সদ্য এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে মফস্বল থেকে শহরে অাসলাম। এসেই উঠলাম মামাত ভাই রাহাত এর মেসে।রাহাত অামাকে রুম দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল।দেখলাম এক ভদ্রলোক টেবিলের মধ্যে মাথা ঝুঁকে কি যেন লিখছিলেন। মাথার দিকে খেয়াল করে দেখলাম, সাদা,লাল অার কালো চুলের সহাবস্থান।সালাম দিয়ে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলাম।হাত বাড়িয়ে বললাম
-অামি শাফায়াত।
-ও শাফায়াত! তুমি অাসছো?রাহাত বলেছিল তোমার কথা।অামি মাশুক, কেমন অাছ?
-অালহামদুলিল্লাহ, ভাল অাছি ভাই
মাশুক ভাই অামার থাকার জায়গা দেখিয়ে দিলেন।অল্পতেই তার সাথে অামার একটা ভাল সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল।এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন জন্মের অাগে থেকেই অামরা একে অপরের পরিচিত।হাসতে না জানা কিংবা হাসবেনা বলে বাজি ধরা লোকেরাও উনার কাছে অাসলে হাসতে বাধ্য।মাশুক ভাই অামাকে মেসের নিয়ম কানুন সম্পর্কে ধারণা দিলেন।তিনি বলেছিলেন, "বাংলাদেশে ব্যাচেলর মেসের গোড়াপত্তনের দিকে এক ব্যাচেলর ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল।বিয়েতে পাত্রীপক্ষ পাত্রকে এক বিরাট মুরগী উপহার দিয়েছিলেন।শ্বশুরবাড়ী থেকে পাওয়া অাস্ত মুরগীটাকেই নিখিল বাংলা ব্যাচেলর মেসবাসীকে উৎসর্গ করে সেই ভাইটি মহান ত্যাগের নিদর্শন রাখলেন।সেই মুরগী পেয়ে ব্যাচেলর সমাজ উল্লসিত হল।মুরগী ডিম পাড়ত,ডিম ফুটে বাচ্চা হতো , বাচ্চাগুলো অাস্তে অাস্তে মুরগী হতো,তারাও ডিম পাড়ত। সেই ডিম থেকে মুরগী,মুরগী থেকে ডিম,অাবার মুরগী অাবার ডিম অার এভাবেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মুরগী অার ডিমে বন্দী হয়ে অাজকের অবস্থানে পৌছল ব্যাচেলরবাসী।"
তখন ভালভাবে না বুঝলেও পরবর্তী কয়েক মাসে মাশুক ভাইয়ের কথা ভালভাবে উপলব্ধি করেছিলাম।
চাকুরিজীবী মাশুক ভাই অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলে অামি রুম গুছাতে শুরু করলাম। অগোছালো টেবিলে রাখা মাশুক ভাইয়ের একটা ডায়েরির দিকে হঠাৎ নজর পড়ল।লোভ সামলাতে না পেরে ডায়েরিটা খুলতেই একটা লেখা নজরে এল-
" বহদ্দারহাট এলাকায় অাছি অাজ অনেক বছর।বাসা টু অফিস, অফিস টু বাসা করতে করতে এই এরিয়ার প্রতিটি বিলবোর্ডের প্রতিটি বিজ্ঞাপন অামার মূখস্থ।সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে একদৌড়ে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম।এই প্রথম ফ্লাইওভারের কোন উপকার ভোগ করে নিজেকে ধন্য মনে করলাম অার কর্তৃপক্ষকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। যত মিলিমিটার বৃষ্টিপাতই হোক না কেন, অাপনি ফ্লাইওভারের নিচে এসে দাঁড়িয়ে যাবেন । গার্ডার ধসে মাথার উপর পড়তে পারে তবে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানিও অাপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না।এভাবে রাস্তায় রাস্তায় অলিতে গলিতে ফ্লাইওভার প্রতিষ্ঠিত হলে ছাতা ব্যবসায়ীদের ব্যবসা লাটে উঠলেও অামজনতা নিশ্চিন্তে চলতে পারত।রাষ্ট্র, রাস্তা এইসব ছোটখাট চিন্তা অবশেষে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম।
বরাবরের মতই রোডসাইড ফুড এর প্রতি অাসক্তি থাকাই একটা টং দোকানের পাশে এসে দাঁড়াইলাম। খাবারের প্লেট হাতে নিতেই পাশে এসে হাজির এক শিশু। উদোম শরীর,মুখে কাদার দাগ নাকি কাঁদার দাগ বুঝতে পারলাম না।বৃষ্টিবাদলা দিনে পুরো শহরজুড়েই জলাবদ্ধতা অার অস্বস্তিকর পরিবেশ।শিশুটিকে দেখেই চেনা চেনা মনে হল।জিজ্ঞেস করলাম-
-নাম কি তোমার?
-জিসান।
মাসখানেক অাগেই তার সাথে একই জায়গায় দেখা হয়েছিল। সেদিন জিসানের সাথে অারো কয়েকজন ছিল।এক জনের নাম মনে অাছে।
-তোমার সাথে অাল অামিনরা ছিল না?ওরা কই?
-ওরা বাড়ীতে গেছে, ওদের বাড়ী অাছে।
-তোমার বাড়ী নেই?
-না
-থাক কোথায়?
জিসান হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল তার বাসস্থান।একটি সভ্য স্বাধীন দেশে রাস্তার মাঝখানে ফ্লাইওভারের নিচের বাগানই জিসানদের মতো অনেক শিশুর রাত্রি যাপনের ঠিকানা।সরকার ফ্লাইওভার তৈরী করায় অারেকটা লাভ হয়েছে এসব ছিন্নমূল শিশুর। রাস্তার মাঝখানেও অাজকাল দেদারসে ঘুমানো যায়।দু'পাশে বড় বড় গাড়ির অানাগোনা, গাড়ির হর্ণ,মানুষের কোলাহলে উৎপন্ন সুরবর্জিত শব্দ এদের ঘুমের তেমন ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। যতক্ষণ ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত এদের কোন চিন্তা থাকে না। কিন্তু ঘুম ভাঙলেই বিপদ।।মনের খোরাক মেটানোর অাবদার নেই তবে পেটের খোরাক মেটাতেই এরা হাত পাতে রাস্তার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। বেশীরভাগ মানুষই জিসানদের কাছ থেকে ক্ষমা চাই।কেউ কেউ অাগ বাড়িয়ে তাড়িয়ে দেয় কুকুর তাড়ানোর মত। মাঝে মাঝে কিছু মানুষের দেখা মেলে যাদের কারণেই জিসানরা হয়তো অাজো বেঁচে অাছে, অাশায় বুক বাঁধে নতুনভাবে বেঁচে থাকার।
টংওয়ালাকে বলে জিসানের হাতে খাবারের প্লেট তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
-তোমার বাবা অাছে?
-অাছে কিনা জানি না।একজন ছিল, বিয়ে করে ধাইছে (পালাইছে)।
-তোমার মা কোথায়?
-বাপ দুইটা বিয়া করলে তো মা তিনটা বিয়ে করে।
এতটুকু বাচ্চাকে এত সাধারণ প্রশ্ন করতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম।অার কিছু জিজ্ঞেস করার মত শক্তি পেলাম না।হঠাৎ কেন জানি বোবা হয়ে গেলাম।বিল মিটিয়ে রওনা হলাম বাসার দিকে।মস্তিষ্কের বিশাল মাঠে তখন খেলা করছে জিসানরা। একপাশে খেলা করছে একরাশ হতাশা অার অাফসোস।মাথায় ঠাঁই দেয়ার চাইতে যদি জিসানদের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়ে অাধুনিক হতে পারতাম।"
হঠাৎ দরোজায় কে যেন কড়া নাড়ল।অামি মাশুক ভাইয়ের ডায়েরি বন্ধ করে দরোজা খুললাম।দেখি ১৪-১৫ বছরের এক কিশোর দাঁড়িয়ে। অামাকে জিজ্ঞেস করল-
- মাশুক মামা অাছেন?
-মাশুক ভাই তো কিছুক্ষণ অাগে বেরিয়েছে।
-ও অাপনি মনে হয় উনার নতুন রুমমেট।কেমন অাছেন?অাপনার নাম?
-ভাল।অামি শাফায়াত।তোমার নাম?
-অামি জিসান।পাশের রুমেই থাকি।
মাশুক ভাই নয়, এবার বোবা হয়ে গেলাম অামি নিজেই। নামটা জিসান বলেই,ঠিকানা হয়তো জেনে গেছি অাগেই!
চট্টগ্রাম
১৯/০৭/২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:৪৫