হোসেনের মক্তবের অফিসে আড্ডা চলছে। হোসেনের একটা কোরান শিক্ষার স্কুল আছে। হোসেন বলে মক্তব। সেখানে বিভিন্ন বয়সি নারী-পুরুষ কোরান পাঠ শিক্ষা নিতে আসেন। শিশুদেরও শিক্ষা করা হয়। আসলে এটা একটা গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান। কোরান নিয়ে এরা গবেষণা করে। হোসেন এখানে একই সঙ্গে শিক্ষক এবং গবেষক।
সেখানেই আড্ডা চলছে। আড্ডার নিয়মেই আড্ডা চলছে। আড্ডার নিয়ম হল রাজ্যর সকল বিষয় চলে আসবে। আমাদের আড্ডাতেও আসছে। এক সময় ধর্মও চলে আসলো। বাঙালি নয়, বাংলাদেশের মানুষের ধর্মচিন্তা। নাহ্, হল না। ধর্ম পালন বলা যায় কী? উঁহু, তাও নয় বোধহয়। সংস্কার বলা যেতে পারে। উঁহু, সেটাও নয়। থাকুক বিষয় । পরের কথায় যাই।
হোসেন একটা গল্প বলল। সত্য গল্প। একলোক প্রচুর সিগারেট খায়। বিপদসীমা অতিক্রম করে খাওয়া যাকে বলে। নিজের জীবনে কোনও ধর্মচর্চা নাই। নামাজ রোজা কিচ্ছু না। চিন্তাভাবনা তো বহুদূর। হঠাৎ সবাই একদিন দেখল সেই লোক আমূল বদলে গেল। রাতারাতি সিগারেট ছেড়ে দিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ধরল। 'লেবাস'ও বদলে ফেলল। তার এই পরিবর্তনে পরিজন বন্ধুরা সকলেই মহা আনন্দিত।
তবে কৌতুহলী মানুষ সকল যুগেই বিদ্যমান। সকল স্থানেই বিদ্যমান। দেখা গেল এই লোকের যুগ আর স্থানেও সমানভাবেই বিদ্যমান। সেই কৌতুহলী লোকেরা তাদের কৌতুহলী প্রকাশ করল।লোকটার পরিবর্তন বিষয়ক কৌতুহল। ভদ্রলোক হৃষ্টচিত্তে মুখমন্ডলে নুরানি আলো জ্বেলে বললেন,
-‘আমার পীর বলে দিয়েছে।’
এই পর্যন্ত বলেই হোসেন হাসতে লাগল। হোসেনের হাসি বড় সৌন্দর্য। আকর্ষণীয়ও। হোসেন যখন হাসে ওর পুরো মুখটাই হাসে। সেদিন দেখলাম পুরো শরীরটাও হাসে। এমন কী সূফীদের মত লম্বা দাড়িও হাসে। বড় নির্মল হাসি। আমার বেশ মজা লাগল। আমিও হাসতে লাগলাম। হাসতে হাসতে হোসেন বলল, ‘আল্লাহ যে বলে দিছে, রাসূল যে বলে দিছে, নবীরা বলছে, সেইটা শোনে না। আর পীর বলছে তো সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টায়া ফেলছে! হাহাহা...’
আসলেই মজার না?
হোসেনের ধর্ম বিষয়ক পরিষ্কার চিন্তাভাবনা আমার ভালো লাগল।
বাংলাদেশের মানুষ বড় ধর্মভীরু। ধর্মকাতরও। আবার একই সঙ্গে অজ্ঞও বটে। কিন্তু এই অজ্ঞতা অশিক্ষা থেকে নয়। আরোপিত।
বাংলাদেশের মানুষ বাংলা কিংবা ইংরেজি পড়তে শেখেন বা নাই শেখেন আরবিটা ঠিকই শেখেন। কিন্তু বাংলা কিংবা ইংরেজি শেখার পর সেই ভাষাটা যতটা বোঝেন, আরবি ভাষাটা ততটা বোঝেন না। আসলে কিছুই বোঝেন না। আমাদের পরিবারগুলো আরবি পড়তে পারাটা নিশ্চিত করলেও আরবি ভাষা বুঝতে পারাটা নিশ্চিত করেন না। ইচ্ছে করেই যেন করেন না। কোন এক রহস্যময় কারণে এই বিষয়ে উদাসীন থেকে যান।
ফলে সকল সংস্কারের মত ধর্মর সংস্কারেও কুসংস্কার ঢুকে পড়ে। এবং সকল সংস্কারের চাইতে ধর্মর কুসংস্কার সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
প্রতিদিন পাঁচ বেলা আজান ও নামাজে অসংখ্যবার পরম ভক্তিতে ‘আল্লাহ এক এবং তাঁর কোনও শরীক নাই’ উচ্চারণ করেও পীর ধরেন। পীরের মুরিদ হন। মাজারে যাতায়াত করেন। ইচ্ছাপূরণের ইচ্ছায় সূতা বাঁধেন, ‘মানত’ করেন।
কিন্তু পীরের ‘মুরিদ’ হয়ে, মাজারে সূতা বেঁধে, ‘মানত’ করে যে শিরক করে ফেলছেন, সেইটা বুঝছেন না। তার পাঁচ বেলার ইবাদত তখন কতটা অর্থ বহন করছে সেটা নিয়েও ভাবছেন না। ভাবনার তাগিদটাও অনুভূত হচ্ছে না।
বাংলাদেশে এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যারা সারাজীবনে হাজার হাজারবার কোরান ‘খতম’ দিয়েছেন কিন্তু সারাজীবনে একবারও কোরানের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ পড়েন নি।
কদিন আগে দিপু আরেক গল্প বলল। নিউ ইয়র্কে ওর বড় ভাইয়ের বাসায় অতিথি এসেছে। তো মধ্যাহ্ন ভোজে খাবার টেবিলে মাংস পরিবেশন করা হয়েছে। খেতে বসে অতিথি বলল,
-‘ভাই, মাংস হালাল তো? আমি আবার হালাল মাংস ছাড়া খেতে পারি না।’
সেদিনই সন্ধ্যায় আড্ডা চলছিল। অতিথি কেমন যেন মোচড়া মুচড়ি করছিল। মোচড়া মুচড়ি দেখে দিপুর ভাই জানতে চাইলেন,
-‘কী হয়েছে ভাই? কোন সমস্যা?’
অতিথি বললেন, ‘সন্ধ্যা হইছে। একটু পানি টানি দিয়ে গলা ভেজাতে পারলে মন্দ হত না।’
এই ‘পানি টানি’ হল আদি ও অকৃত্রিম মদ। প্রাকৃতিক কিংবা মিনারেল পানিতে হালাল গোস্ত খাওয়া অতিথির পোষায় না। তিনি ধর্মে নিষেধ করা মদ দিয়ে শুকনা গলা ভেজাতে চাইছেন। দিপুর বড়ভাই হুইস্কির বোতল বের করে দিলেন। আর দুপুরে হালাল মাংস ছাড়া খেতে না পারতে পারা অতিথি ভদ্রলোক মহানন্দে সেই হারাম হুইস্কির বোতল শূন্য করতে লাগলেন।
দিপুর বর্ণনায় আমরা জানতে পারি নি অতিথিকে পরিবেশন করা মাংসর মত হুইস্কিও হালাল ছিল কিনা। যিনি হালাল মাংস না হলে খেতে পারেন না, তিনি হারাম হুইস্কির বোতল মহানন্দে শূন্য করে ফেলবেন-এই তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কোনও কারণও দেখি না। দিপু নিশ্চয়ই বদলোকের যোগসাজসে হালাল হুইস্কির প্রাপ্তীস্থান ষড়যন্ত্রমূলক মনোভাব নিয়া গোপন করেছে।
আপনারা কী হালাল হুইস্কির কথায় অবাক হয়েছেন? ভাবছেন এই ভাবনা আমার উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত? ভেবে ঠোঁটের কোণায় তীক্ষ্ম তাচ্ছিল্য ডোবা হাসি ফুটিয়ে তুলে ভাব ধরেছেন? সমস্যা নাই। ধরেন।
এইবার তাহলে আসেন আপনাদের জন্য অট্টহাস্য হাসির আয়োজন করি।
মধ্যপ্রাচ্যর সকল দেশে পাওয়া যায় কিনা জানি না তবে কাতারের যত্রতত্র হুইস্কি না হলেও হালাল বিয়ার পাওয়া যায়। দামও বেশ সুলভ। আমিও সেই বিয়ার মাঝে মধ্যে কিনে খাই। হালাল তো। হালাল খাইতে তো ধর্মে নিষেধ নাই। তাই সমস্যাও নাই।
তবে যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন তারা হালাল বিয়ার খুঁজতে আগ্রহী হবেন, তার কোন কারণ নাই। ইসলামি না হলে তো ইসলামের নিষেধের আওতায় পড়ে না, তাই না? । তাই তাদের হালাল বিয়ার খাওয়ার কোনও কারণ নাই। তাই তারা হারাম বিয়ারই খোঁজ করেন। উইক অ্যান্ডে ভারতীয়, নেপালী, শ্রীলঙ্কান, ফিলিপিনো হারাম বিয়ার খুঁজতে চান। হারাম হুইস্কিও খোঁজেন। কাতার চামে চিকনে অ-ইসলামিদের সেই খোঁজাখুঁজি সার্থক করার ব্যবস্থা করে রেখেছে। ছুটির দিনের আগের রাতে কোন একলোক হারাম বিয়ার, হারাম হুইস্কির বোতল তাদের ঘরে এসে দিয়ে যায়। এইটাকে বলে হোম ডেলিভারি।
মধ্যপ্রাচ্যর সকল আরবি দেশগুলাতে এই অবস্থা বিরাজমান কিনা জানি না তবে খবরের কাগজের মাধ্যম দিয়া জানা যায় সৌদি আরবের অবস্থা আরও ভয়াবহ।
এইত কয়দিন আগে হংকংয়ের একটা কোম্পানি সোফিয়া নাম দিয়া একটা রোবট বানালো। আর সৌদি আরব সেই রোবট দেখার সঙ্গে সঙ্গে সোফিয়ারে তার দেশের নাগরিক বানায়ে ফেলল। বিবিসি জানালো, সোফিয়া সৌদি নারীদের চাইতেও বেশি অধিকার ভোগ করছে কিনা সেটা নিয়াও বিরাট আলোচনা-সমালোচনা চলেছে।
নারী বিষয়ে সৌদি আরব বরাবরই স্পর্শকাতর। এইত গেল আগস্টে বিশ্বের খবরের কাগজগুলো বড় বড় অক্ষরে হেডলাইন দিয়া খবর ছাপল সৌদি পর্যটন কেন্দ্র বানাবে এবং সেখানে নারীরা বিকিনি পইরা ঘোরাঘুরি করতে পারবে। কয়দিন আগে আবার শুনলাম সৌদি আরব দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ন্যুড বিচ বানাবে!
এখন আপনারা প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে, ওই নগ্ন সৈকতে কাহারা নগ্ন হইয়া ঘোরাফেরা করবে? সৌদি নারী-পুরুষেরা? পাশ্চাত্যর নারী-পুরুষেরা? নাকি আমাদের প্রাচ্যর নারীরা? লক্ষ্য করছেন নিশ্চয়ই প্রাচ্যর পুরুষদের কথা বলি নাই। না বলার কারণ হইল প্রাচ্যর পুরুষদের সৌদির লোকেরা ‘কামলা’ হিসাবে দেখতে ভালোবাসে।
বছরখানেক আগে বাংলাদেশ থেকে কর্ম করতে যাওয়া শ’দেড়েক শ্রমিক সৌদি আরব এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। ফেরত পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে তারা জানিয়েছিল বাংলাদেশ ‘কামের বেটি’ হিসাবে বাঙালি নারীদের পাঠায় নাই কেন?
কামের বেটি হিসাবে বাঙালি নারী সৌদির লোকদের বড় পছন্দ। তারা বাঙালি কামের বেটিদের যথেচ্ছাচারভাবেই যৌনদাসী বানায়া ফেলে। বাংলাদেশ অ্যাম্বেসি কখনও কিছু বলে না। তারা তার দেশের নারী-পুরুষদের কোনও খোঁজ খবর নেয় না।
আর বলতে ইচ্ছা করতেছে না। কিন্তু একটা কথা মনে পড়ছে। সেইটা বলা দরকার। নিজেদের কথা। কয়েক মাস আগেই সৌদির এক রাজপুত্র কাম মন্ত্রী টেলিভিশন বক্তব্যে বলল, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মত দেশগুলার মুসলমানরা নাকি প্রকৃত মুসলমান না! তারা নিজেরা আর তাদের মনোনীতরাই নাকি প্রকৃত মুসলমান!
এই যে সৌদি আরব মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আর খোদার ওপর খোদদারি করল, বাংলাদেশের ধর্মর ধ্বজাধারীরা কিন্তু একটা টু শব্দও করে নাই! তারা সোফিয়ায় মুগ্ধ হইতে ব্যস্ত ছিল। অথচ এরাই ছবি তোলা হারাম বলে গরম গরম কথা বলে। ইসলামে মূর্তি বানানো হারাম বলে ভাস্কর্য ভাইঙ্গা গুঁড়া করতে চায়। কইরাও ফেলে।
এই ধরনের ধর্ম নিয়া হিপোক্রেসি খালি যে বাংলাদেশ, আমেরিকা, কাতার কিংবা সৌদি আরবের একশ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে আছে, তা নয়। সকল যুগে সকল দেশেই সকল ধর্মেই এরা ছিল। এরা আছে। এরা থাকবেও। আমাদের স্কুলে শেখা বকধার্মিক এরাই।
আমরা যারা স্কুলে একসঙ্গে লেখাপড়া করেছিলাম তারা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছি সারা দুনিয়াময়। সকলের সঙ্গে সকলের যোগাযোগও ছিল না। প্রায় তিন দশক পর হঠাৎ করেই এক এক করে অনেককেই পাওয়া গেল। আমরা সবাই ইংরেজিতে যাকে বলে এক্সাইটেড, তাই হয়ে গেলাম। আমাদের একটা গ্রুপ আছে। সবাই সবার ব্যস্ততায় সারাদিনে যখন সময় পায় সেখানে ঢুঁ মারে। আড্ডা চলে।
কদিন আগে একজন গ্রুপে যুক্ত হল। সম্ভবত ইউরোপ আমেরিকার কোথাও থাকে। সে কারও সঙ্গে কথা বলে না। কোনও আড্ডায় অংশ নেয় না। কেবল তবলিগ জামাতিদের দেয়াল থেকে পোস্টগুলো কপি করে আমাদের গ্রুপে পোস্ট করে দেয়।
আমি তাকে চিনতে পারি না। আমি চিনতে চেয়ে বলি, ‘ওই তুই কে রে? তুই কী আমাদের দোস্ত? আমাদের সঙ্গে পড়ছস্?’
স্কুল সহপাঠিদের সবাই সবাইকে তুই সম্বোধনেই ডাকি। অতএব না চিনলেও ক্ষতি নেই। স্কুলেরই তো। পরিচয় দিলে নিশ্চয়ই চিনে ফেলব। আর সেও তখন আমাকে তুই সম্বোধনেই বলবে।
কিন্তু সে বন্ধু কথা কয় না। আমাদের কারও কথার জবাব দেয় না। নিশ্চুপ হয়ে যায়। ধর্ম যে উদারতা কথা বলে সেটা সে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে নি। ফেসবুকের তাবৎ ইসলামি পেইজগুলোর পোস্ট পাঠ করে, শেয়ার করে আমাদের সে বন্ধুটি কিছুই রাখতে পারে নি। ইউরোপ কিংবা আমেরিকাতে বসবাস করেও সে দুর্নীতিগ্রস্থ বাংলাদেশ হয়ে রয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ি যেমন। যা ঢালা হয় তাই ঝুড়ি গলে বেরিয়ে যায়। ঝুড়ি কোনদিনই পূর্ণ হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৮ ভোর ৪:২৯