রুপালি রাত। সরু প্যাচানো রাস্তা। চারিদিকে সুনসান নিরবতা।রাস্তার দু পাশের ঝাউ গাছগুলোর সবুজ পাতা আর পূর্ণিমা আলোর রেখাগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। হঠাতই থাপ্পড়ের উপর থাপড়। জোর বেগে লাথির উপর লাথির কাড়াকাড়ি। ঝাউপাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো দু চারটা ধারালো রুপালি অস্র। চাদের আলোর উচ্ছলপ্রভায় এই রুপালি অস্রটি চকচক করে উঠছে।পূরাণে পড়েছিলাম দেবী কালি অন্যায় আর পাপাচারীদের দমন করে পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য খড়গ নামের এক ধরনের রুপালি অস্র ব্যবহার করতেন।আমার এই সাড়ে পাচ ফুটে শরীরটাকে যেন টুকরোটুকরো করে একিভাবে এই পৃথিবীটাকে জঞ্জালমুক্ত করতে চাইছে এই বংগাল চাপাতিগুলো।এ যুগের ফ্যানাটিক নায়ক এরা। যুগের সকল পাপ আর অশুদ্ধতার আর্বজনা দূর করার সিটি করপোরশনীয় দায়িত্ব এরা নিজ কাধে তুলে নিয়েছে।ঘটনার আকস্মিকতায় রাস্তার এক পাশে হেলে পড়লাম।চাঁদোয়া রাতে পিচ ঢালা রাস্তার ছোট ছোট বিটুমিনাস কয়লাগুলোও চিক চিক করছে।আক্রমনের কুশলতায় আমার থেতলানো মাথা থেকে হলদেটে কি যেন একটা গড়িয়ে পড়েছে।কি অদ্ভূত রকম এক সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে গড়িয়ে পড়া ওই সজীব বস্তুটি থেকে। খানিক দূরেই ছোপ ছোপে রক্তের জমাট স্তুপ। ক্ষিণদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে রাস্তা জুড়ে ছোপ ছোপ ওই জমাট রক্তগুলো মিলে নান্দনিক এক আল্পনার সৃষ্টি করেছে। মনে হলো সব রকম বাতিল মতবাদ আর ভিন্ন আদর্শ ধ্বংস করার আনন্দে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ রাস্তাজুড়ে রক্ত দিয়ে আল্পনা অংকনের এক জাতীয় বুজরকি চলছে !!!!!. ছিড়ে যাওয়া কানে হঠাত করেই এক মানব কন্ঠের তীব্র গর্জন ভেসে এলো। বল, তুই শাহবাগী নাকি হেফাজতি। রক্তে ভিজে যাওয়া আমার থেবলানো গড়িয়ে পড়া হলদেটে মগজটি অবচেতন মনে উত্তর দিল, আমি কিছুই না।আমি মানুষ।তারপর কিছুক্ষণ পরে আরেকটি প্রশ্ন উড়ে এলো, বল তুই আম্লিগ নাকি বিম্পি। আমি বিনয়ের গলা আরো এক মিটার নিচে নামিয়ে বললাম আমি মানুষ।
আমার মুমূর্ষু কন্ঠ থেকে বেরিয়ে আসা এই রকম সাদামাটা উত্তর তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারল না।তাই একে একে সবাই মিলে আমার উপর প্রশ্নবাণের তির ছুড়ে দিল।রক্তাম্বর চাপাতিগুলো আরো বেশি রক্তিম হতে লাগল।জোতস্নাশোভিত রাতটি ও যেন তার উজ্জ্বলতার গতিটি বাড়িয়ে দিল।সারা আকাশ জুড়ে তারাগুলো মুক্তোর দানার মত ফুটে আছে।চারিদিকে কি চমতকার বোঝাপড়া!!!কি চমতকার সুশৃঙ্খলতা!!!এমন মোহিত রাতে এমন আবেগ-আপ্লুত রাতে আমার শুধু মানুষ পরিচয়ের এমন নিরামিষ উত্তরটা তাদের কাছে ভালো লাগল না।তাই তারা আমার পরিচয় বের করার জীবন যুদ্ধে নেমে পড়ল।তারা আমাকে বলল, বল,তুই আহলে হাদিস নাকি আহলে বাইত,তুই শিয়া নাকি সুন্নি,তুই ব্লগার নাকি কমিউনিষ্ট,তুই মোসাদ নাকি র,তুই হিদু নাকি মোসলমান।একজন আবার প্যান্ট খুলে আমার দুই উরুর মাঝে লুকিয়ে থাকা দন্ডটি পরীক্ষা করে আমার পরিচয় খুজে পাওয়ার পাকি প্রচেষ্টা চালিয়ে গেল।আমার নিস্তেজ গলিত মগজটি এবারো কেন জানি কোন এক দৈব শক্তিবলে উঠল, আমি মানুষ। আমি সভ্যতার ক্যানভাস জুড়ে হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে চলা ঘৃণা-প্রেম,সৃষ্টি-লয়,
আশা-দ্রোহ,যুদ্ধ-হত্যা, আর বিরহ- মিলন নামের নাট্য থিয়েটারের এক কেন্দ্রীয় পুরুষ!!!!!!! ভালোবাসা,সম্প্রীতি, প্রসারতা,মানবতা আর ভেদ-ভেদাভেদের উর্ধে উঠা এক পরিশ্রুত মানুষ!!!!!!!
এবারো তারা বুঝতে চাইল না।এবারো আমি নিজের মানুষ পরিচয়ের অব্যর্থ বাণীকে তাদের সামনে বোঝাতে ব্যর্থ হলাম।সময় গড়াচ্ছে।হুংকার আর হিংস্রতার তোরজোড় বেড়ে চলেছে।নিরবতারা আরো নিরব হচ্ছে। আমার থেতলানো মগজের হলদেটে রস ও ছোপ ছোপ রক্তগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে নিজেদের কাছাকাছি আসতে চাইছে।তারা একে অপরে মিলতে চাইছে মহামিলনের পথে।ওদিকে রুপালি চাপাতিগুলো আরো চকচক করে উঠছে।রাত বাড়ছে...............................................................