আজকে আপনাদের সবার কাছে জীবনে ঘটে যাওয়া একটি লোমহর্ষক ঘটনা জানাতে চাই। সেই দিনের কথা মনে পড়লে আজও আমার শরীর শিহরিত হয়ে উঠে। ঘটনাটা ঘটেছিল গত রোজার ঈদে বাড়ি থেকে ঢাকার ফেরার পথে।
সেদিন ছিল আগষ্টের ৩ তারিখ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ীর অপেক্ষা করছিলাম। ২ ঘন্টা পরে একটা বাসের আগমন দেখে সবাই যখন হুমড়ি খেয়ে পড়লো তখন একটি বাস কাউন্টার আবিষ্কার করলাম। মৌচাক ঘিরে মৌমাছি থাকলে যেমন মৌচাক অদৃশ্য হয়ে যায় তেমনি ছিল কাউন্টারের অবস্থা।কাউন্টারে গিয়ে শুনি সাথে মহিলা থাকলে ১টা সীট দেয়া হবে আর ৩ জন পুরুষ থাকলে ১টা সীট দেয়া হবে ১ জন বসে আর বাকী দু,জন দাঁড়িয়ে।
টিকেটের এমন প্যাকেজের কথা শুনে সকল ক্ষোভ গিয়ে পড়ল বড় ভাইয়ের উপর। তিনি বিয়ে না করাতে আমি নিজেও করতে পারছি না, ফলে সাথে বউ না থাকার কারনে টিকেটও পাচ্ছি না।
রাগে ক্ষোভে পাশের চায়ে দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় এক বাসের কর্মচারীকে ঘটনাটা খুলে বলাতে তিনি আমাকে কিভাবে যেন একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। বাসের সিটে বসে সেই আরামে চোখ বন্ধ করার প্ল্যান করছি ঠিক তখন সামনে এক গর্ভবতী মহিলা এসে দাঁড়ালেন। ফলে বিবেকের তাড়নায় বাধ্য হয়ে আমি তাকে আমার সিটটা ছেড়ে দিলাম। মড়ার উপর খাড়ার ঘা! আমার মানিব্যাগ পকেটমার হয়ে গেল। পরে বাবাকে ফোন করে বিকাশের মাধ্যমে কিছু টাকা ম্যানেজ করলাম।
বরিশাল থেকে মাওয়ার উদ্দেশ্যে নতুন বাসে উঠলাম,গৌরনদি এসে বাসের ছাদে পান তুলা হলে সব যাত্রীরা এর প্রতিবাদ জানাতে লাগলো, প্রতিবাদে সবাই ব্যর্থ হয়ে রাগে ক্ষোভে গজগজ করতে থাকলো। যেই চিন্তা সেই ফলাফল কিছুদুরে গিয়ে চাকা পাঞ্চার, শুরু হয়ে গেলো ষ্টাফ আর যাত্রীদের মাঝে যুদ্ধ। ষ্টাফের সংখা কম থাকায় ভীষন রকমের মার খেয়ে চাকা পরিবর্তন করে পুনরায় তারা যাত্রা শুরু করলো, যাত্রীরা আনন্দে হাসছে আর মুড়ি চিবুচ্ছে। বাস টেকের হাট ষ্টেশনে থামতেই মেঘের মতো কালো হয়ে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ শ্রমিক এসে আমাদেকে হামলা করলো। এরা সবাই বাসমালিক সমিতির লোকজন। বাস থেকে কেউ নামছেনা দেখে তাঁরা ই বাসে উঠে হামলা শুরু করে দিলো। আমি একটা ছোট খাট সাইজের মানুষ হওয়াতে দুই চারটা কিল গুতা খেয়ে কোন মতে চিপাচাপা দিয়ে বের হয়ে সামনে ১টা বাস পেয়ে উঠে পালিয়ে গেলাম।
কোনমতে হয়ে মাঝিকান্দি লঞ্চঘাট এসে উপস্থিত হয়ে একটা শান্তির নিশ্বাস ফেললাম। মাথাটাকে রিফ্রেশ দেবার ট্রাই করে কিছুটা স্বার্থক হলেও বারবার হাতটা পাছার ওখানেই যায়। কারন ওখানেই ২টা পাকা বাঁশের বারি লেগেছিল। এই ঘাটে আমার মুখ পরিচিত(লঞ্চ চালক) এক কাকা আছে,আমি যতোবার ই এই ঘাট হয়ে যাই কিছুক্ষন দেরি হলে ও সেই কাকার লঞ্চে করে যাই। তাই আজও তাকে খুজছি এবং ভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলাম। তবে তাঁর লঞ্চ আরো একটা লঞ্চের পরে। তবু ও আমি অপেক্ষা করে তাঁর লঞ্চেই যাবার জন্য বসে আছি। কারন একটাই উনি আমাকে সুন্দর নদী ভ্রমনের গল্প বলে। আর আমিও যেহেতু এই রুটে একা একা চলাচল করি তাই এই সময়টাতে উনার সাথে গল্প করতে বেশ ভালোই লাগে।
নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষন পরে যাত্রা শুরু হবার পর নদীর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করলাম। চারপাশে সব কিছু দেখে খুব আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই হালকা বাতাস প্রচন্ড বাতাসে পরিবর্তন হয়ে গেল। হালকা বৃষ্টি বেড়ে সেটা হয়ে গেল প্রচন্ড ভারী বৃষ্টি।
লঞ্চ এর সেই কাকা কাকা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন কি ব্যাপার সিগারেটের প্যাকেট শেষ নাকি? বেশি থাকলে আমাকে ও একটা দাও।
আমি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাকা নদীর অবস্থা কি বেশি খারাপ নাকি?
তিনি তেমন একটা জবাব দিলেন না। শুধু একটু হাসলেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হলো দমকা হাওয়া। কাকার লাল চোখ দেখে আমি ভীষন ভয় পেয়ে গেলাম। আবারও যে জিজ্ঞেস করব, সেই অবস্থাও নেই। কিছুক্ষন পর দেখি লঞ্চ একটা চরের সাথে ভিড়েছে। আমাকে বললেন এখান থেকে নড়বানা। আমি না আসা পর্যন্ত চুপচাপ এখানে বসে থাকো।
আমি লঞ্চ মাস্টারের রুমে গেট লাগিয়ে বসে আছি। লঞ্চের চালক মানে কাকা বলে গেছেন, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতে, আমি জানি না। একটু পর শুরু হল ঝামেলা, একজন করে মানুষ আসে আর লঞ্চ চালকের খোঁজ না পেয়ে ইচ্ছেমত গালি দিয়ে চলে যাচ্ছে। এই ধরনের গালি কেউ কখনও শুনেছে কিনা আমার জানা নেই।
এইদিকে লঞ্চের স্টাফরা সবাইকে শান্ত হয়ে বসতে বলছে। আরো বলল, সবাই যেন যার যার ধর্ম মতে প্রার্থনা করে এবং গালাগালি না করে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। বাইরে বৃষ্টির চাইতে লঞ্চের ভেতরের গালি বৃষ্টি আমার কাছে বেশি ভয়ংকর বলে মনে হলো।
সবার একটাই কথা, এই শালা লঞ্চ ড্রাইভার কই? ওরে মাইরা ফালামু ইত্যাদি আরো অশ্রাব্য কটু কথা।
কিছুক্ষন পরে কাকা ফিরে এলেন। আমি তাকে দেখে হাফ ছেড়ে বাচলাম। তিনি এসেই একটা সিগারেট চাইলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাকা ঘটনা কি? আমাকে একটু বলেন তো?
তিনি আমার দিকে চেয়ে কিছুক্ষন পর বললেন, তোমরা লেখাপড়া জানা মানুষ, তারপরও তোমাদের বুঝাইতে আমার লজ্জা লাগে। তারপরও যদি কেউ না বুঝার ভান করে তাইলে কি আর করা? এখানে যারা গালাগালি করছে, তাদের সবাইরে বুঝানো হইছে কেন লঞ্চ যাইতেছে না। ঐ যে দুরে ঘাট দেখা যাইতেছে, তারপরও কেন এই ছোট্ট অংশটুকু পার হইতে পারতেছি না।
আমি চোখে প্রশ্ন নিয়ে চুপচাপ চেয়ে রইলাম। কাকা বলে চললেন, এই লঞ্চ লম্বায় ৬০ ফুটের কম, আর নদীর ঢেউ লম্বা ৬০ ফুটেরও এর বেশি। এর উপর আবার বাতাস। এখন তো ঢেউ আরো বেশি বড়। ঈদের ভীড়ে লঞ্চে প্রচুর মানুষ। এদিকে ইঞ্জিনে লোড পড়তাছে। তাই কিছুটা সমস্যা দেখা দিছে। এখন ইঞ্জিনের ব্যাপারে পুরা নিশ্চিত না হইয়া রওনা দিলে এক্সিডেন্ট হবার সম্ভবনা অনেক বেশি। তখন যারা চিল্লাচ্ছে, তাদের মত কিছু খামখেয়ালি পশুর সাথে সাধারন মানুষেরও প্রান যাবে। আমার কি? আমি অবস্থা খারাপ দেখলে নদীতে লাফ দিয়া সাঁতার কেটে পাড়ে উঠুম।
আমি কাকাকে মাথা ঠান্ডা করতে বললাম। বললাম, সাধারন মানুষ এই সব কিছুই বুঝে না। তাছাড়া পাশ দিয়ে বাকী লঞ্চগুলো যেতে দেখে ওরা আরো বেশি ক্ষিপ্ত। আইচ্ছা কাকা এই যায়গাটা এতো রিস্কি কেনো?
-বাপুরে এখন কোন প্রশ্ন করিসনা মাথা ঠিকনাই দেখা যাবে তোকে ও গালি টালি দিয়ে দিতে পারি।
কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন শোন পদ্মার স্রোত যাবার মতো জায়গা শুধু এটুকুই আছে, বাকী সব তো চর পড়ে গেছে। এইখানে এত স্রোত আর ঢেউ। এইটা নিয়া তো হালার সরকারের কোন মাথা ব্যাথা নাই।
হঠাৎ একজন স্টাফ এসে বলল, যে ইঞ্জিন এবার ঠিক হইছে। এবার ছাড়া যায়। আল্লাহর নাম নিয়ে কাকা লঞ্চ ছেড়ে দিলেন। কিছুক্ষন পর আমাকে বললেন, এই ছেলে ব্যাগ রেখে যাও। একদম সোজা উপরে গিয়া ঠিক আমার মাথা বরাবর বসবা। কাউরে কিছু বলার দরকার নাই। কেউ জিজ্ঞেস করলে আমার কথা বলবা। মাঝখানে বসবা। আর লঞ্চ যদি হেলে পড়ে তাহলে তার উল্টা দিকে ঝাপ দিবা, বুঝছ?? এখন তাড়াতাড়ি যাও।
আমি দ্রুত সেখানে গিয়ে বসে পড়ি। কিছুক্ষন পর দেখি আরো একজন আমার পাশে। আচমকা বড় ঢেউ এসে বাড়ি দেয় লঞ্চে। লঞ্চের ভেতরে পানি ঢুকে। মানুষ শুরু করে চিল্লাচিল্লি আর কান্নাকাটি। আমি ভয়ে পাশের লোকটাকে জড়িয়ে ধরি। ওদিকে আনসার বাহিনী নিচে সবাই মাইরের ভয় দেখাইয়া সবাইকে শান্ত করে নিচে বসিয়ে রাখছে। হ্যান্ড মাইক দিয়ে অনাবরত সবাইকে নিজ নিজ যায়গাতে বসে থাকার জন্য অনুরোধ করেই যাছে। এদিকে আমি আম্মু আব্বুর কাছে ফোন করে দোয়া করতে বলেছি। আম্মু ছাগল মানত করে একাকার অবস্থা করে ফেলেছেন। ওদিকে বাবা ও নাকি সবাইকে নিয়ে (মাগরিব বাদ) ছেলের জন্য দোয়া করতে বসে পড়েছেন।
আল্লাহ অশেষ রহমতে কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই অংশটা পাড়ি দিয়ে ঘাটে চলে এলাম। সবার দোয়ায় আল্লাহর অশেষ রহমতে সেদিন বেঁচে গেলাম।
সারারাত ঘুম হয়নি, সকালের দিকে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে ফেবুতে ঢুকে দেখি খারাপ নিউজ। পিনাক-৬ নামে একটা লঞ্চ ডুবে গেছে। সাথে সাথে ফোন দিলাম সেই লঞ্চ ড্রাইভার কাকার কাছে। কোন ফাঁকে যে ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল আর চশমাটা ভিজে গেল তা নিজেও টের পাই নি। আমি আবার নাম্বার টা চেক করলাম, হ্যাঁ- এটাই সেই কাকার নাম্বার। পিনাক-৬ এর ড্রাইভার ছিলেন তিনি। খুব জানতে ইচ্ছে করে কাকা, আপনি কি সত্যি লঞ্চ কাত হবার পরে লাফ দিতে পেরেছিলেন? আপনার মুখে শুনেছিলাম ডুবুড়িরা ডুব দিয়ে ডুবে যাওয়া লঞ্চে ঢুকে পেট কেটে দেয়, কাকা ওরা আপনার পেট কেটে দেয় নি তো?
আমি সত্যি অনেক কেঁদেছি। ভীষন কেঁদেছি। আমার সাথে আপনার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্তু কেন জানি আপনার মুখটা ভুলতে পারছি না।