উপন্যাসঃ চন্দ্রাবতীর চোখে কাজল রং
এক খন্ড কাঁচ,কাঁচে জমে থাকা কুয়াশা-উপন্যাসের সম্পূর্ণ প্লটটাকে এই নিরিখে রাখলে সুবিধা হয়। পাঠ পরবর্তী জড়ো হওয়া ভাবনাগুলো কাছাকাছি পাওয়া যায়। হাতড়াতে হয় না।
বিখ্যাত 'বিভীষিকার নরকে উদভ্রান্ত আত্মিক' এডগার এলান পো' সাহিত্য সমালোচনার ধরন সর্ম্পকে বলতে গিয়ে বলেছিলেন-সমালোচনা হবে-তাঁর ভাষায়: 'The curt, the condensed, the pointed, the readily diffused' (স্বল্পভাষ্য, ঘনবদ্ধ, সুনির্দিষ্ট অথচ সাবলীলভাবে বিস্তৃত)। উদাহরণটা স্মর্তব্য এ কারনে যে,এর কোনটাই আমার দ্বারা হচ্ছে না। কারণ আমি গ্রন্থ সমালোচক নই। তাই, যারা পাঠ করবেন,তারা অধমের বালখিল্যতায় উদ্বাহু হবেন না ।
আব্দুর রাজ্জাক শিপনকে ব্লগে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। স্বনামধন্য ব্লগার। তবে আরাশি আমার অগ্রজ,শ্রদ্ধেয়। তাঁর লেখুনীর সাথে পরিচয় অন্তত: বছর দশেক আগে থেকে। যখন আমি মফস্বলের উদ্দাম কিশোর। তাই আরাশি যখন উপন্যাস লিখবেন, সে উপন্যাস সর্ম্পকে আমার ঐকান্তিক আগ্রহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর সেই আগ্রহ থেকেই বইটি সংগ্রহ করা। আসল কথায় আসা যাক।
Over fined intellect বা অতিসূক্ষ্ম ধীসত্তা বলে একটা কথা প্রচলিত। আমি আমার সমস্ত চেতন এবং ইন্দ্রীয় সজাগ রেখেছিলাম উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে। তাই শুরুতেই বলেছি 'এক খন্ড কাঁচ, কাঁচে জমে থাকা কুয়াশা' হচ্ছে 'চন্দ্রাবতীর চোখে কাজল রং' উপন্যাসটি। উপন্যাসের ফ্ল্যাপে শ্রদ্ধেয় আরিফ জেবতিক এর সারবত্তা যেভাবে ফুটিয়েছেন সেটা অসামান্য সুন্দর,যথেষ্ট। প্রতি পূর্ণিমায় মজিদ হাজীর বাড়িতে অদ্ভূত এক ঘটনা ঘটে চলে। ছাদে ঠক ঠক, সূত্রহীন, ছন্দময় সে শব্দ। চঞ্চলা নৃত্যপটিয়সী কোন পরীর কান্ড; নাকি ভিন্ন কোন অর্থ বয়ে বেড়ায় এ অপার্থিব শব্দে! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ক্ষুধিত পাষান' গল্পের কথা মনে আছে? অশরীরি কোন অপ্সরাদের নৃত্যকলার ঝুম ঝুম শব্দ! সেটাই মনে করিয়ে দিয়েছিল ।
আসলে উপন্যাসের মূল স্রোতটা দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে বয়ে গেছে। প্রথমতঃ মজিদ হাজীর আচানক খট খট শব্দ বিষয়ক জটিলতা। দ্বিতীয়তঃ চন্দ্রাবতীর প্রতিবাদী মানস আর কল্পনাশ্রিত দু:খের সারথির সাথে বহমান সংলাপ। দু'টোকে একই বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়েছেন ঔপন্যাসিক।
জন্মেই মা মরা চন্দ্রাবতী, তরতর করে বেড়ে ওঠে। হয়ে যায় পূর্ণ প্রবাহমান। যৌনতা বোঝে,নৃশংসতা বোঝে আর বোঝে নিজের অপাক (তার চিন্তায়) অতীত। যেখানে চন্দ্রাবতী অপরিণত বয়সে কাছের মানুষ দ্বারা যৌন নিপীড়নের স্বীকার। বয়স্যে মোবাইল ফোনিক বিড়ম্বনা আর বান্ধবীর ইভটিজিংয়ের স্বীকার হওয়া-এ সব অনিয়মের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। জেগে ওঠে, জাগিয়ে তোলে। কখনো প্রেমিকা; কখনো দ্রোহী। এখানে চন্দ্রাবতী নিজে মূখ্য ভূমিকায় না থাকলেও সে বান্ধবী তিথী'র পাশাপাশি হয়ে ওঠে বিক্ষুব্ধ আর সংগ্রাম মুখর।
আমাদের সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থার কিছু নোংরা দিক উঠে আসে উপন্যাসে। ইভটিজিং,শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি এইসব সামাজিক ব্যাধির যে ঘৃণ্য দৃশ্যাবলী আমরা দেখে অভ্যস্থ; চন্দ্রাবতীর পাতায় পাতায় তারই প্রতিবাদী স্বাক্ষর রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গল্পকে টেনে নেবার প্রয়াস। ঘটনার ক্রমধারা ক্রোনোলজিক্যালি । মজিদ হাজীর প্রতি পূর্ণিমা রাতে ছাদে পরীর শব্দ শোনা, তার বদান্যতার সকল গুন,দানশীলতা তাঁকে দারুনভাবে মূর্ত করে তুলেছে। গল্পের কোন চরিত্রই আরোপিত ছিল না। স্বপ্রতিভ বিচরনে প্রত্যেক চরিত্রই স্বাতন্ত্র্য ছিল। সম্প্রতি পত্রিকায় হুমায়ূন আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার পড়লাম। তার উল্লেখযোগ্য একটা অংশ এখানে প্রনিধানযোগ্য। হুমায়ুন আহমেদ তলস্তয়,দস্তইয়েভস্কি'র উদাহরণ টেনে চরিত্রের দৈহিকরুপ বানানো প্রসঙ্গে বলেছেন যে, তলস্তয় বা দস্তইয়েভস্কি চরিত্রকে ফোটানোর জন্য তার ঠোঁট কেমন,চুলের রঙ কেমন,গোঁফ কিরূপ ইত্যাদি বর্ননা দিতেন। কিন্তু,হুমায়ূন আহমেদ কখনো চরিত্রের দৈহিক বর্ননা দেন না। বরং সংলাপের মাধ্যমে,ভঙ্গির মাধ্যমে পাঠকের হাতেই ছেড়ে দেন চরিত্রকে চিনে নিতে,অবয়ব ভেবে নিতে। আরাশি সে রকই করতে চেষ্টা করছেন। সফল হয়েছেন কি না, সেটা আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
গোটা উপন্যাসের মোক্ষম একটা মূর্হুত হয়ে উঠেছিল 'চন্দ্রাবতী এবং দু:খের সারথির চমৎকার কথোপকথন। গল্পের ভিতরে গল্প টেনে নেয়ার এই ব্যবস্থাটুকুন সুন্দর করেই আরাশি করে গেছেন। সেখানে প্রেম আছে,অভিমান আছে, ক্রন্দসী প্রিয়ার রূপ আছে। একই সাথে পাশাপাশি পিতৃদেবের ভালাবাসা এবং সন্তানহীন মাজেদা'র স্নেহের পরশ আছে। সমস্ত উপন্যাস হচ্ছে 'অবদমিত সহজ জীবনসত্তার প্রতীক'।
লেখা দীর্ঘ করলে লেখকের দায় বাড়ে, তাই উপসংহারের পথে হাঁটতে হাঁটতে কিছু বিভ্রমের কথা বলে যাই।
গল্পের টান টান মূর্হুত ছিল মজিদ হাজীর ক্যামেরায় পরীর ছবি তোলা অংশটা। দুরুদুরু বুকে সেটা দারুন ফিনিশিংসহ লেখক ঘটিয়েছেনও বটে। কিন্তু, আমি ব্যক্তিগতভাবে ইঙ্গিত গল্পই পছন্দ করি। সেজন্য, শেষ মূর্হুতে যদি পরীর ঘটনাটাকে এভাবে বর্নিত না করে একটা রহস্য সৃষ্টির মাধ্যমে সন্দেহের তীর তাঁক করে রেখেই গল্পের সমাপ্তি হতো,তবে মন্দ হতো না। আরেকটা বিষয় হলো, আপনি/তুমি বিষয়ক। হয়তো মূদ্রণ প্রমাদ। বিষয়টা পরবর্তী সংস্করণে সংশোধনযোগ্যই মনে হয়। বানানগুলোও মূদ্রণ প্রমাদই ধরে নেয়া যাক। গল্পের মধ্যে কাজল রংয়ের বিষয়টা ষ্পষ্ট করতে পারলাম না বলে আমার ব্যর্থতা স্বীকার করছি। মোটাদাগে কাজল চোখেই পড়েনি । হয়তো মনোযোগি পাঠের মধ্যেও ব্যাঘাত ঘটেছে।
বলছিলাম 'এক খন্ড কাঁচ, কাঁচে জমে থাকা কুয়াশা'র কথা। গোটা প্লটটাকে স্বচ্ছ একখন্ড কাঁচ ধরি, আর জমে থাকা কুয়াশা হিসেবে মজিদ হাজীর উদঘাটিত পরী তত্ত্বটাকে অপ্রস্তুত উল্লেখের কথাই ধরি। লেখকের নিশ্চয়ই যৌক্তিক জবাব রয়েছে এর পক্ষে। নইলে কাঁচে জমে থাকা কুয়াশা পরিষ্কার হবে কেমন করে?
পরিশেষে, প্রিয় নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের সুন্দর প্রচ্ছদ আঁকার কথা না বললে কমতি থেকে যায়।
প্রিয় আরাশির জন্য শুভ কামনাসহ-