কবিতার বরপু্ত্র হেলাল হাফিজের সাথে একদিন আড্ডার সময়ে কি যেন এক কথার পিঠে জিজ্ঞেস করলাম আধুনিক বাংলা কবিতায় (রবীন্দ্র ও জীবনানন্দ উত্তর আধুনিকতায়) কার কার কবিতা আপনার কাছে মনে হয় প্রভাবশালী। উনি খুব দৃঢ়তার সাথেই উত্তর করলেন, ধরো আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে যদি কাব্যমূল্য দিয়েই শুধু কবিকে বিচার করা হয়, তবে এই বাংলার আর কোন কবির স্থান না হলেও দুজনের হবে। সেই দুজন হলেন আল মাহমুদ এবং অকাল প্রয়াত আবুল হাসান।
আজকের এই পোস্টের আলোচ্য আবুল হাসানের অপ্রকাশিত তিনটি কবিতা। কবিতা গুলো অপ্রকাশিত তার জীবদ্দশায়। এগুলো সম্পর্কে কবির ধারণা ছিল এগুলো ছাপার উপযোগী নয়। এগুলো প্রস্তুতি পর্ব। অনেক কবি তাদের প্রস্তুতি পর্বের কবিতা পুড়িয়ে ফেলার মত বিধ্বংসী কাজে লিপ্ত হন ( হেলাল হাফিজ নিজেই আমাকে বলেছেন উনি প্রচুর কবিতা পুড়িয়ে ফেলেছেন)। আবুল হাসান একটু ব্যতিক্রম ছিলেন বলে রক্ষা। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু শেহাবউদ্দিন আহমেদ কে কবিতা গুলো লেখা ডায়েরিটা দিয়ে ছাপতে বারণ করেছিলেন। সেই মোতাবেক তার মৃত্যুর আগে এটি ছাপা হয়নি। মৃত্যুর অনেক বছর পরে নব্বই এর দশকের শেষ দিকে এটা ছাপা হয়। বইটির শিরোনাম দেয়া হয় তার একটি কবিতা মেঘের আকাশ আলোর সূর্য নামানুসারে। এতগুলো বছর সযত্নে পাণ্ডুলিপিটি শেহাবউদ্দিন সংরক্ষণ করায় তিনি আমাদের ধন্যবাদ পাবার যোগ্য এবং তার এ প্রচেষ্টা সত্যিই বন্ধুত্বের প্রতি সম্মানজ্ঞাপক।
মূলত এই কবিতাগুলো প্রকাশে আবুল হাসানের অনিহার কারণ ছিল দুটি। প্রথমত এই কবিতাগুলো তার ছাত্র বয়সের লেখা। দ্বিতীয়ত কবিতাগুলো পূর্বসরী কবিদের কবিতার একটা ছাচ লক্ষণীয় বলে। তা সত্ত্বেও যখন প্রকাশ হয় তখনই দেখা যায় তিনি কবি হিসেবে তখনি আলাদা একটা কণ্ঠস্বর তৈরিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে ষাটের দশকে প্রথম যে কবি সতন্ত্র কণ্ঠস্বরে হাজির হয়েছেন বাংলা সাহিত্যে তিনি হলেন আবুল হাসন। মাত্র একদশকের সাহিত্য কর্মে তার পাকা আসন প্রোথিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে।
আবুল হাসানের কবি চেতনা মূলত নান্দনিকতার পথেই হেটেছে। সমাজ সচেতনতাকে তিনি দেখেছেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক নগর জীবনের চেতনার ভেতর থেকে। আবুল হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থে কয়েকটি কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও পরবর্তীতে তিনি তা কাটিয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় নচিকেতা কবিতাটির কথা
এ বাংলায় বার বার হাঁসের নরোম পায়ের খঞ্জনার লোহার খরায়
বন্যার খুরের ধারে কেটে ফেলা মৃত্তিকার মলিন কাগজ
মাঝে মাঝে গলিত শুযোর গন্ধ, ইদুরের বালখিল্য
ভাড়াটে উৎপাত
কবিতায় জীবনানন্দের যে লঘু সুর, শব্দের উর্বরতা, প্রকাশের অনুপম ভঙ্গিকে নিজের লেখায় অন্যমাত্রায় প্রকাশ করেছেন আবুল হাসান। তার কবিতায় সরাসরি উত্তেজনা, ক্ষোভ, দ্রোহের প্রকাশ মেলেনা কিন্তু আত্মক্লেদ ও গ্লানিতে স্তব্ধ এক জীবনের প্রকাশ পাই তার কবিতায়।
মেঘের আকাশ আলোর সূর্য গ্রন্থ থেকে বাছাই কৃত তিনটি কবিতা এখানে আপনাদের সাথে শেয়ার করছি-
কোমল গান্ধার
একটি আলোর বৃত্তে মুখ দেখে চেতনাসন্ধানী
ভাবে, এই বুঝি সৌন্দর্যের সপ্রতিভ আশ্বাসের নিয়ামক
সংগ্রহের সাহচার্য, সম্ভাবনা, অক্লান্ত সুহৃদ
চিরচেনা বিগ্রহের সংবিধানম অসংযত হৃদয়ের ভীত!
পরিচ্ছন্ন অধ্যায়ের ঘন্টা যদি বেজে যায়
একান্ত আশ্বাসে- বিবেকী মানস, বেহালায়
সুর তোলে যদি, সেই তো আলোর বৃত্তে
ছন্দপ্রকরণ-সবুজ সাক্ষর!
ঝর্ণার জলচ্ছটা, পাথর নুড়ির গায়ে
মিশে থাকা উৎক্ষেপ-গাছ ফুল পাখির বন্দরে
কোন এক নাবিকের অভিযান অনুভবে সৌন্দর্যের
আশ্বাস পাব বলে, খুঁজে পাবে নিটোল শরীর।
নিটোল শরীর এক-সান্তনার কোমল গান্ধারে
পৌষের ফালি রোদে এক চিলতে হলুদ সকাল,
নাবিক সে খুঁজে ফেরে আলোর বাহক
বৃত্ত, ছন্দ, মাত্রার সুর।
অপর পিঠ
তবুও নারীর মুখ আমাদের রক্তে মিশে আছে
মিশে আছে জানকীর অঙ্গধর্মী বিশ্লেষণী রূপ
উপমারা ফুল হয়ে আমাদের মনের অঙ্গনে
নৃত্য করে অন্য ধাচে, অন্য এক কামনা কেলিতে।
রাত্রির ঠোঁট ছুঁয়ে বিবিক্ত সে দেহের অঙ্গারে
আমরাও টের পাই শারীরিক স্রোতের উষ্ণতা
ঘ্রাণ পাই কোকিলের, বসন্তে যার আকুলতা
দূরের সাগর তীরে, ঢেউ কাঁদে বালির বিবরে।
সেগুলো দূরেই রেখে মাংসে তবু আসর জমাই
অসংখ্য লোভের পাতা নেড়ে নেড়ে দেখি আর দেখি
নির্জন অনুষ্টুপ, নানা স্রোতে সবকিছু মেকী
তাইতো চারণক্ষেত্রে নিয়তির গান গেয়ে যাই।
পাড়াগাঁর ধানক্ষেত, নদী খাল সাঁকোর কল্পনা
এসে এসে ফিরে যায়, কেননা সে রিপুর মশাল
আমাকে দেখায়ে দেয় দেখে নেয় সিফনের ভীড়
অথবা দরের কোন লোভনীয় সঞ্চয়ের তীর!!
রক্তের মুখ
আহত শাবক শেষে আউড়ে নিল রক্তের ক্লিষ্ট ধ্রুপদী
নিহত রক্তের স্রোতে শেষবার দেখে নিল পৃথিবীর মুখ
উত্তপ্ত দেহের গায়ে এঁকে নিয়ে স্থিতির সুখ
প্রার্থনায় আওড়ালে, ওহে প্রভু আর একটু বেচে থাকি যদি...
আর বানরের শেষ দৃশ্যে বনমোরগের দুটো পাখা
উড়ন্ত বিলাসে তার নায়কের কথা তুলে নিয়ে
প্রত্যুত্তরে জানালো সে প্রতিবাদে, কেঁপে গেল জারুলের শাখা
(কী হবে স্বর্গে গিয়ে এইসব নৃত্য ছেড়ে দিয়ে?)
শাবক শেষের গানে পিতৃত্বের দামেই বরং
ডেকে গেল প্রভুকেই ভেবে নিয়ে শিকারির উল্লসিত লোভের মাতলামি
মুখ দিয়ে ঘসে নিল ঘাসের সবুজ সেই রঙ
নিহত রক্তের স্রোতে থেকে গেল তার সেই সন্ধ্যা প্রণামী।
কাছে কিছু পিঁপড়ের মুখ দিয়ে শেষ সূর্যের মতো
বের হল সমবেদনার এক সততার কথা
মানুষ বর্বরই শেষে ভোল সে পরুক না ডত
অণুর নৃত্যে তার পশুত্বের হেঁয়ালি বারতা।
---------------------------------------------------------