বিতর্কের শুরু গত ১৪ই মার্চ ১৪২ প্রবাসি বাংলাদেশী ইতালি থেকে দেশে ফেরার পর। আগেরদিন রাতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এদের দেশে আসার ব্যাপারে আতংক ছড়ায়। অনেককেই দেখেছি এই সময়ে এদের দেশে কেন ঢুকতে দেয়া হচ্ছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে আমি মনে করি এই বিপদের সময় দেশের নাগরিকদেরকে দেশে ফিরতে দেয়া দোষের কিছু না।কিন্তু যেহেতু ইতালীর মত 'উচ্চ সংক্রমিত' দেশ থেকে আসছেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদেরকে যথাযথ পর্যবেক্ষনের মধ্য দিয়ে ছাড়া হবে সেটাই বাস্তবতা। যেমনটা করা হয়েছিল চীন ফেরত ৩০০ জনের ক্ষেত্রে।তারা দুই সপ্তাহ ঐ হজক্যাম্পেই ছিলেন। তখনও হজক্যাম্পের পরিবেশ সুযোগ সুবিধা আহামরি কিছু ছিল না। তারা গাদাগাদি করে গন বাথরুম ব্যাবহার করে একরকম হাজতবাস মেনে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। এবং তখন কোন বিক্ষোভ বা গালাগালি যেমন শুনিনি , তেমনি কেউ তাদের নিয়ে 'নবাবজাদা' বা অন্য কোন মন্তব্যও করেনি। আমার জানামতে চীন ফেরত ঐ ফ্লাইটে অধিকাংশ শিক্ষার্থী হলেও সেখানে বেশ কয়েকটি পরিবারের সংগে শিশুরাও ছিল।তখন ঐ মানুষগুলো তাদের পরিবার ও দেশের কথা ভেবে তাদের সাময়িক কস্ট মেনে নিয়েছিল।
কিন্তু গত শনিবারে দেখা গেল ঠিক উল্টো চিত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিডিওতে দেখলাম তাদের কেউ কেউ অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে,পুলিশ ভাইদের কে ধাক্কা দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার চেস্টা করছে, কিন্তু আমাদের আইনশৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনি অত্যন্ত ধর্য্য সহকারে তাদেরকে নিয়ন্ত্রন করার চেস্টা করছে। শেষ পর্যন্ত সব পরিক্ষা নিরিক্ষা শেষে ঐদিন রাতে তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার শর্তে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়।
যথারীতি এই ঘটনায়ও আমাদের সচেতন বাংগালি ও বুদ্ধিজীবি শ্রেনী তিন ভাগে ভাগ হয়ে তাদের নসিহত প্রসব শুরু করে দিলেন। তাদের মধ্যে একগ্রুপ সরকার কেন এদের দেশে ঢুকতে দিল, সেটা নিয়ে মুন্ডুপাত করা শুরু করলো। তাদের যুক্তি এরা সুবিধাবাদি, দেশের অসময়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে নিজের সুবিধারজন্য। এখন ঝামেলায় পরছে তাই বাচার জন্য দেশে আসছে, এখন এদের জন্য ১৬ কোটি মানুষকে কেন সরকার ঝুকিতে ফেলছে? এরা আবার দেশে ঢুকে গালাগালি করে , ওদেরকে লাথি মেরে দেশ থেকে বের করে দেয়া উচিত।
আরেক গ্রুপ এদেরকে 'রেমিটেন্স যোদ্ধা' হিসাবে কেন যথাযথ সম্মান দেয়া হয় নাই। এদের টাকায় পদ্মা সেতু হচ্ছে ,তাদের পাঠানো টাকায় দেশ চলে ইত্যাদি বলে সরকারের মুন্ডুপাত করছে।
আর সুবিধাবাদি গ্রুপের মতে, সরকার করোনা নিয়া ছেলে খেলা করছে। একবার বলে কোয়ান্টারাইনে রাখবে, আবার বাড়ি পাঠায়। তাদের কোন ডিসিশন নাই, মিথ্যা কথা বলে মানুষকে বোকা বানাচ্ছে, ইত্যাদি।তবে মজার ব্যাপার হল, এই গ্রুপের কোন নিদিস্ট মতামত বা পরামর্শ নাই এরা যখন যেমন হাওয়া সেই রকম কথা লিখে বা শেয়ার দেয়। কখনো এদের দেখবেন শেয়ার দিসে '১৫-২৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় করোনা সার্ভাইব করেনা, সো ভয়ের কিছু নাই' । আবার দুই ঘন্টা পরেই লিখবে 'করোনাকে সরকার হালকাভাবে নিচ্ছে, এখনও কেন স্কুল বন্ধ হয়না,এয়ারপোর্ট খোলা কেন, ইত্যদি।
এবার আসি যাদেরকে হোম কোয়ান্টারেইনে থাকার শর্তে ছাড়া হয়েছিল সেই সব সম্মানিত দেশ ফেরত 'মাননীয়' দের প্রসংগে। নিউজে পাওয়া খবরে জানা গেছে, উনারা পিকনিক থেকে শুরু করে বিয়ে শাদি, বাজার ঘাট সবই করছেন হোম কোয়ান্টারেইনের নিয়ম মেনেই!! তাহলে বুঝুন অবস্থা, ইউরোপ থাকেন আর মহাকাশে থাকেন বাংগালি আসলে সভ্য হবে না কোনদিনও। প্রথম আলোর কমেন্ট সেকশনে দেখলাম একজন দেখলাম লিখছে - ' এস এস সি ফেল , অস্টম শ্রেনি পাস এই প্রানীগুলা যত উন্নত দেশেই থাকুক না কেন, এদের স্বভাব চেন্জ হবে না"। সত্যি বলতে আমি কারো শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কটাক্ষ করতে চাই না, কিন্তূ এদের দেশে আসা , হজ্ব ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে অস্বীকৃতি জানানো,বিক্ষোভ/গালিগালাজ, তারপর হোম কোন্টারাইনের নিয়ম ভেংগে পিকনিকে যাওয়া দেখে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এরা আসলে 'স্টুপিড'। এদের নিজের পরিবার, সমাজ, দেশ কোন কিছুর ব্যাপারে নুনতম কান্ডজ্ঞান থাকলে , এরা দেশে আসার পর যা যা করছে তার কোনটাই করতো না। আসলে নিজেকে নিজে 'রেমিটেন্স যোদ্ধা' বললে আপনাকে আমি বলবো যোগ্যতা থাকলে দেশে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়। আর আপনি যে রেমিটেন্স পাঠাইছেন ঐটা দিয়ে আপনার পরিবার চলছে। এদেশের একজন রিক্সাআলাও তার শ্রমের টাকায় চলে , আপনার রেমিটেন্সে না । দেশে এসে নাক সিটকাবেন,দেশের নিয়ম শৃংখলাকে বৃদ্ধাংগুলি দেখাবেন, নিজের পরিবার সহ পুরোদেশকে ঝুকিতে ফেলবেন আর তার বিপরীতে সম্মান আশা করবেন কিভাবে। আপনাদের যদি নুনতম দায়িত্ব বোধ থাকত, তাহলে এগুলো করতেন না।কই গত বছর ডেংগুর সময় তো আপনাদের ঝাকে ঝাকে দেশে আসতে দেখি নাই, তখন কোথায় ছিল আপনাদের নাড়ির টান ? নিজেদের বাবা মা, পরিবার পরিজনকে বিপদে রেখে তখন দিব্যি আরামে কাটিয়েছেন বিদেশে আর দেশের সরকার এবং দেশকে গালি দিছেন। এখন যখন বিদেশে বিপদে পরছেন , তখন সরকার আপনাদের ফিরিয়ে আনছে মানবিক কারনে, আর আপনারা দায়িত্বহিন আচরন করে পুরো দেশটাকেই ঝুকিতে ফেলছেন। অথচ চায়না ফেরত ঐ মানুষগুলো নিয়েতো কেউ কোন বাজে কথা বলতে পারেনি। তারাও তো এই অব্যস্থাপনা, অসংগতির ভেতরেও সবার স্বার্থে নিজেদের সাময়িক কস্ট মেনে নিয়েছিল।
তাই সংশ্লিষ্ট প্রবাসি ভাইদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আগে নিজের দেশ, দেশের নিয়মকে শ্রদ্ধা করতে শিখুন। দেখবেন নিজেও সম্মান পাবেন। এই দেশের সকল অনিয়ম অব্যাবস্থাপনার মুলে রয়েছে আমাদের নিয়ম না মানার প্রবনতা ,যেটা থেকেই উত্পত্তি সকল দুর্নীতি ও অন্যায়। তাই আসুন সবাই মিলে নিয়মের মধ্যে থেকে 'করোনা' ও 'দুর্নীতি' এর মত দুর্যোগ মোকাবিলা করি।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:৩৫