somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাস্তার বার্তা

২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সদ্য এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে মফস্বল থেকে শহরে অাসলাম। এসেই উঠলাম মামাত ভাই রাহাত এর মেসে।রাহাত অামাকে রুম দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল।দেখলাম এক ভদ্রলোক টেবিলের মধ্যে মাথা ঝুঁকে কি যেন লিখছিলেন। মাথার দিকে খেয়াল করে দেখলাম, সাদা,লাল অার কালো চুলের সহাবস্থান।সালাম দিয়ে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলাম।হাত বাড়িয়ে বললাম
-অামি শাফায়াত।
-ও শাফায়াত! তুমি অাসছো?রাহাত বলেছিল তোমার কথা।অামি মাশুক, কেমন অাছ?
-অালহামদুলিল্লাহ, ভাল অাছি ভাই

মাশুক ভাই অামার থাকার জায়গা দেখিয়ে দিলেন।অল্পতেই তার সাথে অামার একটা ভাল সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল।এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন জন্মের অাগে থেকেই অামরা একে অপরের পরিচিত।হাসতে না জানা কিংবা হাসবেনা বলে বাজি ধরা লোকেরাও উনার কাছে অাসলে হাসতে বাধ্য।মাশুক ভাই অামাকে মেসের নিয়ম কানুন সম্পর্কে ধারণা দিলেন।তিনি বলেছিলেন, "বাংলাদেশে ব্যাচেলর মেসের গোড়াপত্তনের দিকে এক ব্যাচেলর ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল।বিয়েতে পাত্রীপক্ষ পাত্রকে এক বিরাট মুরগী উপহার দিয়েছিলেন।শ্বশুরবাড়ী থেকে পাওয়া অাস্ত মুরগীটাকেই নিখিল বাংলা ব্যাচেলর মেসবাসীকে উৎসর্গ করে সেই ভাইটি মহান ত্যাগের নিদর্শন রাখলেন।সেই মুরগী পেয়ে ব্যাচেলর সমাজ উল্লসিত হল।মুরগী ডিম পাড়ত,ডিম ফুটে বাচ্চা হতো , বাচ্চাগুলো অাস্তে অাস্তে মুরগী হতো,তারাও ডিম পাড়ত। সেই ডিম থেকে মুরগী,মুরগী থেকে ডিম,অাবার মুরগী অাবার ডিম অার এভাবেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মুরগী অার ডিমে বন্দী হয়ে অাজকের অবস্থানে পৌছল ব্যাচেলরবাসী।"

তখন ভালভাবে না বুঝলেও পরবর্তী কয়েক মাসে মাশুক ভাইয়ের কথা ভালভাবে উপলব্ধি করেছিলাম।

চাকুরিজীবী মাশুক ভাই অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলে অামি রুম গুছাতে শুরু করলাম। অগোছালো টেবিলে রাখা মাশুক ভাইয়ের একটা ডায়েরির দিকে হঠাৎ নজর পড়ল।লোভ সামলাতে না পেরে ডায়েরিটা খুলতেই একটা লেখা নজরে এল-
" বহদ্দারহাট এলাকায় অাছি অাজ অনেক বছর।বাসা টু অফিস, অফিস টু বাসা করতে করতে এই এরিয়ার প্রতিটি বিলবোর্ডের প্রতিটি বিজ্ঞাপন অামার মূখস্থ।সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে একদৌড়ে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম।এই প্রথম ফ্লাইওভারের কোন উপকার ভোগ করে নিজেকে ধন্য মনে করলাম অার কর্তৃপক্ষকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। যত মিলিমিটার বৃষ্টিপাতই হোক না কেন, অাপনি ফ্লাইওভারের নিচে এসে দাঁড়িয়ে যাবেন । গার্ডার ধসে মাথার উপর পড়তে পারে তবে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানিও অাপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না।এভাবে রাস্তায় রাস্তায় অলিতে গলিতে ফ্লাইওভার প্রতিষ্ঠিত হলে ছাতা ব্যবসায়ীদের ব্যবসা লাটে উঠলেও অামজনতা নিশ্চিন্তে চলতে পারত।রাষ্ট্র, রাস্তা এইসব ছোটখাট চিন্তা অবশেষে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম।

বরাবরের মতই রোডসাইড ফুড এর প্রতি অাসক্তি থাকাই একটা টং দোকানের পাশে এসে দাঁড়াইলাম। খাবারের প্লেট হাতে নিতেই পাশে এসে হাজির এক শিশু। উদোম শরীর,মুখে কাদার দাগ নাকি কাঁদার দাগ বুঝতে পারলাম না।বৃষ্টিবাদলা দিনে পুরো শহরজুড়েই জলাবদ্ধতা অার অস্বস্তিকর পরিবেশ।শিশুটিকে দেখেই চেনা চেনা মনে হল।জিজ্ঞেস করলাম-
-নাম কি তোমার?
-জিসান।
মাসখানেক অাগেই তার সাথে একই জায়গায় দেখা হয়েছিল। সেদিন জিসানের সাথে অারো কয়েকজন ছিল।এক জনের নাম মনে অাছে।
-তোমার সাথে অাল অামিনরা ছিল না?ওরা কই?
-ওরা বাড়ীতে গেছে, ওদের বাড়ী অাছে।
-তোমার বাড়ী নেই?
-না
-থাক কোথায়?
জিসান হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল তার বাসস্থান।একটি সভ্য স্বাধীন দেশে রাস্তার মাঝখানে ফ্লাইওভারের নিচের বাগানই জিসানদের মতো অনেক শিশুর রাত্রি যাপনের ঠিকানা।সরকার ফ্লাইওভার তৈরী করায় অারেকটা লাভ হয়েছে এসব ছিন্নমূল শিশুর। রাস্তার মাঝখানেও অাজকাল দেদারসে ঘুমানো যায়।দু'পাশে বড় বড় গাড়ির অানাগোনা, গাড়ির হর্ণ,মানুষের কোলাহলে উৎপন্ন সুরবর্জিত শব্দ এদের ঘুমের তেমন ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। যতক্ষণ ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত এদের কোন চিন্তা থাকে না। কিন্তু ঘুম ভাঙলেই বিপদ।।মনের খোরাক মেটানোর অাবদার নেই তবে পেটের খোরাক মেটাতেই এরা হাত পাতে রাস্তার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। বেশীরভাগ মানুষই জিসানদের কাছ থেকে ক্ষমা চাই।কেউ কেউ অাগ বাড়িয়ে তাড়িয়ে দেয় কুকুর তাড়ানোর মত। মাঝে মাঝে কিছু মানুষের দেখা মেলে যাদের কারণেই জিসানরা হয়তো অাজো বেঁচে অাছে, অাশায় বুক বাঁধে নতুনভাবে বেঁচে থাকার।
টংওয়ালাকে বলে জিসানের হাতে খাবারের প্লেট তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
-তোমার বাবা অাছে?
-অাছে কিনা জানি না।একজন ছিল, বিয়ে করে ধাইছে (পালাইছে)।
-তোমার মা কোথায়?
-বাপ দুইটা বিয়া করলে তো মা তিনটা বিয়ে করে।

এতটুকু বাচ্চাকে এত সাধারণ প্রশ্ন করতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম।অার কিছু জিজ্ঞেস করার মত শক্তি পেলাম না।হঠাৎ কেন জানি বোবা হয়ে গেলাম।বিল মিটিয়ে রওনা হলাম বাসার দিকে।মস্তিষ্কের বিশাল মাঠে তখন খেলা করছে জিসানরা। একপাশে খেলা করছে একরাশ হতাশা অার অাফসোস।মাথায় ঠাঁই দেয়ার চাইতে যদি জিসানদের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়ে অাধুনিক হতে পারতাম।"

হঠাৎ দরোজায় কে যেন কড়া নাড়ল।অামি মাশুক ভাইয়ের ডায়েরি বন্ধ করে দরোজা খুললাম।দেখি ১৪-১৫ বছরের এক কিশোর দাঁড়িয়ে। অামাকে জিজ্ঞেস করল-
- মাশুক মামা অাছেন?
-মাশুক ভাই তো কিছুক্ষণ অাগে বেরিয়েছে।
-ও অাপনি মনে হয় উনার নতুন রুমমেট।কেমন অাছেন?অাপনার নাম?
-ভাল।অামি শাফায়াত।তোমার নাম?
-অামি জিসান।পাশের রুমেই থাকি।

মাশুক ভাই নয়, এবার বোবা হয়ে গেলাম অামি নিজেই। নামটা জিসান বলেই,ঠিকানা হয়তো জেনে গেছি অাগেই!

চট্টগ্রাম
১৯/০৭/২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:৪৫
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×