বাংলার নবাব
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
বাংলার নবাব
• মুর্শিদকুলি জাফর খান ১৭০৩-১৭২৭
• সুজা উদ্দিন ১৭২৭-১৭৩৯
• সফররাজ খান ১৭৩৯-১৭৪০
• আলিবর্দী খান ১৭৪০-১৭৫৬
• সিরাজদ্দৌলা ১৭৫৬-১৭৫৭
ব্রিটিশ বাংলার নবাব
• মীরজাফর ১৭৫৭-১৭৬০
• মীরকাসিম ১৭৬০-১৭৬৩
• মীরজাফর (দ্বিতীয় বার) ১৭৬৩-১৭৬৫
• নাজম উদ দৌলা ১৭৬৫-১৭৬৬
• সইফ উদ দৌলা ১৭৬৬-১৭৭০
মুর্শিদ কুলি খান
মুর্শিদ কুলি খান ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। এছাড়াও বিভিন্ন নথি-পত্র নির্দেশ করে তিনিই মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুপরবর্তী প্রথম স্বাধীন নবাব। তার উপর মুঘল সাম্রাজ্যের নামমাত্র আধিপত্য ছিল, সকল ব্যবহারিক উদ্দেশ্যেই তিনি বাংলার নবাব ছিলেন।
তার পরিবার সম্পর্কে কয়েক প্রকার মতভেদ রয়েছে। প্রথম সংস্করণমতে মুর্শিদ কুলি খানকে, হাজি শফি ইসফাহানি নামে ইরানের একজন উচ্চপদস্থ মুঘল কর্মকর্তা ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয় করেন। ইসফাহানিই তাকে শিক্ষিত করে তুলেন। ভারতে ফেরার পর তিনি মুঘল সাম্রাজ্যে যোগদান করেন। ১৭১৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে কার্তালাব খান নামে ইসলাম ধর্মে স্থানান্তরিত করেন ও বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করেন। অপর সংস্করনমতে তিনি ছিলেন, মারাঠা জেনারেল মুহাম্মদ কুলি খানের নাতি। কিন্তু সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো মুর্শিদ কুলি খান দরিদ্র দাক্ষিণাত্য মালভূমি ওড়িয়া ব্রাহমীয় পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি হওয়ার পূর্বেই পারস্যের বণিক ইসফাহান তাকে ক্রয় করে ইসলাম ধর্মে স্থানান্তরিত করেন এবং নাম পরিবর্তন করে মুহাম্মদ হাদী বা মির্জা হাদী রাখেন। তিনি বেরার প্রদেশের দেওয়ান হাজী আব্দুল্লাহ কুরাইশির অধীনে চাকরী নেন। পরবর্তীতে বেরার প্রদেশের দেওয়ান সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনে চলে আসে।
সরফরাজ খান
সরফরাজ খান (মৃত্যু: এপ্রিল ২৯, ১৭৪০) ছিলেন বাংলার একজন নবাব। তার আসল নাম মির্জা আসাদুল্লাহ। সরফরাজ খানের নানা নবাব মুর্শিদ কুলি খান সরফরাজকে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার নবাব বা তার উত্তরাধীকারী মনোনীত করেন। ১৭২৭ সালে মুর্শিদ কুলি খানের মৃত্যুর পর যখন তিনি সিংহাসনে আরোহন করবেন তখন জানতে পারেন তার পিতা ওড়িশার সবেদার সুজা উদ্দিন মুহাম্মদ খান ও তার ডেপুটি আলীবর্দী খাঁ বিশাল বাহিনী নিয়ে সিংহাসন দখলের জন্য মুর্শিদাবাদ অগ্রসর হচ্ছে। পরিবারের মধ্যে কলহ এড়ানোর জন্য দেওজার বেগম সরফরাজকে তার পিতার সম্মানে সিংহাসন ছেড়ে দিতে বলেন। যাইহোক পরবর্তীতে সুজা উদ্দিন মুহাম্মদ খান তার উত্তরাধীকারী হিসেবে সরফরাজকেই মনোনীত করেন এবং ১৭৩৯ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে আরোহন করেন। সিংহাসনে বসার পর তিনি আলা উদ্দিন হাইদার জং উপাধি ধারন করেন।সরফরাজ খানের দুর্ভাগ্য যে তিনি আলীবর্দী খাঁর মত একজন প্রতিপক্ষ পেয়েছিলেন যার ৭০ বছর বয়সেও নেতৃত্ত্ব দেওয়ার অসাধারন গুন ছিল এবং তিনি সরফরাজ খানের দূর্বলতাগুলো জানতেন। সরফরাজ খান ভাগীরথী নদীর তীরে গিরকার যুদ্ধে নিহত হন। তার প্রতিপক্ষ আজিমাবাদের (বর্তমান পাটনা) সুবেদার আলীবর্দী তাকে সরাসরি যুদ্ধে পরাজিত করেন। যুদ্ধটি ক্ষণস্থায়ী ছিল কিন্তু এর ভয়াভহতা ছিল মারাত্বক। যুদ্ধের প্রথম দিকেই সরফরাজ খান গুলিবিদ্ধ হন কিন্তু তার সেনাবাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আলীবর্দী খানের নিপুন রণকৌশলের কাছে সর ফরাজের সেনাবাহিনী পরাজিত হয়।
প্রাথমিক ছত্রভঙ্গের কারন ছিল সরফরাজ খান কখনো আলীবর্দী খাঁর কাছ থেকে এরকম যুদ্ধ আশা করেন নি এবং আলীবর্দী খাঁ সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সরফরাজকে সময় দেন নি। সিংহাসনে বসার ১৩ মাসের মাথায়ই তিনি আক্রমন করেন। অপর দিকে সরফরাজ খান আরো বড় হুমকি নাদির শাহকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন যিনি দিল্লি ও পাঞ্জাব আক্রমন করেছিলেন।
সরফরাজ খান মৃত্যুর সময় পাঁচ পুত্র ও পাঁচ কন্যা রেখে যান যারা কখনো কষমতা গ্রহন করতে পারেন নি। আলীবর্দী খাঁ বাংলার নবাব হিসেবে অভিষিক্ত হন ও একই সাথে মুর্শিদ কুলির নাসিরি রাজবংশের পতন ঘটে। আলীবর্দী খাঁ আফসার রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। সরফরাজ খানকে মুর্শিদাবাদের নাগিনাবাগে সমাধিস্থ করা হয়।
সুজা উদ্দিন মুহাম্মদ খান
সুজা উদ্দিন মুহাম্মদ খান ছিলেন বাংলার একজন নবাব। তিনি মুর্শিদ কুলি খানের কন্যা জয়নব উন-নিসা বেগম ও আজমত উন-নিসা বেগমকে বিয়ে করেছিলেন। তার তৃতীয় স্ত্রীর নাম দুরদানা বেগম সাবিহা। ৩০শে জুন ১৭২৭ সালে তার শ্বশুর মুর্শিদ কুলি খানের মৃত্যুর পর তিনি নবাব সিংহাসনে আরোহন করেন।তিনি দেক্কানের বুরহানপুরে মির্জা সুজা উদ্দিন মুহাম্মদ খান (মির্জা দেক্কানী) নামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম নবাব জান মুহাম্মদ খান (মির্জা নূর উদ্দিন খান)। তিনি ১৭১৯ সালে ওড়িশার সুবেদার (প্রাদেশিক শাসক) হিসেবে নিয়োগ পান। এছাড়াও তিনি ১৭২৭ সালের জুলাইয়ে বাংলা ও ১৭৩১ সালে বিহারের সুবেদার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। সুবেদার উপাধিটি মুঘল শাসনামল থেকে প্রচলিত।সরাসরি উত্তারাধীকারী না থাকায় মুর্শিদ কুলি খান তার নাতি সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজ খানকে সিংহাসনের জন্য মনোনীত করেন। মুর্শিদ কুলি খান ১৭২৭ সালে মৃত্যুবরন করনে ও সরফরাজ খানের সিংহাসন লাভের উপক্রম হয়।
এদিকে সুজা উদ্দিন ছিলেন ওড়িশার সুবেদার ও তার ডেপুটি ছিলেন আলীবর্দী খাঁ। মুর্শিদ কুলি খান সাধারনত সুজা উদ্দিনের জনগনের জন্য গৃহীত সর্বব্যাপী নীতিকে সমর্থন করতেন না। পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী যখন সরফরাজ খানকে সিংহাসনের উত্তারীধার হিসেবে ঘোষনা করা হয় তখন সুজাউদ্দিন নিজ পুত্রের অধীনে চাকরী করতে বিরক্ত ছিলেন। আলীবর্দী খাঁ ও তার ভাই হজি, সুজা উদ্দিনকে বলেন এই পদের জন্য তিনিই সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি। আলীবর্দী খাঁ ও হাজির সাহায্যে সুজাউদ্দিন সিংহাসন দখলের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এছাড়াও তিনি মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ-এর সাহায্য পেয়েছিলেন, সম্রাট তাকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলার নবাবদের রাজধানী মুর্শিদাবাদের দিকে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে গমন করেন। পরিবারের মধ্যে কলহ এড়ানোর জন্য তখন মুর্শিদ কুলি খানের স্ত্রী বৈঠক করেন ও সরফরাজ খান পিতা সুজাউদ্দিনকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সিংহাসনে বসতে অস্বীকৃতি জায়ায়। ১৭২৭ সালের আগস্টের দিকে সুজা উদ্দিন পরিপূর্ণভাবে সিংহাসন লাভ করেন ও বাংলার দ্বিতীয় নবাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
সুজাউদ্দিনকে সমর্থন করার স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি মুঘল সম্রাটের কাছে বিপুল পরিমান উপঢৌকন পাঠান। মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ পরিবর্তে তাকে মুতামুল মুলক (দেশের কর্তা), সুজাউদৌলা (রাষ্ট্রের নায়ক) ও আসাদ জং (যুদ্ধের সিংহ) উপাধিতে ভূষিত করেন। এছাড়াও মুঘল সম্রাট থাকে বিভিন্ন দামি উপঢৌকন দিয়ে সম্মান জানান।১৭৩২ সালের দিকে নাদের শাহকে নিয়ে একটি উদ্বেগ ছড়িয়ে পরে। সুজাউদ্দিন অসুস্থ হয়ে পরেন ও মৃত্যুভয়ে তিনি তার পুত্র ও দুরদানা বেগমকে ওড়িশা পাঠিয়ে দেন। এছাড়াও তিনি সরফরাজ খানকে তার উত্তারীকারী হিসেবে মনোনীত করেন। তিনি সবসময় সরফরাজ খানকে হাজি আহমেদ, আলম চাদ ও জগতশেঠের উপদেশ মেনে নিতে বলতেন যদিও সরফরাজ তাদের পছন্দ করতেন না। ২৬শে আগস্ট ১৭৩৯ সালে তিনি মৃত্যুবরন করেন। তিনি দুই পুত্র ও দুই কন্যা রেখে যান। তাকে মুর্শিদাবাদের রোশনিবাগে সমাধিস্থ করা হয়। তার মৃত্যুর পর পুত্র সরফরাজ খান সিংহাসনে বসেন এবং এ সময়ই নাদের শাহ দিল্লি আক্রমন করেন।
সুজা উদ্দিন অত্যন্ত সম্বৃধিশীল একটি দেশ রেখে যান ও তার পুত্র ভালোভাবেই দেশ পরিচালনা করেন। নাসিরি রাজবংশ আরো ১৩ মাস স্থায়ী ছিল এবং সরফরাজ খানের সাথে সাথে এই রাজবংশেরও সমাপ্তি ঘটে।
নবাব আলীবর্দী খাঁ
নবাব আলীবর্দী খাঁ, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার মাতামহ। নবাব সিরাজউদ্দৌলা নবার আলীবর্দী খাঁর উত্তরসূরি হন।
আলীবর্দী খাঁ বাংলা, বিহার, ওড়িশার নবাব ছিলেন। তার পূর্ণ নাম মির্জা মুহাম্মদ আলী। তার পিতার নামদ মির্জা মুহাম্মাদ। আরব বংশোদ্ভূত মির্জা মুহাম্মদ আজম শাহের (আওরঙ্গজেবের দ্বিতীয় পুত্র) দরবারের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। আলীবর্দী খাঁর মা খুরসানের এক তুর্কি উপজাতি হতে এসেছিলেন। তার পিতামহ আওরঙ্গজেবের সৎ ভাই ছিলেন। পূর্ণ বয়স্ক হবার সাথে সাথে আজম শাহ তাকে পিলখানার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
১৭০৭ এর যুদ্ধে আজম শাহের মৃত্যুর পর চাকরি চলে যাওয়ার মির্জা মুহাম্মদ আলীর পরিবার সমস্যার সম্মুখীন হয়। তখন, বাকি জীবনের জন্য তিনি সপরিবারে ১৭২০ সালে বাংলায় চলে আসেন। কিন্তু বাংলার তৎকালীন নবাব মুর্শিদকুলী খান তাকে গ্রহণ করেন নাই। ফলে, মির্জা মুহাম্মদ আলী চুতাকে গমন করেন, যেখানে সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খান তাকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করেন। সুজাউদ্দিন তাকে মাসিক ১০০ রুপি বেতনের চাকুরিতে নিয়োগ দান করেন। তার কাজ ও বিশ্বস্ততায় খুশি হয়ে তিনি তাকে পদোন্নতি দেন। বিশেষ করে তাকে ওড়িশার কিছু জমিদারির তদারকি দান করেন।
ওড়িষ্যাতে মির্জা মুহাম্মদ আলী প্রশাসনিক দক্ষতা লাভ করেন। ওড়িশার সন্তোষজনক দ্বায়িত্ব পালন ছাড়াও সুজাউদ্দিনের শ্বশুর মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যুর পর বাংলার মসনদ রক্ষায় সুজাউদ্দিনকে তিনি সাহায্য করেন। ফলশ্রুতিতে মির্জা মুহাম্মদ আলীকে চাকলা আকবরনগর (রাজমহল) এর ফৌজদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৭২৮ সালে তাকে আলীবর্দি উপাধি দেওয়া হয়। নতুন ফৌজদারের অধীনে রাজমহলের জনগন শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ করে। প্রদেশের প্রায় সকল ক্ষেত্রে আলীবর্দি সুজাউদ্দিনের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। নবাব তার প্রতি এমন নির্ভরশীল হয়ে পড়েন যে, বছরে একবার রাজমহল থেকে মুর্শিদাবাদে তার ডাক পড়ত।
১৭৩২ সালে সম্রাট মুহাম্মদ শাহ বিহারকে বাংলা সুবার অধীনে নিয়ে আসেন। কিন্তু নবাব সুজাউদ্দিন সম্পূর্ণ অঞ্চল নিজের অধীনে রাখার থেকে, আলীবর্দীকে বিহারের নিজাম হিসেবে নিয়োগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন। কিছু দিন আগে আলীবর্দির কনিষ্ঠ কন্যা আমিনা বেগম তার কনিষ্ঠ ভাতিজা জৈনুদ্দিন আহমেদ খানকে বিয়ে করেন। আমিনা বেগমের গর্ভেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়। আলীবর্দীর নিজের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আলীবর্দী সিরাজউদ্দৌলাকে তার উত্তরসূরি ঘোষণা করেন।
নবাব সিরাজদৌল্লা
নবাব সিরাজদৌল্লা বা মিরজা মুহাম্মাদ সিরাজদৌল্লা ( জন্ম: ১৭৩২ - মৃত্যু: ১৭৫৭) বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব। পলাশীর যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ও মৃত্যুর পরই ভারতবর্ষে ইংরেজ-শাসনের সূচনা হয়।
নবাব সিরাজদৌল্লা ছিলেন বাংলার নবাব আলীবর্দী খান-এর নাতি। আলীবর্দী খানের কোন পুত্র ছিল না। তাঁর ছিল তিন কন্যা। তিন কন্যাকেই তিনি নিজের বড়ভাই "হাজি আহমদ"-এর তিন পুত্র, নোয়াজেশ মোহাম্মদের সাথে বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের, সাইয়েদ আহম্মদের সাথে মেঝ মেয়ে এবং জয়েনউদ্দিন আহম্মদের সাথে ছোট মেয়ে আমেনা বেগম-এর বিয়ে দেন। আমেনা বেগমের দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিল। পুত্ররা হলেন মির্জা মোহাম্মদ (সিরাজদ্দৌলা) এবং মির্জা মেহেদী। আলীবর্দী খাঁ যখন পাটনার শাসনভার লাভ করেন, তখন তাঁর তৃতীয়া কন্যা আমেনা বেগমের গর্ভে মির্জা মোহাম্মদ (সিরাজ উদ দৌলা) -এর জন্ম হয়। এ কারণে তিনি সিরাজের জন্মকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে আনন্দের আতিশয্যে নবজাতককে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। সিরাজ তার নানার কাছে ছিল খুবই আদরের, যেহেতু তার কোনো পুত্র ছিলনা। তিনি মাতামহের স্নেহ-ভালোবাসায় বড় হতে থাকেন। সিরাজদ্দৌলার জন্মতারিখ বা সাল নিয়ে সামান্য ভেদাভেদ আছে। তবে অধিক গ্রহণযোগ্য মত হলো ১৭৩২ সাল। মীরজাফর তার কোন আত্বীয়ের মাঝে পড়েন না। কাজী ইসা তার চাচা হয়।১৭৫৭ খৃস্টাব্দের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করল না। নবাব বুঝতে পারলেন, সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল।
বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মিরজাফরকে বন্দি করার চিন্তা বাদ দিলেন। তিনি মিরজাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বললেন। মিরজাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করলেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে তিনি রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মিরজাফর, মিরমদন, মোহনলাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন।
২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। ইংরেজরা 'লক্ষবাগ' নামক আমবাগানে সৈন্য সমাবেশ করল। বেলা আটটার সময় হঠাৎ করেই মিরমদন ইংরেজবাহিনীকে আক্রমণ করেন। তাঁর প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। মিরমদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মিরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ যেখানে সৈন্যসমাবেশ করেছিলেন সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মিরমদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজদ্দৌলার গোলা বারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মিরমদন ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মিরমদন মৃত্যুবরণ করেন।
কিন্তু মিরজাফর আবারো বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সৈন্যবাহিনীকে শিবিরে ফেরার নির্দেশ দেন। এই সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা নবাবকে আক্রমণ করে। যুদ্ধ বিকেল পাঁচটায় শেষ হয় এবং নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে আসে। ইংরেজদের পক্ষে সাতজন ইউরোপিয়ান এবং ১৬ জন দেশীয় সৈন্য নিহত হয়।তখন কোন উপায় না দেখে সিরাজদ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য দুই হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যেও কেউ তাঁকে সাহায্য করেনি। সিরাজদ্দৌলা তাঁর সহধর্মিণী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁর আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সৈনিক মসিয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন।
মিরজাফর রাজধানীতে পৌঁছে নবাবকে খুঁজে না পেয়ে চারদিকে লোক পাঠালেন। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই সিরাজদ্দৌলা মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ করে জল কমে যাওয়ায় নাজিমপুরের মোহনায় এসে তাঁর নৌকা চড়ায় আটকে যায়। তিনি নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের নিকটবর্তী বাজারে আসেন। সেখানে কিছু লোক তাঁকে চিনে ফেলে অর্থের লোভে মিরকাশিমের সৈন্যবাহিনীকে খবর দেয়।এ সম্পর্কে ভিন্ন আরেকটি মত আছে যে এক ফকির এখানে নবাব কে দেখে চিনে ফেলে। উক্ত ফকির ইতিপূর্বে নবাব কতৃক শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে তার এক কান হারিয়েছিল। সেই ফকির নবাবের খবর জানিয়ে দেয়। তারা এসে সিরাজদ্দৌলাকে বন্দি করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেয়। বন্দী হবার সময় নবাবের সাথে ছিলেন তার স্ত্রী লুতফা বেগম এবং চার বছর বয়সী কন্যা উম্মে জহুরা। এর পরের দিন ৪ জুলাই (মতান্তরে ৩রা জুলাই)মিরজাফরের আদেশে তার পুত্র মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদিবেগ নামের এক ঘাতক সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করে। কথিত আছে,সিরাজের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেয়া হয়।
মীরজাফর এবং মীরন
মীরজাফর সিরাজদ্দৌলার একজন অমাত্য ছিলেন। তিনি প্রধান সেনাপতি ছিলেন।নবাব আলীবর্দ্দী খান তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার নবাব করায় ক্ষুব্ধ হন মীর জাফর। তাই তিনি প্রধান সেনাপতি হয়েও কখনোই সিরাজউদ্দৌলাকে নবাব হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি। সব সময় তিনি চেয়েছেন বাংলার নবাবের পতন। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভ এর সাথে তিনি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন, এবং পলাশীর যুদ্ধে তাঁর কারণেই ব্রিটিশদের হাতে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় ঘটে। এই যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীরজাফরকে নবাবের মসনদে অধিষ্ঠিত করে।মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাঁর নামটি বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন বাংলাদেশে মীরজাফর নামে কারো নাম রাখা হয় না।
নবাব মীরকাসিম
নবাব মীরকাসিম (১৭৬০-১৭৬৩) কলকাতা কাউন্সিল নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মীরজাফরকে মসনদ থেকে নামিয়ে তার জামাতা মীরকাসিমকে নবাব নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু কাউন্সিলের পরিকল্পনাকে ভুল প্রমানিত করে মীরকাসিম ছিলেন কর্মক্ষম, বুদ্ধিমান, তেজস্বী—নিজের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখবার চেষ্টা করতেন তিনি। ইংরেজদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি রাজধানী মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেন। সেখানে তিনি বন্দুক, গুলি, কামান তৈ্রীর কারখানাও স্থাপন করেন, সেখানে যথেষ্ট উন্নত মানের আগ্নেয়াস্ত্র তৈ্রী হতো। তিনি কখোনই ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজী ছিলেন না। বারংবার ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তিনি বারবার পরাজিত হোন।
তিনি ছিলেন রুক্ষ্ম ও সন্দেহবাতিক, শোনা যায় টাকা আদায়ের জন্য রায়বল্লভের হাতের নখের মধ্যে সূচ ঢুকিয়ে দিতে আদেশ দেন এবং তাঁরই আদেশে বিহারের নায়েব রামনারায়ন ও রায়বল্লভকে গলায় বালির বস্তা বেঁধে গঙ্গায় ডুবিয়ে মারা হয়। মীরকাসিম অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দ্দৌল্লার হাতে বন্দী হন।
শোনা যায় বারবার পরাজয়ের গ্লানিতে মীরকাসিম পাগল হয়ে দিল্লীর পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন। দিল্লীর রাজপথে ১৭৭৭ খ্রীষ্টাব্দে তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তারপর জাফরাগঞ্জে এনে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
বাকি ইংরেজ শাষিত নবাবদের পরিচয় ধারাবাহিকাভাবে দেয়া হলো
নাজম উদ দৌলা
সইফ উদ দৌলা
মুবারক উদ দৌলা
আযাদ উদ দৌলা
আলি জাহ্
ওয়াল্লা জাহ্
হুমায়ুন জাহ্
মুনসুর আলি খান
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন