প্রথমবারের মতো একটা ছোটগল্প শেষ করলাম। নতুন রাইটার হিসেবে কেমন হয়েছে, সেভাবে ঠিক বুঝতে পারছি না। অভিজ্ঞদের উপদেশ তো কামনা করতেই পারি!
আমি সবাইকে দেখছি,কিন্তু কেউ আমাকে দেখছে না! ব্যাপারটা বেশ মজার হত যদি না আমি জানতাম যে আমি মরে গেছি।
ঐ তো, আমার পুরাতন বিছানার চাদর দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে আমার এতদিনের আবাস শরীরটাকে। সম্ভবত হঠাৎ হার্ট এটাকে মরে গেছি আমি। কারণ, কিভাবে মরলাম, কেন মরলাম কিছুই আমি বুঝিনি। দুপুরের খাবারের পর হঠাৎ বুকে ব্যাথা হল, তারপরেই কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। ঘোর ভাঙার পর আবিষ্কার করলাম আমাকে ঘিরে বিরাট শোরগোল। বেশ কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে যে, সেটা আমি ছিলাম না, ছিল শুধু আমার দেহটা।
কতক্ষণ আগে মরেছি বুঝতে পারছি না! মরার পর সময় আন্দাজ করার কোন রীতি বোধ হয় নেই। কারণ এর পরের সময় অসীম। আমাদের গণিত স্যারের ভাষায় ধরি সময় সংখ্যা X। আমার শোবার ঘরের দেয়ালঘড়িটায় বেশ কিছুদিন ধরেই শুধু বারটা তের দেখাচ্ছে। আনকোরা নতুন ব্যাটারি লাগানোর পর সেটা এগারো মিনিট বেড়ে বারটা চব্বিশে পৌঁছেছে। এর বেশি কিছু লাভ হয়নি। ঘড়ির সময় এখনো বারটা চব্বিশে আটকে আছে। তাই ঘড়ি দেখেও সময় বোঝার উপায় নেই।
হঠাৎই জানতে ইচ্ছে করছে, এটাকি রাত বারটা চব্বিশ? নাকি দুপুর! মৃত্যুর পর হয়তো কৌতূহল কিঞ্চিত বেড়ে যায়, কেননা এটাই চিরন্তন সত্য! যা করা সম্ভব নয় তা-ই শুধু করতে ইচ্ছে হয়। আমি ছোটবেলাতেই দেখেছি, যখন দুই হাতে বেশ যত্ন করে মেহেদী লাগানো হয়, ঠিক তখনি ঘাড়ের পিছন দিকটা কেন জানি খুব চুলকাতে থাকে,কিংবা খুব জোরে বাথরুম পায়। খুবই তাজ্জবিক ব্যাপার!
খুব বেশি আগে হয়তো মরিনি, কেননা এখনও দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয়রা এসে পৌঁছায়নি। শুধু পাড়া-প্রতিবেশী আর বাড়ির লোকেরাই ভিড় করে আছে।
পাশের বাড়ির রূপার মা বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। আমার প্রতি এই মহিলার যে এত টান তা বেঁচে থাকতে বুঝিনি। আমার মাথার পাশে রূপাকেও দেখলাম আঁচল চাপা দিয়ে রেখেছে। কাঁদছে কি না স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। কতদিন জানালার ফাঁক দিয়ে রূপাকে দেখেছি! ভাবতাম একবার যদি তাকাতো। কিন্তু তখন একবারও তাকায়নি। বেঁচে থাকতে কথাও হয়নি খুব একটা। কিন্তু এখন সে আমার জন্য কাঁদছে!! ব্যাপারটা দেখে আবেগে আপ্লুত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কেন যেন আবে কাজ করছে না। হয়তো মৃত্যুর পর আবেগ বলে কিছু থাকেই না!
বেশ সুর করে কাঁদছে খালা । আমার প্রতি তার এত টান থাকার কথা না। বাপ-মা মরার পর খালার কাঁধে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে ছিলাম। আমি মরাতে খালার বরং খুশি হবার কথা! বিপদ বিদেয় হল। খালার সুরে সুর মেলাচ্ছে বেশ কজন। খালাতো বোনটাও বেশ সুর ধরেছে। ওর গলা যে এত ভাল কখনো খেয়াল করিনি! চেষ্টা-টেষ্টা করলে ভাল শিল্পী হতে পারবে।
মেয়েলী কান্না কেত্তন ছেড়ে আমি বাইরে বেরুলাম। 'আমি বাইরে বেরুলাম' কথাটা কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না! আমি বলতে শুধুই আমার অস্তিত্ব! আমি সব দেখতে পারছি, শুনতে পারছি কিন্ত কি দিয়ে দেখছি শুনছি কিছুই বুঝতে পারছি না। কারণ, আমার চোঁখ এবং কানজোড়া শরীরের সাথে রয়ে গেছে। আমার নাকখানাও নেই সাথে। তবুও আগরবাতির তীব্র গন্ধ, আর কারও কান্নার সাথে ভক করে বেড়িয়ে আসা মিষ্টি জর্দার ঘ্রাণ আমি স্পষ্ট অনুভব করছি। হয়তো মৃত্যুর পর ইন্দ্রিয়গুলো সব অটো হয়ে যায়!
উঠানে বয়স্কদের জন্য চেয়ার পাতা হয়েছে। বেশ কজন মোটামোটি বৃদ্ধ গোছের লোক একসাথে বসে বিভিন্ন জিনিস আলোচনা করছে। তাদের বেশিরভাগই আমার অচেনা। তাদের আলোচনায় আমার মৃত্যু থেকে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে , ইউনিয়ন মেম্বারের অভদ্রতা আর দূর্নীতির কূটনৈতিক আলোচনা। তারা সবাই একে একে বিভিন্ন কাজ করতে গিয়ে কিভাবে মেম্বারের কাছে হেনস্ত হয়েছে তার বিশদ বর্ণনা দিচ্ছে। অন্যরা তেজি কন্ঠে ক্ষোভ ঝাড়ছে। তারা হয়তো আমার মৃত্যুর কথা ভুলেই গেছে,মেম্বারের আলোচনায়! থাক ভুলে যাক।
এই বৃদ্ধদের থেকে যারা আরও এককাঠি সরেস, মানে যারা বয়সের ভারে নড়তে পারে না, এক পা কবরে দিয়ে আছে, তারা আরেক যায়গায় বৈঠক করছে। এখনও ততটা শীত নামেনি। কিন্তু তাদের মাংকি টুপি, শাল, সুয়েটারের বহর দেখে মনে হল সুইজারল্যান্ডে এর চেয়ে বেশি শীত কিছুতেই হতে পারে না।
তাদের আলোচনা জুড়ে অবশ্য বেশিরভাগ সময় আমিই ছিলাম। গোর খুড়বে কে, বাঁশ কোন্থেকে কাঁটা ভাল, গোসল করানোর নিয়ম , জানাজায় কত মানুষ হতে পারে এসব বিষয়ে তাদের মধ্যে বেশ উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। এদের অনেকে এসব বিষয়ে নিজস্ব বিদ্যা জাহির করছে। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল কবর কোথায় হওয়া ভাল তা নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ একটা গোল বেঁধে গেল। সবাই ব্যাক্তিগত মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টায় এই বয়সেও যতটুকু উত্তেজিত হওয়া যায়, হয়েছেন!
তাদের কথাবার্তা শুনেই হঠাৎ করে কবরের কথা মনে হল। আসলেই তো! আমার পরবর্তী বাসস্থানের কাজ কদ্দুর এগোলো দেখা দরকার। অবশ্য এক্ষেত্রে প্রশ্ন হল আমি বলতে কি আমি, নাকি আমার দেহ! কোনটা থাকবে কবরে? শুধু দেহ নাকি আমার যে বর্তমান অস্তিত্ব তা সহ কবরে থাকবে! ভেরি মিস্টিরিয়াস ব্যাপার। বেঁচে থাকলে এ ব্যাপারে ফেসবুকে বেশ দার্শনিক একটা স্ট্যাটাস দেওয়া যেত। কিন্তু হায়! আমার এমন সেলেব্রেটি ইমেজঅলা আইডিটা এমনি পড়ে রবে! লাস্ট যে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, তাতে কি হাজার দুয়েক লাইক পড়েছে? দেখার কোন সুযোগ নেই। মৃত্যুর পর হয়তো এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে!
আমি এখন আমার কবরের সামনে দাড়িয়ে। দুতিনজন লোক পাশে বাঁশের চাটাই বানাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে তাদের মনে বিশেষ ফূর্তি! একজন একটা কথা বললেই অন্যরা হাসতে হাসতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে!
যে লোকটা কবরের মাটি কাটছে, তার নাম সম্ভবত বাবুল। কারণ তার পাশে দাড়িয়ে থাকা লোকটা বার বার বলছে, "বাবুইল্লা, তাগদা কর। মুর্দা নামায় দিব অক্কনে"
কিন্তু বাবুইল্লার 'তাগদা' করার কোন লক্ষণই দেখা গেল না। সে তার মতই কাজ করে যাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, কাজটা তার মনমতো হয়নি। কিছুক্ষণ পরপর ভ্রু কুঁচকে লাঠি দিয়ে কবর মাপছে আর বিরক্ত হয়ে, কোদাল দিয়ে কবরের দেয়াল চাঁছতে আরম্ভ করছে। একপর্যায়ে সে কবরের মধ্যে পিচিক করে থুতু ফেলল। সশরীরে থাকলে তার কানের গোড়ায় এ কর্মের জন্য একটা থাবড়া দেওযা যেত। কিন্তু মৃত্যুর পর তা আর সম্ভব না। এজন্য বিরাট আফসোস হল!
আমার জানাযা হচ্ছে। আমার শরীরটাকে একটা সাদা কাফনে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে! এত ধবল সাদা আমি কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না! লাশের পাশে দাড়িয়ে একে একে আমার সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলল খালু, ইমাম সাহেব, মুদির দোকানদার ছগির চাচা.....
কথা গুলো শুনতে ভালই লাগলো! নিজের সম্পর্কে এত ভাল কথা কখনো শুনিনি! আমার বন্ধু বা ক্লাসমেট কাউকে দেখছি না তো! তারা আমার সম্পর্কে কি বলে তা দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছিল। কিন্তু বন্ধুবান্ধব সব কই? তারা কি খবর পায় নি? খবর তো পাওয়ার কথা। মৃত্যু সংবাদ আর পরীক্ষার রেজাল্ট এই দুইটা জিনিস বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তবুও কেউ এলনা কেন! মিস্টিরিয়াস ব্যাপার। এ ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবা যেত! কিন্তু ইমাম সাহেব জানাজা শুরু করে দিল। আল্লাহু আকবার.......
জানাযা শেষ! সবাই সরে যেতে শুরু করেছে। এদিকে আমার মুখটা শেষবার দেখার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। সবাই আমাকে দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এটা দেখে বেশ গর্বিত হলাম। কিন্তু গর্বে বুক ফুলানোর সুযোগ আর আমাকে দেওয়া হবে না!
আমার চেহারা এখন কেমন হয়েছে! দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু আমি সেখানে যেতে পারছি না। বেশ দূর থেকে শুধু মানুষের ভিড় দেখতে পাচ্ছি। আমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? মৃত্যুর পর নিজের চেহারা দেখায় নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি! কি জানি! আরে আমাকে গোসল করানো হয়েছে তো ভালভাবে? গোসলের ব্যাপারে কিছু দেখলাম না কেন! আমি তো সারাক্ষণ কাছাকাছিই ছিলাম। মিস্টিরিয়াস ব্যাপার, ভেরি মিস্টিরিয়াস!
খাটাইয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাকে। সামনের দুই পায়া ধরেছে খালু আর কাজের ছেলে শম্ভূটা। হিন্দুদের কি খাটাই ধরার নিয়ম আছে? হয়তো নেই কারণ, একজনকে দেখলাম তাকে প্রায় ঘাড় ধরে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল! ধীরে ধীরে আমাকে নিয়ে কবরস্থানে যাওয়া হচ্ছে।
সবাই কবরের চারপাশে ভিড় করছে এসে! আমার দেহটা কবরে নামানো হচ্ছে। কবরখোদক বাবুল আলগোছে আমার পা ধরে আছে। আর খালু আমার মাথার দিকটা।
কবরের ভেতরটা ধীরে ধীরে যেন আলোয় ভরে উঠছে! এরকম তো কখনও দেখিনি!!! আশ্চর্য! আমি সেই আলোর দিকে মোহাবিষ্টের মতো ছুটে যাচ্ছি। কি দুর্নিবার আকর্ষণ! ধীরে ধীরে আমি চলে গেলাম ভেতরে। এখন আর ততটা আলোকময় মনে হচ্ছে না। এক আশ্চর্য অনুভূতি হচ্ছে। এতক্ষণ আমার দেহ আর আমার অস্তিত্ব ছিল আলাদা। এখন আবার দেহ-অস্তিত্ব একইসাথে আছে। কিন্তু আমি দেহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।
আমার উপর বাঁশ দেওয়া হল,আড়াআড়িভাবে।এখন একটা চাটাই। একটু আগে যে বর্ণিল আলোকসম্ভার ছিল, এখন তা ক্রমেই অন্ধকারে পতিত হচ্ছে। শুধুমাত্র চাটাইয়ের মধ্য দিয়ে কুচিকুচি আলো আসছে। মনে হচ্ছে, কেউ যে ঝাঝর দিয়ে আলোকবন্যা বইয়ে দিচ্ছে!
একটু একটু করে মাটি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে আলো আসবার সব পথ। আমি মোহাবিষ্টের মত দেখছি শেষ আলোর ঝিলিক। কিছুক্ষণের মধ্যেই চাটাইয়ের প্রায় সবগুলো ফুটো বন্ধ হয়ে গেল। শুধু বামদিকের এককোণে এখনও একটা ফুটো দিয়ে আলো আসছে। আহা! বিকেলের শেষ আলোর ঝিলিক। আমি চিৎকার করে বলতে চাইলা,"ওটা বন্ধ করো না! অন্ধকার আমার একদম ভাল্লাগে না!" কিন্তু আমার চিৎকার করার ক্ষমতাটুকু লুপ্ত হয়ে গেছে। তাই হয়তো কেউ আমার এই আর্তচিৎকার শুনলো না। হঠাৎই শেষ আলোর পথটাও বন্ধ হয়ে গেল। আমি ডুবে গেলাম অদ্ভুত অন্ধকারে! আমার চেতনা, অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন একটা ঘোরের ভেতর তলিয়ে যাচ্ছি! দূর থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে।কবর দেবার সময় কি আজান দেয় কেউ? এমন রীতি তো কখনও শুনিনি!! ধিরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে আজানের সুর!
খাটের মচমচানি শব্দে উঠ বসলাম। মাথার কাছের জানলা দিয়ে ফিকে আলো আসছে। তারসাথে ভেসে আসছে আজানের শব্দ! তার মানে আজানের শব্দটা সত্যিই ছিল! আমি বেঁচে আছি? অবশ্যই বেঁচে আছি। ঐ তো পাশের ঘর থেকে রূপার সুর করে পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে--"লাইফ ইজ বিউটিফুল....আ্যা.....লাইফ ইজ বিউটিফুল...অ্যা...বিউটি...বিউটি..... "
কি সুন্দর করেই না রূপা পড়ছে!
কিছুক্ষন পর সূর্য উঠবে। পৃথিবীর সাথে সাথে আমি ও উদ্ভাসিত হব, নবজন্মের স্বাদ নিতে! বেঁচে থাকাটা মন্দ নয়তো! "Life is Beautiful"!!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১:২৯