অন্যান্যবারের চেয়ে এবারের বইমেলা থেকে একটু বেশী বই কিনেছিলাম। সেগুলো মোটামুটি পড়াও শেষ। শুধু একটি বই বাদে। কি ভাবছেন, প্রায় ৪মাসেও একটি বই পড়া শেষ হয়না কিভাবে! আসলেও বইটি শেষ করতে কোন ভাবেই সর্বোচ্চ দশদিনের বেশী লাগার কথা না। কিন্তু আমি পারিনি এটদিনেও তা শেষ করতে। কেন পারিনি বলছি সে কথা। তার আগে অন্য একটি প্রসংগে আসি।
বীরাঙ্গনাদের নিশ্চই আমরা সবাই চিনি। সেসব মা-বোনেরা যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নরপিশাচদের দ্বারা পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন যাদেরকে শেখ মুজিব স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। গালভরা উপাধিটাই। আর কি পেয়েছেন তারা এই সমাজ থেকে বাকী জীবন উপহাস, অপমান আর লান্ঞ্চনা ছাড়া। কিচ্ছুটি পাননি। স্বাধীনতার পর দীর্ঘসময় যাবত একজন জননেত্রী আর একজন দেশনেত্রী দেশ চালিয়েছেন একাধিকবার। একটা মেয়ের দুঃখ ত একটা মেয়ের চেয়ে আর কেউ ভাল বোঝার কথা না। তাদের জন্যে কি কিছুই করা যেতো না। মুক্তি যোদ্ধারাত তাও কিছু পান। আর এই বীরাঙ্গনারা। মানবেতর জীবন যাপন করেছেন। কেউ কেউ এখনো হয়ত করছেন।
দীর্ঘ নয়টি মাস মা তার সন্তান গর্ভে ধারন করার পর পৈশাচিক নির্যাতনের ফলে তার দীর্ঘদিনের আকাঙ্খার ধনটির প্রথম কান্না শুনতে পারলেন না, হাসি মাখা মুখটি দেখতে পারলেন না।
ছয় মাস গর্ভে ধারন করার পর দিনের পর দিন সেই পিশাচদের নির্যাতনের ফলে এক পর্যায়ে বাচ্চাটিকে দা দিয়ে একটু একটু করে কেটে পেট থেকে বের করতে হলো!
ভাবতে পারেন সেই মার কি অবস্থা ছিলো তখন! একজন মা ছাড়া আর কারো সেই অবস্থা বোঝার সাধ্য নেই।
মাসের পর মাস সহ্য করে যেতে হয়েছে তাদের সেই অত্যাচার। যারা মারা গিয়েছেন তারা একদিক দিয়ে ভাগ্যবতী। আর যারা বেঁচে রইলেন....। তারা পেলেন আরো বেশী কষ্ট। সমাজ তাদের নিয়ে উপহাস করেছে। তাদেরকে অপমান আর মানসিক যন্ত্রনা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। ব্যাপারটা এমন যেনো এতে তাদের হাত ছিলো। তারাই দোষী ছিলো। সমাজের কাছে ত তাদের এমন কোন চাওয়া ছিলো না। একটু মানসিক শান্তনা দিলে কি এমন ক্ষতিটা হয়ে যেতো। কোন কোন স্বামী তাদের স্ত্রীদের ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। কেউ কেউ অবশ্য তাদের বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলো( তবে সেরকম বীর পুরুষের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন)। তবে তাদের প্রতি আমার অন্তর থেকে শ্রদ্ধা।
নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ নাকি সতীত্ব। আমি বলবো তা হলো কচুপাতার পানির মত। কারন ছোয়া লাগার আগেই তা শেষ!!
আমাকে একটা ব্যাপার খুব পীড়া দেয়, কি এমন ক্ষতিটা হতো সে সময়কার মানুষের তাদের একটু সাহায্য করলে। তা তো করেই নি বরং করেছে উপহাস। সমাজ থেকে করেছে তাদের বন্ঞ্চিত। সভ্যতার মুখোশ পরে আমিও সে সমাজের ই একজন।
স্বাধীনতার এতটি বছর পরে এখনো নরপিশাচদের পৈশাচিকতার শিকার হচ্ছে আমাদের মা বোনেরা। কেউ কেউ বিদায় নিচ্ছে দুনিয়া থেকে। আর যারা দূর্ভ্যক্রমে বেঁচে যাচ্ছেন তারা শিকার হচ্ছেন নানা অপমান-হয়রানির।
এ প্রজন্মের কাছে আমার অনুরোধ। আমরা না দিন বদলের কথা বলি। আসুন না স্বাধীনতা পরবর্তী সমাজের মতন আমরা হবো না। বরং আর কিছু না পারি অন্তত নির্যাতিতা মা-বোনদের মানসিক সাপোর্ট দেই। তাদের অপমান না করি। বরং বাঁচতে শেখাই তাদের। ঘৃনার দৃষ্টি নয়, ভালবাসার হাসি দেই তাদের। ব্যাস এইটুকুই তাদের সুন্দর ভাবে বাঁচতে সাহায্য করবে।
এবার বলছি সেই বইটির কথা যেটি আমি চার মাসে এক তৃতীয়াংশও ভাল করে পড়তে পারিনি। সেটি হল সুরমা জাহিদের বীরাঙ্গনাদের কথা। লেখিকার প্রতি আমার শ্রদ্ধা। অনেক কষ্ট করে বইটি লেখেছেন। আর তার ফলেই এসব জানতে পারলাম। বইটিতে লেখিকা প্রায় প্রতিটি বীরাঙ্গনার নিজ উক্তিতে তাদের নির্যাতনের কথা উপস্থাপন করেছেন। প্রতিটি কাহিনী এতটাই প্যাথেটিক যে পড়ার সময় আমার শরীর অবশ হয়ে যায়। আমি একসাথে কয়েক পাতার বেশী পড়তে পারিনা। জানিনা বইটি শেষ করতে পারবো কিনা। পড়েই আমার উপলব্ধিটা এরকম। না জানি তাদের কি অবস্থা ছিলো!!
বীরাঙ্গনা মা-বোনদের জন্যে আমি অন্তর থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া করি যাতে আল্লাহ যা কষ্ট দেবার এই দুনিয়াতেই তদের দিয়েছেন। পরকালে যাতে তাদের অনাবিল সুখের মাঝে রাখেন।
কখনই ভাল লিখতে পারিনি। আজকেও পারলাম না। অনেক দিন ধরে ব্যাপারটা খুব পীড়া দিচ্ছিলো বলে আজ লিখলাম। ভুল-ত্রুটি গুলো নিজ গুনে বরাবরের মতই এবারো ক্ষমার চোখে দেখবেন।