নিজের তিন ছেলে দুই মেয়ের মতই দেবরের মেয়ে রাণুকে নিজের মনে করেই লালন পালন করেছেন হামিদা বেগম।রাণুকে জন্ম দেবার পর পর-ই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ওর মা। পাগল বউ নিয়ে সংসার চলেনা বলে আবার বিয়ে করান দেবরকে। ফলাফল যা হবার তাই হয়! সৎ মায়ের ঘরে ঠাঁই হয়নি ছোট্ট রাণু। ছোট্ট রাণুর মিষ্টি চেহারাও মন গলাতে পরেনি সৎ মা'র। আর রাণুর জন্মদাত্রী মার ঠাঁই হয় তার মা অর্থাৎ রাণুর নানুর কাছে!
দেবর যাতে একটু শান্তিতে সংসার করতে পারে, কোন অশান্তি না হয় তাই রাণুকে নিজের বুকে তুলে নেন হামিদা বেগম। নিজের পাঁচ ছেলেমেয়ের মতই লালন-পালন করেন রাণুকে। বরং একটু বেশী ভালবাসা সবসময় রাণুর জন্যে ছিলো, তা নিয়ে যে নিজের ছেলেমেয়েরা একআধটু হিংসে করনি তা নয়। কিন্তু এতে ভালবাসা একবিন্দুও কমেনি বরং বেড়েছে প্রতিমুহুর্তে। ভাইবোনরাও ভালবাসতো রাণুকে।
জন্মের পর নিজের মা'কে চেনেনি মেয়েটি। মা বলতে চিনেছে হামিদা বেগমকেই। আস্তে আস্তে সত্য জানতে পারলেও কখনো দুঃখ হয়নি। কেননা চাচী; যে কিনা তার মায়ের ভুমিকা পালন করেছেন স্বেচ্ছায়, তিনি কখনই তাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। একসময় বাবাও তাকে নিতে অস্বীকার করে। কখনো কখনো কষ্ট যে লাগেনি তা নয় কিন্তু সেই অভাবও বোধ করেনি।
দুরন্ত শৈশব, উচ্ছল কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যৌবনে পা দেয় রাণু। দেখতে যেমন মায়ের মতই সুন্দরী তেমনি লক্ষ্মী হয়েছে মেয়েটি। ঘরময় যখন ঘুরে বেড়ায় কত কী ভাবেন হামিদা বেগম! মেয়েটিকে এবার বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তার এত আদরের ধনকে কিভাবে বিদায় দেবেন! ভাবলেই দুমড়ে মুচড়ে যান ভেতরে ভেতরে। এরই মাঝে একদিন পাত্র পক্ষ এসে দেখে যায় রাণুকে। মেয়ে তাদের পছন্দও হয়ে যায়। ঠিক হয় সামনের সপ্তাহে ছেলের অভিভাবক এসে আংটি পড়িয়ে যাবে আর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে যাবে। রাতে ঘুমতে এসে স্বামী আফজাল সাহেব তেমনটিই জানালেন
= সামনের বৃহস্পতিবার ছেলের বাড়ী থেকে রাণুকে আংটি পড়াতে আসবে বলে খবর দিয়েছে। বাজার সদাই কী কী লাগবে লিস্ট করে দিও তো কাল।
(মনে হল আসমান ভেংগে পড়লো স্বামীর মুখে খবরটি শুনে)
~~ কী বলছো তুমি! আমার এত আদরের ধন, আামার মানিককে পর করে দেবো! কোথায় দিবো, কিভাবে রাখবে ওকে, কিভাবে থাকবে.....
= পাগলামী করো না, নিজের দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছো না? ওদের কিভাবে দিয়েছো.....
~~ বুঝি সবই, তাইতো বুকে পাথর চাপা দিয়ে সেদিন সাজিয়ে পাঠিয়েছিলাম ছেলে পক্ষের সামনে। কিন্তু ওরা যখন বলে গেলো মেয়ে পছন্দ হয়েছে ওদের। বিশ্বাস কর প্রতিটি মুহুর্ত আমার বুকের ভেতর কিভাবে রক্তক্ষরণ হচ্ছে....আমি কাউকে বোঝাতে পারছিনা।
=আচ্ছা হামিদা, তুমি এখন এই পাগলামী করলে হবে?
~~ শোন, তুমি ওদের বলে দাও মেয়ে আমরা এখন বিয়ে দেবোনা বা কী অযুহাত দেখাবে সেটা তুমি বুঝবে। আমি এখন মেয়ে বিয়ে দেবোনা।
= হামিদা এটা কী ধরনের জেদ তোমার......
~~ আমি যা বলেছি তাই হবে
(লাইট নিভিয়ে পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন হামিদা বেগম)।
আফজাল সাহেব নিজের স্ত্রীকে চেনেন। স্ত্রী যেহেতু বলেছেন এ বিয়ে তার মানে হচ্ছে না। তিনি খুব ভাল করেই জানেন রাণুর জন্যে স্ত্রীর আলাদা একটি জগত রয়েছে, যেখানে পৃথিবীর আর কারো প্রবেশাধিকার নেই, আর কারো স্থান নেই।
আপাতত বিয়েটি ঠেকালেও হামিদা বেগম নিজেই চিন্তা করেন কয়দিন এভাবে মেয়েকে নিজের কাছে রাখবেন। আর নিজের শরীরও তেমন ভাল যাচ্ছেনা ইদানিং। ডায়াবেটিস তো আছেই। ব্লাড প্রেশারটাও বেশী থাকে ইদানিং। ডাক্তার বলেছেন ওজন কমাতে। কিন্তু হাঁটতেই কষ্ট হয়। শরীরের এ অবস্থা। দুই মেয়েকে বিয়ে দিলেও তিন ছেলে এখনো রয়েছে। দুই ছেলে দুবাইতে ব্যবসা করে। ছোট ছেলে ভার্সিটিতে সবে ভর্তি হলো, ওকে নিয়ে এখনো চিন্তা করতে না হলেও বাকী দুইজনের বিয়ের বয়স হয়েছে। রাণুকে বিয়ে দিয়েই বড় ছেলেকে বিয়ে করাবেন বলে ভেবে রেখেছেন। কিন্তু রাণু......ভাবলেই ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যান তিনি। কিভাবে তার এই কলিজার টুকরাকে তুলে দেবেন পরের হাতে....কিভাবে....ভাবতেই পারেননা।
********************************
বড় ননদ মীনা এসেছে বাসায়। মীনার পুরো পরিবারের আজ দাওয়াত ছিলো ভাইয়ের বাসায়। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে মীনা, মীনার স্বামী, হামিদা বেগম আর আজমল সাহেব বসেছেন একসাথে। একপর্যায়ে উঠে রাণুর কথা। মিনা বলি বলি করেও কিছু বলতে চাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে বলেই ফেললো
= আচ্ছা ভাবী রাণুকে তো তুমি নিজের কাছেই রেখে দিতে পারো...
~~ নিজের কাছে....কিভাবে...আমি জানি আমি জেদ করছি কিন্তু একসময় তো বিয়ে দিতেই হবে...
= রাণুকে বিয়ে দিয়ে শাহেদের জন্যে বউ আনবে ভেবেছো....
~~ হ্যাঁ ভেবেছিলাম তো সেরকম-ই....
= তা রাণুকেই বউ করে রেখে দাও না....তোমার মেয়ে তোমার কাছে-ই থাকলো আবার ছেলের বউ ও হলো।
** কথাটা তুই মন্দ বলিসনি মীনা ( পাশ থেকে বলে ওঠেন আজমল সাহেব)
~~ কিন্তু আত্নীয়স্বজন অন্যরা কে কি বলবে.... (আমতা আমতা করে বলেন হামিদা বেগম)
= আরে রাখো অন্যের কথা। অন্যের কথায় কি এসে যায়! আর আত্নীস্বজনরা কেউ কিছু মনে করবেনা। আমরা সবাই কি বুঝিনা তোমার অবস্থা!
~~ ঠিক আছে দেখি.....
**************************************
অনেক ভেবে চিন্তে ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে রাণুকে নিজের কাছেই রাখেন, ছেলের বউ করে। কিন্তু মানুষের ভাগ্যে যে কত কী থাকে আগে থেকে কেউ কি বলতে পারে! বিয়ের বছরখানেক পরে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে রাণু। হাসপাতালে মাস খানেক চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরে। বছর দুই পরে ফুটফুটে একটি মেয়ের জন্ম দিয়ে মায়ের ভাগ্য বরন করে রাণু! পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, ঠিক যেমনটি হয়েছিল ওর মায়ের বেলায়। হামিদা বেগম ভেবে পাননা খোদার একী ইচ্ছা! এই দুঃখী মেয়েটির কপালেই কেন এমনটি ঘটলো।
নাতনী-কলিজার টুকরা মেয়ে দুজনের দেখাশোনা করেন হামিদা বেগম নিজে। যার জন্যে নিজের শরীরের দিকে তাকানোর সুযোগ পাননি।
জীবন সংসারে কত কী যে ঘটে থাকে! হঠাৎ একদিন স্ট্রোক করেন হামিদা বেগম। তাৎক্ষনিক লক্ষনে তাই মনে হয়েছে। কিন্তু হসপিটালে নেয়ার পরে ডাক্তার জানান স্ট্রোক হয়নি এবং আসলেই কি হয়েছে ঠিক ধরতে পারেনি। দুই মাসের মত হসপিটাল-বাসায় ভোগার পরে চলে যান কলিজার টুকরা রাণুকে একা ফেলে সংসারের মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে।
সংসারের সবাই স্বাভিক অবস্থায় ফিরে গেলেও ৫২ বছরের জীবন সংগীকে হারানো মানতে পারছেননা আজমল সাহেব। প্রতিটি মুহুর্ত তিনি শূণ্যতাকে অনুভব করেন।
***********************************
ঠিক হয় শাহেদকে আবারো বিয়ে করানো হবে। রাণুর মা নাহয় তার মায়ের কাছে ছিলো। কিন্তু রাণু! ও কার কাছে থাকবে। কী হবে হতভাগীটির। আর কিইবা হবে ওর মেয়ের ভাগ্যে!
হতভাগীটি যে কী হারিয়েছে, কী হারাচ্ছে তা বোঝার অবস্থায় নেই!!