শতবর্ষী কৃষ্ণচূড়ার নিচে ফুলগুলো ঝড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। পদহীন ঝঞ্ঝা খানিকটা জুড়ে। পুরোনো মালবাহি বগি জীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে অনেক দিন ধরে। পুরো স্টেশনে কৃষ্ণচূড়া আর ঘাসের সবুজ রঙ মিলে মৌন একটা সৌন্দর্য।
সন্ধ্যে হয়ে এলো। কৃষ্ণচূড়ার নিচে দাড়িয়ে সজল। ফিটফাট ফরমাল ড্রেসআপে প্লেইন কালো জুতো। মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে।
স্টেশনের মূল ফটকে একটি হারিকেন জ্বালছে। ডান পাশের হাতলহীন চেয়ারে বসে ট্রেনের অপেক্ষায় সজল। নাইক্ষণছড়ী এলাকার ফরেস্ট অফিসার সজল। মাস তিন বা চারেক পর পর বাড়ি যেতে হয়। নয়টার ট্রেনে চড়লে ভবানীজীবনপুর পৌঁছতে সকাল হয়।
সজল চুপচাপ স্বভাবের। সে ভাবতে পছন্দ করে। এটা সেটা অনেক কিছু। দূর থেকে সজল যে বেঞ্চিতে বসে আছে ভাবলে দেখা যায়, তিন জনের একটা বেঞ্চি সজল একটা বসে। পেছন থেকে একটু বড় চুলো কেউ বসে আছে। বাম পা একটু পর পর নাড়াচাড়া করছে। অল্প কিছু প্যাসেঞ্জার পুরো স্টেশনে। খুব একটা সাড়া শব্দ নেই। মাঝে মাঝে ঘন্টা বাজিয়ে সময় জানিয়ে যায় স্টেশন পিয়ন। ট্রেনের শব্দ, চলে যাওয়া, ট্রেনের জানালাগুলো সর্বোপরী সামনে দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার মধ্যে ব্যতিক্রম ধরণের ভালো লাগা আছে।
ট্রেনে ছাড়লো, ঘড়িতে সময় রাত্রি ৯টা বেজে ১৮। ডান পাশের সিট ফাঁকা। সামনে দুজন প্যাসেঞ্জার। সব মিলিয়ে সামান্য একটু হই-চই। বাম পাশের সিটের চারজন রাজনীতির ব্যাপার স্যাপার নিয়ে তুঙ্গে। তখন ৫৮’র ভাষা আন্দোলন নিয়ে দেশ প্রায় রেডিওর মূল উত্তেজনা।
চোখ লেগে এলো সজলের। তখনো আবছা তর্ক-বিতর্ক কানে ভাসছে। তাও অল্প অল্প। ক্ষণিকের মধ্যে সব কিছু কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। চোখ খুলতেই সামনে বসা দুজন লোক নেই। বাম পাশের সীটের লোকজনও নেই। ভর দেয়া সীট থেকে সজল দাঁড়িয়ে দেখে পুরো বগিতেই কেউ নেই। বাম পাশে রাখা ব্যাগটা চেপে ধরে সজল চশমাটা পরিষ্কার করে।
ভোর হয়ে এলো। ট্রেনের শব্দের সাথে আবছা আজানের শব্দ আসছে। রাতের তিমির থেকে দিনের আলো স্পষ্ট হয়ে এলো। ট্রেনের জানালার ফাঁকে সুন্দর গ্রাম। সাপের মতো আঁকাবাঁকা খাল হয়ে ছোট ছোট কুড়ে ঘর। কোথাও কোথাও পাশে একটা গোয়ালঘরও। কিন্তু কোথাও কেউ নেই।
ভবানীজীবনপুর এসে ট্রেন থামলো। মানব শূন্য পুরো এলাকা। অবাক চোখে এগিয়ে যায় সজল। যে স্টেশন থেকে বের হলে রিক্সা চালকদের ডাকাডাকিতে বিরক্ত হতেন, সেখানে রিক্সাগুলো লাইন ধরে পড়ে আছে। কোথাও কেউ নেই। উপান্তর না দেখে হেঁটে চলা। এগিয়ে গিয়ে সামনে মোহন চাচার চায়ের দোকান। শেখ মুজিব, পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে কতো কথা। শুকনো বনরুটি ঝুলছে, চায়ের পানি তাপ দিচ্ছে, আগুনও জ্বলছে, কিন্তু কোথাও কেউ নেই।
ঠুকঠুক জুতোর শব্দ। হেঁটে যাচ্ছে সজল। বাম কাঁধে ব্যাগ। দূর থেকে দূরে চলে যায় সজল। সাঁকু পার হলে হাদারি বাজার। বাম পাশে বারেকালা প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটু সামনে সবজির দোকান, মসজিদ, কৃষ্ণধন কাকার নাপিত ঘর, রাস্তার পাশে বসে থাকা দোকানগুলো, চায়ের কাপের শব্দ, রাশু পাগলার খিলখিলিয়ে হাসা, মাছ বাজারের হই-চই, কিছুই নেই। কোথাও কেউ নেই। পরিস্কার আকাশ।
স্কুলের সামনের রাস্তার খাল পার হয়ে সজলের বাড়ি। সাঁকু পার হতে হয়। সাঁকুর মাঝে দাঁড়িয়ে সজল।
কানে কি যেন ভাসছে, কেউ কিছু চাইছে মৃদু স্বরে। টিকিট প্লিজ! টিকিট দেখিয়ে সজল ডান-বাম তাকিয়ে চশমার ফ্রেম মুছে। ট্রেন ভবানীজীবনপুর আসতে তখনো কিছু সময় বাকি।