//** লেখাটা একটু বড় হয়ে গেছে।
//** বানান ভুল থাকতে পারে, ভুল বানান গুল জানালে উপকৃত হব।
ছোট বেলার কিছু কিছু কথা মনে পরলে এখনও বেশ হাসি পাই। চিন্তা ভাবনা এবং কাজ কর্ম কি পাগলের মতই না ছিল তা এখন বুঝি।
তখন আমি খুব সম্ভবত ক্লাস টু কিংবা থ্রি-তে পড়ি, আমার আম্মার সাথে গিয়েছিলাম কোন এক মুরুব্বিকে দেখতে উনি হলি ফেমেলি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, উনি ছিলেন একা একটা রুমে। আমারা যাওয়ার সময় আম্মা কিছু ফল এবং হরলিক্স কিনে ছিলেন। উনার রুমে ঢুকার পরে আমি যথারিতি কিছুক্ষন চুপ চাপ বসে ছিলাম পাঁচ দশ মিনিট পরে একটু একটু করে নড়া চড়া শুরু করলাম, প্রথামে উনার রুমটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখা শুরু করলাম। মুরুব্বি আমাকে দেখে বেশ খুশি হয়েছিলেন, উনি আমার আম্মাকে বললেন আমাকে কিছু ফল এবং আনান্য আত্মিয় স্বজনরা যা নিয়ে এসেছিল সেখান থেকেও কিছু খেতে দিতে বললেন। আনান্য আত্মিয় স্বজনরা যা নিয়ে এসেছিলেন সেগুলা দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম এখানে এত ভাল ভাল খাবার দাবার পরে আছে আমার প্রিয় ফলগুলা কমলা, আপেল আর কলা কিন্তু খাওয়ার লোক কেউ নাই? কিছু ক্ষন পরে আমার এক ফুপু আসলেন উনার ছেলে কে নিয়ে। আমি আমার সমবয়সি ফুপাত ভাইকে পেয়ে ভিষণ খুশি হয়েছিলাম, যথারিতি আমার ফুপাত ভাইও। প্রথমে আমার ফুপাত ভাই আর আমি রুমের মধ্যেই লাফা লাফি শুরু করে দিলাম, এইসব দেখে আমার আম্মা আমাদেরকে বললেন রুমের বাইরে করিডোরে যেয়ে খেলা করতে এবং যথারিতি বললেন অন্য কোথাও না যাতে। প্রথমে আমি আর আমার ফুপাত ভাই করিডোরে দৌড়া দৌড়ি করতে করতে হঠাৎ আবিস্কার করলাম একটু দুরেই দুই বিল্ডিং এর মাঝে বেশ সুন্দর ঘাস যুক্ত ফুলের বাগান, আমরা ঐখানে যেয়ে বেশ কিছুক্ষণ খেল ধুলা করলাম এবং ঐ দিনের সময়টাকে বেশ উপভোগ করলাম। তারপর আবার কেবিনে ফিরে এসে যথারিতি আবার কিছু খাওয়া দাওয়া করলাম এইবার আর খাওয়ার আগে কারো কাছে জিজ্ঞাসা করার কিংবা কাউকে কিছু বলার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করলাম না, নিজেরাই (আমি আর আমার ফুপাত ভাই) নিয়ে ইচ্ছামত খাওয়া শুরু করে দিলাম। কিছুক্ষন পর আমার আম্মা মুরুব্বি এবং অনান্য আত্মিয় স্বজন সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আমাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেন, চলে আসার সময় আমার একটু একটু মন খারাপ লাগছিল আমার সমবয়সি ফুপাত ভাইকে ছেড়ে আসার জন্য এবং এই রকম একটা ভাল আনন্দদায়ক জায়গা ছেরে চলে আসার জন্য। আসার পথে আমি আম্মাকে জিজ্ঞাস করলাম "আম্মা উনি (মুরুব্বি) এইখানে কি করেন? উনি কি সব সময় এইখানে থাকেন? আবার কবে এইখানে আসব? এবং আরো অনের প্রশ্ন"। বাসায় ফিরে আমার বড় বোনকে এবং অনান্য সদস্যদেরকে আমার বেড়ানোর মজার অভিজ্ঞতার কথা বললাম, সবাই একটু আঁড় চোখে আমাকে দেখছিল।
এর পরে কোন এক ছুটির দিনে আমার আব্বার কাছে আমার হাসপাতাল বেড়ানোর মজার অভিজ্ঞতার কথা বললাম এবং সেখানে আরো কি কি খাওয়া যায় এবং আনন্দ করা যায় সে সম্পর্কেও বললাম, আব্বা প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলেন পরবর্তিতে আমার কথা আরো মনযোগ দিয়ে শুনলেন। এবং আমার আব্বার সাথে কথা বলে বুঝলাম যে অসুস্থ হয় সেই শুধু হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর অসুস্থ ব্যেক্তিকে দেখতেই অনান্য আত্মিয় স্বজনরা খাবার দাবর নিয়ে যায়। দিন যায় সপ্তাহ যায় মাস যায় আমার মন থেকে আর হাসপাতালের মজার অভিজ্ঞতার কথা মুছে যায় না, বরং যতই দিন যায় আমার আরো হাসপাতালে যাওয়ার আরো আগ্রহ জন্মায়, উপরন্তু আমার মনে হতে থাকে ইস যদি কোন দিন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারতাম তাহলে কত মজাই না করতে পারতাম। এর পর একদিন আমার আব্বা আম্মাকে বলে বসি আমি হাসপাতালে ভর্তি হতে চায়, আমার বাসায় আর ভাল লাগে না, আমি হাসপাতালে ভর্তি হব। আমার আব্বা বলেন যারা অসুস্থ হয় তারাই শুধু হাসপাতালে ভর্তি হয়। আমি তখন আফসোস করে বলতে থাকি হায় হায় হায় আমি কেন অসুস্থ হই না। আমার এই রকম কথা বার্তা দেখে আম্মাত একদম থ হয়ে চুপ করে শুধু শুনছিলেন আর মনে মনে হয়তবা বলছিলেন হায় আল্লাহ আমার ছেলের একি হল? আব্বা তখন আমার মন থেকে হাসপাতালের ভুত দূর করার জন্য বললেন আমি হাসপাতেলে ভর্তি হলে আমাদের কোন আত্মিয় স্বজন আমাকে দেখতে আসবে না এবং কেউ আমার প্রিয় ফল আর খাবার নিয়েও দেখতে আসবে না কারন আমি সবসময় আনেক দুষ্টামি করি। আমি তখন আমার আব্বাকে আমার সব চাচা ফুপু নাম বললাম এবং আব্বার কলিগ যারা আমাকে আদর করতেন তাদের নাম বলে বললাম ইনারাত আমাকে দেখতে যাবেনই কোন ভুল নাই। তখন আব্বা বললেন শুধু আসুস্থ হলেই হবে না প্রথমে এলাকার ডাক্তারকে দেখিয়ে যদি রোগ না ভাল হয় তা হলে বড় ডাক্তারের কাছে পাঠাবেন তারপর বড় ডাক্তারকে দেখিয়ে যদি রোগ ভাল না হয় তখন হাসপাতালের ডাক্তারকে দেখাতে হবে তাতেও যদি রোগ ভাল না হয় তখন হয়ত বা হাসপাতালে ভর্তি করা যেতে পারে। আব্বার এই সব কথা শুনে আমার মনে হতে লাগল কবে আমি আসুস্থ হব আর কবেই বা আমি আরাম, আন্দদায়ক হাসপাতলে ভর্তি হতে পারব।
এর পর প্রাইমারি স্কুল লাইফ কেটে গেল হাসপাতালের ভুত আমার মন থেকে দূর হতে লাগল এবং অসুস্থতার কারনে সিক লিভ এর নতুন ভুত আমার মাথায় বাসা বাঁধতে শুরু করল। কিন্তু অসুখ আর হয় না, স্কুল কামাই দেওয়ার জন্য সিক লিভ আর পাই না। ক্লাস নাইন-এ পড়ার সময় চোখ উঠা রোগ শুরু হল, আমার ক্লসের আনেক বন্ধুর চোখ উঠার কারনে তারা কয়েক দিন স্কুল ছুটি পেল। আমি হতাশ হয়ে শুধু মনে মনে বলি আমি এতই হতভাগা আমার চোখও উঠেনা আমি স্কুল কামাই দেওয়ার সুযোগও পাই না। অবশেষে এল সেই অভাবনিয় চোখ উঠানোর সুযোগ, আমাকে আর আমার বড় বোন কে যেই স্যার প্রাইভেট পড়াতেন উনার চোখ উঠল, স্যার তখন কালো চশমা ব্যাবহার করা শুরু করলেন, আর আমাদেরকে যখন পড়াতেন তখন কালো চশমা খুলে রাখতেন আর চোখে যন্ত্রনা হলে উনার রুমাল দিয়ে চোখে হালকা করে বুলিয়ে নিতেন। স্যার যেহেতু রুমাল চোখে লাগাতেন, চোখ উঠার জিবানু রুমালে চলে আসবে এটাই স্বাভাবিক। একদিন স্যার ভুল করে উনার চোখ উঠা জিবানু যুক্ত রুমাল আমদের বাসায় ফেলে গেলেন আর আমিও গাধার মত সুযোগের স্বদব্যাহার করতে লাগলাম, স্যারের চোখ উঠা জিবানু যুক্ত রুমাল দিয়ে আমার চোখে কিছুক্ষন বুলালাম এবং যথারিতি পরের দিন সকাল বেলা থেকে চোখ অল্প অল্প লাল হওয়া শুরু হল, স্যার যখন পড়াতে আসলেন আমি ভদ্র ছেলের মত স্যারের রুমাল ফিরত দিয়ে বললাম স্যার আমার-ত চোখ উঠছে কালকে থেকে আমি পড়তে পারব না। স্যারের কাছে পড়া শেষে বাসাতে ঘোষনা দিয়ে দিলাম আমার চোখ ঊঠছে আমি আর পড়তে বসতে পারব না, স্কুলেও যেত পারব না। আমার এই রকম ঘোষনা দেখে আম্মা বেশ অবাক হলেন কিছুক্ষন পরে দেখলাম আমার বড় বোন আম্মাকে একাকি কিছু একটা বলছে, রাত্রের বেলা আব্বা অফিস থেকে ফিরতেই আব্বার কথা শুনে বুঝা গেল আমার চোখ উঠানোর পদ্ধতি উনারা বুঝে ফেলেছেন, আব্বাও ঘোষনা দিয়ে দিলেন চোখ ঊঠেছে ভাল কথা, টিভি দেখতে পারবে না, বাসার বাইরে যেতে পারবে না, হয় বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে না হয় পড়ার চেয়ার টেবিলে বসে থাকতে হবে, পড়ালিখা না করলেও চলবে। আব্বার এই সব শর্ত শুনে আমি বিছানায় শুয়ে থাকাকেই বেছে নিলাম। এক দিন যেতে না যেতেই আমি অনুভব করতে লাগলাম এ কোন বিপদ আমি ডেকে আনলাম, শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যাথা হয়ে যাচ্ছিল কত ক্ষন শুয়ে থাকা যায় আর এর মধ্যে চোখ উঠার কুট কুটানি ব্যাথাও শুর হয়ে গেছে। তখন চোখ উঠার এক মাত্র ঔষধ ছিল ঠান্ডা পানি দিয়ে বার বার চোখ ধোয়া। আল্লাহর রহমতে আল্প কিছু দিনের মধ্যেই আমি চোখ উঠা রোগ থেকে মুক্তি লাভ করি। এখনও এই সব ঘটনা গুলা মনে পরলে হাসি আর বলি হায়রে পাগল তুই কবে মানুষ হবি??
অনার্স-এ পড়ার সময় জীবনের প্রথম চাকরি পায়, পার্ট টাইম জব, ৬ ঘন্টা কাজ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত। আমারা ৬ ঘন্টার শিফট-এ ছিলাম চার জন, আমার সিনিয়র যারা ছিলেন তারা প্রায়ই একটু লেট করে আসতেন আথবা আমার মত জুনিয়রদেরকে একটু মেনেজ করে নিয় বলে দুই এক ঘন্টা আগে বারিয়ে পরতেন। মাঝে মাঝে সিনিয়র ভাইরা আবার আসতেনও না, পরের দিন স্যারকে বলতেন স্যার ফামেলি প্রবলেম ছিল। আমাদের স্যার কড়া রুল জারি করে দিলেন কেউ যদি ডিউটিতে না আসতে পারে তা হলে তাকে অবশ্য সকাল ৯:১৫ এর মধ্যে ফোন করে বলতে হবে। আমারও একদিন ছুটি নেওয়ার সখ হল কিন্তু ঘন্টা খানেক হলে চলবে না পুরা দিন ছুটি নিতে হবে। কি করা যায়? সেই দিনটা ছিল বুধবার আফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধা হয়ে গেছল, বাসায় ফিরে ভাত খেয়ে সোজা ঘুম দিলাম। সন্ধার পরে মনে হয় ৭টা ৮টার দিকে আম্মা আমাকে ডাকছিলেন পড়তে বসার জন্য। আমি একটু আসুস্থতার নাটক করে হাত নেরে ইশারা করে দেখালাম আমার কানে ব্যাথা এবং আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষন পরে অনুভব করলাম আম্মা আমার কনে কান পাকার ঔষধ দিয়ে দিচ্ছেন, আমি বুঝলাম নাটকে কাজ হয়েছে। পরের দিন বৃহস্পতিবার সকাল বেলা ঠিক ৯টা বেজে ১৫মিনিটে স্যার কে ফোন করে বললাম স্যার আমার কানে হঠাৎ করে খুব ব্যাথা হচ্ছে আমি কথা বলতে পারছি না, কথা বলতে গেলে ব্যাথা হয়। আমি কথা শেষ করার আগেই স্যার ওপাশ থেকে বললেন অঃ অশুবিধা নাই আগামিকাল শুক্রবার সারাদিন রেষ্ট নিলে শনিবারে সুস্থ হয়ে যাবে। শনিবারে আফিস যাবার পরে স্যারের চোখাচোখি হতে কেমন যানি লাগছিল, হঠাৎ দেখি স্যার দূর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন। আমার আর বুঝতে কিছু বাকি রইল না। তখন মনে হচ্ছিল হায়রে পাগল তুই কবে মানুষ হবি??
দেশ ছেরে প্রবাসে আসার পরে ভাল রকম আসুস্থতা বাধিয়ে বসলাম, বুঝতেই পারিনি যে আমি অসুস্থ হয়ে পরছি, আমি প্রবাসে আসার পরে আম্মা ভিষণ আসুস্থ হয়ে পরেন এবং আমি আসার ৩ মাসের মাথায় আম্মা ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। আম্মার অসুস্থতার কথা মনে করতে করতে আর নিজের নতুন চাকরির খেয়াল রাখতে যেয়ে নিজের শরিরের কথা ভুলেই গেছলাম, আম্মা মারা যাওয়ার ১ মাস পরে আমি অনুভব করি আমার ডক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন, ডাক্তারের কাছে যেতেই ডাক্তারের সোজা কথা আপারেশন করতে হবে অতি দ্রুত। প্রবাসে আমার আত্মিয় স্বজন কেউ নেই আমি একা, আল্লাহর নাম নিয়ে সম্পুর্ন এনেস্থেশিয়া আপারেশন-এ রাজি হয়ে গেলাম আর বাসায় ফোন করে আব্বাকে বললাম সামনের ১ - ২ সপ্তাহ কাজে খুব ব্যাস্ত থাকব ফোন করতে পারব না, আব্বাকে আমার আপারেশনের কথা বলার সাহস পেলাম না, কারন উনাকে বললে উনি আমার জন্য টেনশন করবেন। বাল্যকালের হাসপাতালে থাকার সখ হারে হারে উপভোগ করলাম। অপারেশন পরবর্তি একাকি প্রবাস জীবনের যে কি কষ্ট তা বলে বুঝান যাবে না, এক গ্লাস পানি দেওয়ার মত কাউকে পাওয়া যায় না। নিজের সব কাজ নিজেকেই করতে হয়, সবাই সবার কাজে ব্যাস্ত। এরও ঠিক ১ বছর পরে আবারও অসুস্থ হয়ে পরলাম এইবার আবার সম্পুর্ন এনেস্থেশিয়া অপারেশন করে শরীর থেকে কিছু অংশ কেটে ফেলে দিতে হল। আবারও বাল্যকালের হাসপাতালে থাকার সখ হারে হারে উপভোগ করলাম। আর মনে মনে বললাম হায়রে পাগল তুই কবে মানুষ হবি??
ছুটিতে দেশে যেয়ে আব্বাকে যখন আমার দুই দুইটা অপারেশনের কথা বললাম আব্বার আফসোস আর হতাশা পুর্ণ চেহারাটা আজও আমার চোখে ভাসে। ছুটি থেকে ফিরে আসতে না আসতেই কয়েক মাসের মধ্যেই আব্বাও ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। আব্বা, আম্মা, মুরুব্বিদের দোয়া আর আল্লাহর রহমতে আজকে আমি ভাল আছি। পাগল মনে হচ্ছে এখন আনেকটা মানুষ হতে পেরেছে। শরীর স্বাস্থের প্রতি পাগল এখন অনেক সচেতন, আর হাসপাতালের প্রতিও কোন আগ্রহ নাই। তবে এই পাগলের পাগলামি যেন পরকালের জীবনের জন্য কোন ভুল ফলাফল বয়ে না আনে সেইটাই এই পাগলের এখন প্রধান লক্ষ।