মাথার উপর ঘটঘট আওয়াজ তুলে ফ্যান চলছে।কিন্তু বাতাসের ছিটেফোটা গায়ে লাগছে না। চৈত্রের ভ্যাপসা গরম যেন উপহাস করছে ফ্যানের বাতাসকে। ঘিয়া রঙের শার্টটা ঘামে একদম লেপ্টে আছে আসগর সাহেবের। পেনশনের টাকাটা নেবার জন্য ৩ দিন এসেছেন। একবারও কাজ হয় নি।
আজও হবে বলে মনে হয় না। বেশ মোটা অঙ্কের ঘুষ না দিলে এসব কাজ কিছুতেই হয় না। কিন্তু এতো টাকা ঘুষ দেবার মতো অবস্থা তার নেই।
চোয়াল ভাঙা চিমশানো মুখের কেরানী এসে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে হাত চুলকাচ্ছেন আর বলছেন, "দেখেন আজগর সাহেব। আপনার কাগজপত্রে কিছু ঝামেলা আছে, আপনার নামে এক জায়গায় 'স' আর জায়গায় 'ছ'। এজন্য তো বিরাট মুসিবত হচ্ছে। বিরাট ক্রিটিকেল কেস। আপনার আরও কিছুদিন সময় লাগবে। আর কাজ তাড়াতাড়ি করকে গেলে তো...... হে হে হে বুঝেন ই! ", ময়লা দাঁত বের করে হাসলো সে।
"না ভাই, দেরিতেি হোক আমার কোন সমস্যা নাই, আমার টাকা পয়সার কোন টানাটানি নাই!", উঠে দাড়িয়ে হনহন করে হাঁটা ধরলেন আসগর সাহেব। বিরক্তিতে তার নাক জ্বলছে। হঠাৎ রেগে গেলে বা কষ্ট পেলে তার এমনটা হয়। নাকের পাশটায় কেমন যেন জ্বলা জ্বলা ভাব। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে। বেন এমনটা হয়।
রাস্তায় চলে এসেছেন তিনি। প্রচন্ড রোদে চোঁখ ধাধিয়ে যাচ্ছে। শার্টটা ঘামে ভিজে জবজবা। তিনি অফিসে বলে এসেছেন ঠিকই তার টাকা পয়সার টানাটানি নেই, কিন্তু তার ব্যাপারটা তিনিই জানেন। দুই ছেলের বড়টা বিয়ে করেছে, একটা ছেলে আছে আড়াই বছরের,কথা তেমন বলতে পারে না কিন্তু আসগর সাহেবকে দেখলেই 'দাদ্দা, দাদ্দা' শুরু করে । ছোট ছেলেটা অনার্সে পড়ছে পাশের কলেজে। আর মেয়েটা এবার কলেজে উঠলো। বড় ছেলের অল্প টাকার চাকরী, তাতে বউ-বাচ্চা পালতেই হিমশিম খাবার কথা, তারউপর দুই ভাই বোনের পড়ার খরচ, এখন আবার যোগ হয়েছে বুড়ো বাপটার খরচ। ভাগ্যিস, তাদের মা টা অনেক আগেই মরে গিয়েছিল, নাহলে তো মা টাকেও পালতে হতো ।
এমন অবস্থায় ছেলের কাছে হাত পাততেও লজ্জায় মাথা কাটা যায়। তাই পেনশনটা তার খুবই জরুরী ছিল।
একটা রিকশা নিলে বেশ হতো, যা গরম! কিন্তু খামখা ২৫ টাকা খরচ করে বাবুয়ানির দরকার নেই। এমনিতেই মফস্বল এলাকা, রিকশাভাড়া বেশি । এরচে একটু পা চালিয়ে বড় রাস্তায় উঠে যেতে পারলে বাঁচি । সেখানে রাস্তার পাশে গাছ আছে, ছায়ায় ছায়ায় চলে যাওয়া যাবে। রাস্তার পাশে তরমুজের টুকরা বিক্রি করছে, এতটুকুনি টুকরা ১৫ টাকা । লাল টুকটুকে তরমুজ। খেতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু খেলে আবার খালি খালি ১৫ টাকা লস। এখন সংকট সময়, সামলে চলতে হবে । পেনশনের টাকাটা পেলে একটা আস্ত তরমুজ কিনে বাসায় যাবেন, মনে মনে ঠিক করলেন তিনি।
এক গেলাস লেবুর সরবত খেলেন আসগর সাহেব।রোদে যেন শরীরের সব রস উবে যাচ্ছে। পাঁচ টাকা গ্লাস। গ্লাসে অল্প একটু লেবুর রস আর বিট লবণ দিয়ে বার কয়েক ঝাকুনি দেয়া হয়। তারপর এক টুকরা বরফ ছেড়ে দিয়ে সরবত বানানো হয়। খেতে খারাপ না কিন্তু খাওয়াটা ঠিক হলো কি না বুঝতে পারছেন না। পাঁচ টাকায় অটোতে করে যাওয়া যেত। তাহলে এতটা হাটতে হতো না । থাক কি আর করা? খেয়ে যখন ফেলেছেন, এখন তো আর কিছু করার নেই!
কি যেন একটা ভাবতে ভাবতে হাটার গতি বাড়ালেন। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌছুতে হবে।