দু'পাশে অসংখ্য গাছ সারি সারি তার মাঝ দিয়ে শক্ত পায়ে চলা মেঠো পথ। পথটা মানুষের পায়ে পায়ে এতটাই খটখটে হয়ে গেছে যে ছায়া ঢাকা বনের মধ্যে মনে হয় যেনো জ্বলজ্বল করছে। গাছে গাছে পাখপাখালির কিচির মিচির। ছোট্ট এক টুনটুনি লেবু ঝোপের বড় এক পাতার আড়ালে বাসা বোনায় ব্যস্ত। চড়ুই পাখির ঝাঁক মাটিতে নেমে খাবারের সন্ধানে খুটছে আবার ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ে বেড়াচ্ছে। বাঁশ ঝাড়ের ভেতর বসে একাকী এক কোক্কা ডেকে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কোন এক ডালের ভেতর বসে "চোখ গেলো, নাক গেলো" বলে এক পাখি ডাকছে। রোজ বনের এসব দেখতে এবং শুনতে শুনতে কলেজে যেতে জয়ী'র একদমই একঘেয়ে লাগেনা। ছোট্ট বেলায় যখন গ্রামে যেতো এই চোখ গেলো, নাক গেলো ডাকা এই পাখির ডাক খুব শুনতো। আরেকটি পাখি "কুটমাইইল, কুটমাইইল" বলে ডাকে। কুটুম পাখি বলে মনে হয় একে। এ পাখি কোন বাড়ির উঠোনে গাছে ডাকলে নাকি সে বাড়িতে কুটুম আসতো। এসব ভাবতে ভাবতে এগোতেই কাছেই কোথা থেকে যেনো কোকিলের কুহু তান ভেসে আসছে। তার মানে শীত একেবারেই শেষের দিকে, বসন্তের জানান দিচ্ছে। সামনে কলেজে বসন্ত বরন উৎসব হবে। ভাবতেই মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। পুরো কলেজটা যেনো বাসন্তী আর সবুজ রংয়ে রঙ্গীন হয়ে যায়। উচ্ছল মেয়ে গুলোকে দেখতে এত ভাল লাগে। সেদিন যেনো শিক্ষিকা এবং ছাত্রীদের মাঝে কোন দেয়াল থাকে না। কলেজের এসব উৎসবের দিনে শিক্ষিকা-ছাত্রী সবাই একাকার হয়ে যায়।
ফিরে যায় নিজের ভার্সিটির সময়ে। পয়লা ফাল্গুনে বসন্ত উৎসব, পয়লা বৈশাখ, আষাঢ়ের প্রথম দিনে বর্ষা বরন, শীতের পিঠা উৎসব কিচ্ছু বাদ যেতো না। সব উৎসবে শাড়ী পড়ে বন্ধুদের সাথে হৈ হৈ করে বেড়ানো ছিলো ওদের কাজ। এমনকি ভ্যালেন্টাই ডে তে নিজেদের জুটি নাই বলে সব বান্ধবী মিলে লাল ড্রেস পড়ে কোন একজনের বাসায় গিয়ে কেক কেটে হৈচৈ করে আসতো! ভার্সিটিতে ওদের গ্রুপটিই ছিল এসব কাজে বেশী ওস্তাদ। একবার আষাঢ়ে টিউশনির টাকার আশায় আগেই ধার করে শাড়ী কিনে বিপদে পরে গিয়েছিল জয়ী। বেচারির সেই মাসে টিউশনির টাকা পায়নি। তখন কষ্ট হলেও এখন সেই কথা মনে করলে হাসি পায়। এখন ওরকম দুই চারটা শাড়ী কেনা কোনই ব্যাপারনা। সময় মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়!
ভার্সিটির শেষ বসন্ত বরন উৎসবটা এখনো এতবছর পরেও জয়ী'র কাছে সেরকম রঙ্গীন ই আছে। কী জাকজমক করেই না হয়েছিলো, কী হৈহুল্লোড়-ই না করেছিলো! তিন/চার মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি। ক্যাম্পাসে শেষ ফাল্গুন বলে কোন ভাবেই মিস করা যাবে না। যেরকম আশা করেছিল সেরকম ভাবেই কেটেছিল দিনটি। পুরো ভার্সিটি লাইফ দারুন ভাবে উপভোগ করেছে বন্ধু-বান্ধবের সাথে। কোথায় যে গেলো সেসব দিন। অবশ্য খুব একটা যে মিস করে সেরকমও না বরং জয়ী'র ভাল লাগে এসব দিনের কথা মনে করতে। অনার্সের পরে গ্রুপ থেকে প্রায় এক প্রকার বিচ্ছিন্নই হয়ে গিয়েছিল। সবাই মাস্টার্সের জন্যে প্রস্তুতি নিলেও জয়ী প্রস্তুতি নিয়েছে বিসিএস এর জন্যে। সবাই জানতো জয়ী পড়াশুনা শেষ করে পুরোদস্তুর গৃহিনী হবে। জয়ী সব সময় বলতো বান্ধবীদের, 'তোরা ফুলটাইম চাকরী করবি আর আমি ফুলটাইম গৃহিনী হবো" । সেই জয়ী যখন বিসিএস দিয়ে সরকারী কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দিয়ে পার্টির আয়োজন করে বন্ধুবান্ধীদের এক করে সবার সামনে খবরটা দিলো সেদিন সবার চেহারা দেখার মত হয়েছিল। সবাই এখন যার যার জায়গায় ভাল আছে। বছরে দু'একবার দেখা হয়। গ্রুপের সব চাইতে সুন্দরী সোমার বিয়ে হয়েছে আর্মি অফিসারের সাথে। নিজে সুন্দরী, বাবা প্রতাপশালী, স্বামীর গর্ব সব মিলিয়ে মেয়েটি বান্ধবীদের সামনেই একটু দেমাগ দেখাতো। কিছুদিন আগে শুনে সে নাকি চাকরী ছেড়ে স্বামীর সাথে মিশনে চলে গেছে দেশের বাইরে। খুব সম্ভবত লাইবেরিয়া এখন। নিশাত কোন এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির লেকচারার। মেয়েটি সব সময় বলতো, দেখো শিক্ষকতা আমার একদমই পছন্দনা কিন্তু আমার কপালে সেই আছে। হয়েছেও তাই।
বাকীরাও ভালই আছে, বছরে দু'একবার দেখা সাক্ষাত হয় এখনো।
সবার বিয়ে হলেও একমাত্র জয়ী-ই এদিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। সেজন্যে ওর আক্ষেপও নেই তেমন। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে কলেজের গেটের সামনে এসে পৌছে যায় টের-ই পায় না জয়ী। আজ দেরী হয়ে গিয়েছে অনেক। ক্লাশ নেওয়ার ফাঁকেই নোটিশ আসে স্বরস্বতী পুজা উপলক্ষ্যে কাল কলেজ ছুটি, এবং কলেজে পুজার আয়োজন করে হয়েছে, যারা চায় তারা যেনো কলেজে আসে। নোটিশে সই করে লেকচার দেওয়ায় মন দেয় আবার।
***********************************************
নদীর পাশ দিয়ে মেঠো পথে হেটে বাসায় ফিরতে ফিরতে চিন্তা করতে থাকে কী করা যায়, এর মাঝেই কোনটা বেজে ওঠে
হ্যালো......
>> নিশাত বলছিলাম
আরে নিশাত যে....কী খবর (আনন্দে কলকলিয়ে ওঠে)
>> ভাল ভাল, তোমার খবর বলো, আছো কেমন, কাল তো কলেজ ছুটি চলো কোথাও বেড়িয়ে আসি...
উমম...ভাল আছি । কোথায় যে যাবো, আমারতো একদিনের ট্যুরে পোষায় না জানোই....
>> তাহলে.......
আচ্ছা এক কাজ করো তোমার বরকে নিয়ে চলো আসো আমার এখানে, পিকনিক করা যাবে। এখানকার পরিবেশ এত সুন্দর, তোমার পছন্দ হবে।
>> আরে আমার বর মহাশয় কি আর দেশে আছেন, ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে ১৫ দিনের জন্যে.....
তাহলে আরকি, চলে আসো খুব মজা হবে
>> আচ্ছা তাহলে সেই কথাই রইল। কাল ইনশাআল্লাহ সকালের প্রথম বাসেই রওনা দিচ্ছি। সাথে সারপ্রাইজ গেস্ট থাকবে একজন....
সারপ্রাইজ গেস্ট....?
>> সেটা নাহয় কালই দেখো....
কিন্তু....
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দেয় নিশাত...
তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে ঘরদোর গোছানোয় ব্যস্ত হয়ে পরে জয়ী। নিশাত খুব গোছানো মেয়ে, জয়ী তার পুরোপুরি উল্টো। ভার্সিটি তে থাকতে নিশাত যখন জয়ীর মা'র বাসায় যেতো ওর রুম-পড়ার টেবিল দেখলে বকতো ওকে অগোছালো বলে, কখনো কখনো নিশাত নিজেই গুছিয়ে দিয়ে আসতো। বিছানার চাদর বদলাতে গিয়েও বদলালোনা, ভাবল কালই বিছানো যাবে ধোয়া চাদর। কি রান্না করবে তার লিস্ট করে বাজার করে নিয়ে এসেছে বাসায় ফেরার পথেই। নিশাত নিজে রান্না করতে না পারলেও খেতে খুব ভালবাসে। ও বলতো, "মেয়েরা মজার কিছু খেয়ে আবার রেসিপি জিজ্ঞেস করে, কী দরকার রেসিপির। রান্না মজা হয়েছে খেতে মন চাইলে আবার তার কাছে আসবো তাহলেই খাওয়া যাবে।" মেয়েটা একটুও বদলায়নি। এখনো সেরকম-ই আছে।
**************************************
টিচার্স কোয়ার্টারে থাকার জায়গা পেলেও তা নেয়নি নিশাত। গ্রামের দিকে একটু ভেতরে হলেও এই একতলা বাংলো বাড়ীটে বছর হিসেবে ভাড়া নেয়। মালিক দেশর বাইরে থাকে বলে কেউ তেমন আসেনা। জয়ী'র এরকম একটা বাড়ীর খুব শখ। স্কুল থেকেই স্বপ্ন দেখতো এরকম বাড়ীর। ইচ্ছে আছে টাকা জমিয়ে এরকম বারী করবে একটা। জায়গাও কিনেছে একটুকরো।
সকাল থেকেই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে বান্ধবী আসবে বলে। জয়ী ভেবেই পায়না সারপ্রাইজ গেস্ট কে হতে পারে। তাহলে কি রুম্মান......না না এসব কেন ভাবছে ও রুম্মানের বউ আছে। একা আসারতো প্রশ্নই আসেনা। বউ নিয়ে আসলে তো নিশাত বলতই। আর রুম্মান কোন মুখেই বা আসবে জয়ীর সামনে। ক্ষণে ক্ষণেই আনমনা হয়ে যাচ্ছে। দরজায় কলিংবেলের আওয়াজে সম্বিত ফিরে পায় জয়ী। ও দৌড়ে যাওয়ার আগেই কাজের মেয়েটা গেট খুলে দেয়।
নিশাতের সাথে যাকে দেখে তার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না জয়ী। কয়েক মুহুর্তের জন্যে হা হয়ে যায়,
আরে আরে আমাদের ফ্যাশন ডিজাইনার যে.....
চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কনিকাকে। সত্যিই নিশাত আমি ভাবতেও পারিনি এরকম সারপ্রাইজড হবো। কনিকা যে কোথাও বেড়াতে যেতে পারে এটা ভাবনার বাইরে ছিলো। তোমার মনে আছে আমরা কোথাও ঘুরতে গেলে ও অসুস্থতার অযুহাতে যেতে চাইতো না
বলেই হা হা করে হেসে উঠলো দুজনে
>> হইসে লেগপুল করা বন্ধ করো আমাকে (হেসে দিয়ে বলে উঠলো কনিনা)
~~ তো কী করবো, তুমি কম জ্বালাইছো আমাদের, ভার্সিটিতে শাড়ী পড়তা না কোন অকেশনে, কোথাও যাইতানা। তুমি খাওয়াইতে গেলে খাবার পঁচা পরতো ( নিশাত কপট রাগ দেখিয়ে বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়লো)
এই তোমার বাসাটাতো অসাম হইসে জয়ী, চারপাশে তাকাতে তাকাতে বললো নিশাত, তবে একটু অগোছালো।
এই ভয়েই ছিলাম। তাও এখন যেটুকু গোছানো সেটুকুও তোমার ভয়েই...হা হা....
বদলাওনি দেখি একটুও (পাশ থেকে হাসতে হাসতে বললো কনিকা)
কি আর করবো বলো। একা থাকি, শোধরানোর মানুষ তো নাই।
ভুল করেছো জয়ী, রুম্মানকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। ওর নাহয় ভুল ছিল একটা তাই বলে.......
আমি কোন ভুল করিনি কনিকা (বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল জয়ী'র) ছেলেটার কথা উঠলেই রাগ-দুঃখ-ঘৃনা সব এক সাথে এসে যায়, কখনো কখনো নিজের-ই গড়ে তোলা জয়ী ভেংগে পড়তে চায়।
থাক আমরা এই মুহুর্তে সেসব কথা না তুলি, পরিবেশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে নিশাত।
হ্যা হ্যা, চলো নাশ্তা করবে, কনিকা আসবে তাতো জানতামনা। নিশাতের পছন্দের সব খাবার করেছি। জমিয়ে খাবো সবাই আজ।