ের গল্প এখানেই শেষ। বেঁচে থাকলে আবার আসবো সাগরের গল্প নিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:১০