আমার এক বন্ধুর আজ জন্মদিন। কিন্তু তার এই শুভ জন্মদিনটিতে সে বিষন্ন থাকে। কেননা আজ ২৫ মার্চ। ২৫ মার্চ কালো রাত। পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বর একটি রাত। আমাদের বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য একটি অধ্যায়। শুধু সেজন্যই নয় । এই ২৫ মার্চ রাতে তার বাবা জগন্নাথ হলের গণহত্যার লাইন দাড়িয়ে থেকেও অলৌকিক ভাবে বেচে যান । সেই কথা ভেবেই মেয়েটি শিউরে উঠে, প্রতিবছর ২৫ মার্চ এলে তার বিষন্ন মুখটি মনে পড়ে ।
সেই বন্ধুর বাবা-মা দুজনই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন । ছিলেন কমরেড। তার বাবা কমরেড কালী রঞ্জনশীল, গত হয়েছেন আশির দশকের শেষভাবে । তার জবানীতে তিনি লিখে গেছেন সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা "জহন্নাথ হল-এ ছিলাম" । যা রশীদ হায়দার সম্পাদিত "১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা" বই ছাপা হয়েছিল যা জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ ১৯৮৯ সালে প্রকাশ করেছিল।
(আমি সেই বাংলা লেখাটার একটা ইংরেজি অনুবাদ পেয়েছিলাম মেইল মারফত । যা Century of Genocide: Eyewitness Accounts and Critical Views; New York: Garland Publishing, 1997
Chapter 10, pp. 291-316 থেকে নেয়া ।সেখানে Massacre at Jagannath Hall নামে সেই ইংরেজি অনুবাদটি করেছিলেন সোহেলা নাজনীন। আমি সেখান থেকে বাংলা করার চেষ্টা করেছি।)
জগন্নাথ হল-এ ছিলাম
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র ছিলাম। জগন্নাথ হলের দক্ষিণ ব্লকের ২৩৫ নং রুমে বাসিন্দা ছিলাম। ২৫ শে মার্চ রাত, আমি ঘুমছিলাম, হঠাৎ পাকিস্থান সেনাবাহিনীর গোলাগুলির ভয়ংকর শব্দে ঘুম ভেংগে চমকে উঠলাম। চারদিকে ভয়ংকর গোলাগুলির শব্দ, থেকে থেকে গোলাগুলির শব্দও বোমা আর গোলা বিস্ফোরণ এর শব্দের নিচে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল। আমি এতোটাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে আমার কি করা করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলাম না ! কিছুক্ষণপর আমি ঠিক করলাম সুশীলের কাছে যাই। সুশীল তখন ছাত্র ইউনিয়নের সহকারী সাধারণ সম্পাদক । আমি খুব ধীরে ধীরে সিঁড়িতে হামাগুড়ি দিয়ে তৃতীয় তলায় সুশীলের রুমে গেলাম। ততোক্ষণে সুশীলের রুমে অনেক ছাত্রই আশ্রয় নিয়েছে কিন্তু সুশীল রুমে নেই। তখন আমাকে অনেক ছাত্রই বলল ছাদে যেতে যেখানে অন্যান্য অনেক ছাত্রই আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু আমি আমার নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিলাম (হয়তো স্বার্থপরের মতোই) তারপর তিনতলার উত্তর কোনের বাথরুমের দিকে হামাগুরি দিয়ে গেলাম আর সেখানেই আশ্রয় নিলাম । আমি বাথরুমের জানালা দিয়ে পূর্ব, দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিক দেখতে পাচ্ছিলাম। দেখতে পেলাম যে পাকিস্থানী সৈন্যরা ফ্ল্যাশ লাইট দিয়ে রুমে রুমে ঢুকে ছাত্রদের খুঁজছে, যাদেরকেই পাচ্ছে তাদেরকে শহীদমিনারের দিকে নিয়ে গিয়ে জড়ো করে গুলি করে মারছে। তখন চারদিকে কেবল গুলির শব্দ আর ছাত্রদের আর্তচিৎকার, প্রাণ বাচানোর আকুতি। এর মাঝে কখনও কখনও পাকিস্থানীরা মর্টার দিয়ে গুলি করছিল। সংসদহলের সামনের টিনশেড ভবনে এবং উত্তর ব্লকে কিছু রুমে তখন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।...
...কিছু সময় পর প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশজন পাকিস্তানী সৈন্যে আমাদের দক্ষিণ ব্লকে এলো এবং ডাইনিং রুমের দরজা ভেঙে ফেলল। ডাইনিং রুমের ঢুকেই তারা লাইট জ্বালালো এবং এরপর ডাইনিং রুমে আশ্রয় নেয়া ছাত্রদের গুলি করতে শুরু করল। তারপর যখন সৈন্য বাইরে বেরিয়ে এলো তখন তারা সাথে করে হলের কেয়ারটেকার প্রিয়নাথকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে বাইরে নিয়ে এলো। তারকাছ থেকে হলের সিড়ি আর অন্যান্য ভবনগুলোতে যাবার রাস্তা দেখেতে তাকে বাধ্য করেছিল। তারা সেদিকে গেল। এই সময়রে পর থেকে আমি আর দেখতে পাচ্ছিলাম না । তখন আমি বাথরুমের জানালা দিয়ে বেরিয়ে তিনতলার সানশেডে আশ্রয় নিলাম । কিন্তু তখনো আমি বন্দুকের গুলির শব্দ, ছাত্রদের আর্তনাদ আর প্রাণবাচানোর আকুতি শুনতে পাচ্ছিলাম, আর সৈন্যরা প্রতিটি রুমে ঢুকে রুম তছনছ আর দামি জিনিষপত্র লুটপাটের শব্দ তাদের পৈশাচিক উল্লাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তবে আমি তিনতলার সানশেড এ থাকায় তারা আমাতে দেখতে পায়নি ।
………এরপর তারা চলে গেলে আমি আবার বাথরুমে আশ্রয় নেই । সেই বাথরুমের জানালা দিয়ে আমি দেখলাম অন্যান্য হল, এসএম হল আগুনে জ্বলছে। ঢাকার উত্তর আর পূবদিক জ্বলছে, উত্তর আর পূবের দিগন্ত তখন লাল হয়েছিল। পুরো রাত জুড়ে পাকিস্তানী সৈন্য তাদের গণহত্যা এবং ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেল। ধীরে ধীরে একসময় ভোরের আযান ভেসে এলো। আমি তখনো বাথরুমে ঘাপটি মেরে দাড়িয়ে আছি…..
…….সেই ভোরে কারফিউ জারি করা হয়েছিল এবং ভেবেছিলাম দিনের আলোয় হয়তো এই ধ্বংসলীলা আর গণহত্যা বন্ধ হবে। কিন্তু সেই গণহত্যা চলতে থাকল। পাকসেনারা তাদের হত্যা শুরু করল যারা আগের রাতের তাদের চোখ ফাকি দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল।....
…. তখন সকাল হয়ে গেছে কিছু ছাত্রের কণ্ঠস্বর শুনে আমি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। দেখি ছাত্ররা ধরাধরি করে একটি মৃতদেহ নিয়ে সিড়ি দিয়ে নামছে আর সৈন্যরা তাদের দিকে বন্দুক তাক করে ধরে আছে। সেই মৃতদেহটি আমাদের কেয়ারটেকার প্রিয়নাথের। সৈন্যরা আমাকে দেখে মৃতদেহটি বহন করার জন্য ছাত্রদের সাথে হাত লাগাতে বলল। আমি তাদের নির্দেশ মতো হাত লাগালাম। আমার সব রুম থেকে ছাত্রদের মৃতদেহ গুলো বয়ে নিয়ে এস মাঠে স্তুপ করছিলাম।
....আমরা সর্বমোট তিনজন ছাত্র ছিলাম, আমাদের দারয়োনের দুই ছেলে আর বাকি কয়েকজন হলের দারয়োন ছিল । তারা বাংগালী ছিল না। তারা পাকিস্থানী সৈন্যদের বলল যে তারা বাংগালী নয়, তাদের ছেড়ে দেয়া জন্য আবেদন করছিল । কিছুক্ষণ পর সৈন্যরা তাদের আমাদের থেকে আলাদা করে ফেলল।
.... পুরো সময় জুড়ে সৈন্যরা গালিগালাজ আর অভিশাপ দিচ্ছিল। সৈন্য বলেছিল " আমরা দেখব কিভাবে তোরা স্বাধীন বাংলাদেশ পাস ?? এখন জয় বাংলা , জয় বাংলা করিস না কেন ?? "এই বলে তারা ছাত্রদের লাথি মারছিল। মৃতদেহ গুলো টানা শেষ হলে তারা আমাদের কয়েকটা দলে ভাগ করল। তারপর আমার দলটি নিয়ে তারা হলের শিক্ষকদের আবসিক কোয়ার্টারে গেল এবং প্রতিটি তলার প্রতিটি রুম কন্নতন্ন করে খুজল আর দামি মালামাল লুট করল। নিচের সিড়িতে গতরাতের মৃতদেহ গুলো ফেলে রাখা হয়েছে স্তুপ করে। আর তারা উপর থেকে বাংলাদেশের পতাকাটা নামিয়ে আনল ।
....ফিরে আসার পর আবার সৈন্যরা মৃতদেহ গুলো শহীদমিনারের দিকে নিয়ার নির্দেশ দিলো। তার আগেই সৈন্যরা গতরাতের শিকার আরো মৃতদেহগুলো স্তুপ করে রেখেছিল। আমরা সেই মৃতদেহের স্তুপে আর কিছু মৃতদেহ যোগ করালাম। মৃতদেহ গুলো বয়ে নেয়ার সময় আমার ক্লান্ত হয়ে পড়লে তারা আমাদের হত্যার হুমকি দেয় আর দ্রুত কাজ করা তাগিত দিতে থাকে ।
আমার সাথে তখন আমাদের হলের দারয়োন সুনীল ছিল । হঠাত আমরা নারী কণ্ঠের ভয়ংকর চিতকার শুনলাম । ঐ মহিলা আমাদের হলের পাশের বস্তি থেকে চিতকার করে বেরিয়ে এলো । কেননা পাকিস্থানী সৈন্যরা আমাদের সাথে থাকা সেই অবাংগালীদের গুলি করে মারছিল। সেই দলে ঐ মাহলার স্বামীও ছিল। আমি বুঝতে পারলাম এরপর আমাদের পালা আসবে ।যেভাবে আমাদের আগের ছাত্রদের লাইন করে মারা হয়েছে । আমি এবং সুনীল মৃতদেহ গুলো পালা করতে করতে দেখতে পেলাম ড: দেব এর মৃতদেহ যিনি দর্শনের শিক্ষক ছিলেন । তখন ঠিক ঘোরের মাঝে ছিলাম । আমি বুঝাতে পারব না আমি কি করছিলাম কিংবা আমি কি করব ?? হতে পারে বেচে থাকার জন্য প্রবল আশা থেকে কিংবা অনুপায়ী হয়ে ।
মৃতদেহ গুলো স্তুপ করার পর আমাদেরকে দাড় করানো হলো । আমি অপেক্ষা করছিলাম সৈন্যের কখন আমাদেরকে গুলি করে। তারপর …??.. আমি এমনকি ভেবেছিলাম যে আমি মরে গেছি। আমি শুয়ে ছিলাম ডঃ দেব এর পাশে আর সুনীলের নীচে । অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে । কিছু সময় পরে মহিলা এবং শিশুর কান্না শুনে আমি চোখ মেললাম । দেখি আমি অক্ষত । ততোক্ষণে সৈন্যরা চলে গেছে । আমাদের মৃতস্তুপগুলোর মাঝে তখনো অনেকের প্রাণ ছিল । অনেকে মারাত্মক আহত অবস্থায় কাতরাতছিল । আমি বাচার জন্য দ্রুত মাঠ ছাড়লাম ।
আমি হলের কর্মচারীদের বস্তির মতো বাড়ি গুলোর দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলাম । প্রথমে আমি আমাদের ইলেকট্রিশিয়ানের বাসায় ঢুকলাম । আমি বাসয় ঢুকেই পানি আর আশ্রয় চাইলাম । আমাকে দেখেই তার বউ ই
উচ্চ শব্দে কাদতে শুরু করলে আমি হলের গেস্টরুমে গিয়ে আশ্রয় নিলাম । আমি . হঠাৎ করে ইদুর যে পুরনো পুস্তক বিক্রি করত, তার গলার স্বর পেলাম । সে বলল-
“ ভয় পাইয়েন না । আমি শুনছি যে আপনি জীবিত আছেন । আমি আপনাকে নিরাপদে পালানোর ব্যবস্থা করে দিবো।” এরপর সেথান থেকে আমি পুরনো ঢাকায় গেলাম । পুরান ঢাকা থেকে তারপর আমি নৌকায় করে বুড়িগংগা নদী পার হলাম, পার করে দেয়ার জন্য মাঝি আমার কাছে কোন টাকা নেয় নাই। সেখান থেকে আমি প্রথমে শিমুলিয়া যাই, শিমুলিয়া থেকে যাই নবাবগজ্ঞ এবং এপ্রিলের মাঝামাঝিতে আমি আমার বরিশালে গ্রামের বাড়িতে পৌছাই ।