ঢাকার বাইরে যাওয়া হয় না অনেক দিন। ঢাকার বাইরে বলতে শুধু মাত্র রিফ্রেসমেন্ট ট্যুরের জন্য। তাই মন ছুট ছুট করতেছিলো। সেই লোভের জিভে পানি ছড়ালো পর্যটন দিবস। প্রথম আলো পর্যটন দিবসে তাদের ফার্স্ট পেইজে একটা ছবি ছাপলো রাতারকুল নামের একটা স্থানের। অর্ধেক পানির নিচে একটা বন। এই স্থানের ছবি আমি আগেও দেখছি। তখন অন্য এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। ঐ প্রতিষ্ঠানের এক বড় ভাই একদিন দেখাইলেন, এই দেখেন। আমি তো দেইখ্যা ভাবলাম এই বন হয়তো ভারত-শ্রীলংকা কোনও এক দেশে হবে। কিন্তু তিনি বললেন, না। এইটা দেশে। সিলেটে। কয় কি? দেখি আর আশ্চর্য হৈ। এত সুন্দর বন বাংলাদেশে? হ্যা, সত্যি। এত সুন্দরই এই এলাকা। প্রায় ৭০০ একর জমি বর্ষার সময় থেকে পানির নিচে থাকে সিলেটের এই নিম্ন অঞ্চলটা। যার একটা বড় অংশই বন। আর এই বনের গাছগুলো পানির নিচ থেকে তার শরীর ভাসিয়ে সূর্যের তেজ আর নিজের শক্তি সংগ্রহ করে বেঁচে থাকার। তিন ঘন্টা নৌকা নিয়ে ঘুরেও এই বন শেষ হয় না। পত্রিকায় প্রকাশিত এই ছবি দেখে তাই মন উচাটন হয়ে গেলো। কি আর করা, উচাটন মন তো আর ঘরে বেঁধে রাখা যায় না। আমিও তাই খবর লাগাইলাম। সিলেটের ফটোগ্রাফার বন্ধু বেলালরে ফোন দিলাম।
সে খোঁজ খবর নিলো। নিয়া জানাইলো, শহর থেইক্যা খুব বেশী দূরে না। যাইতেও তেমন কোনও ঝামেলা নাই। আমি জিগাইলাম, একদিনরে ট্যুর হৈলে সম্ভব নাকি? সে বললো, চলে আসো। আমার তখন মুখে মধুর হাসি। আইচ্ছা, আইতেছি। কিন্তু এই ধরনের ট্যুরে তো একলা গিয়া মজা নাই। তাই সঙ্গি খুঁজতে নাইম্যা গেলাম। প্রথমে দুই তিনজনরে জিগাইলাম, কেউ রাজি হয় না সময়ের অভাবে। শেষে একজন রাজি হৈলো। তারে নিয়া যখন পরিকল্পনা গোছাইলাম। তখন ধীরে ধীরে আরও তিনজন বাড়লো। কিন্তু ট্রেনের টিকিট পাইলাম না। তারপরও যাওয়ার পরিকল্পনা থেইক্যা পিছাইনাই। কিন্তু আতকা একদিন আমার খুব জরুরী কাজ পইরা গেলো। কি আর করা। আমি সবাইরে কইলাম, তোমরা যাও। আমি নাহয় পরের সপ্তাহে আবার আসবো। কিন্তু তারা কেউ আমারে ছাড়া যাবে না। কি আর করা, এই ভালোবাসার মূল্য তো দিতেই হয়। পরের সপ্তাহে বহু নাটকীয়তার পর আমরা সিলেটগামী রাতের উপবনে চড়ে বসলাম। আমরা ট্রেনে কেউ আগে সিলেট যাই নাই। দুই জনের একবার একবার কইরা সিলেট যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, তবে তাও সীমিত। কিন্তু তুলনামূলকভাবে আমার শহরটা চেনা ছিলো বৈলা তেমন কোনও প্রব্লেম হয় নাই। ট্রেনের শিডিউল অনুযায়ী ভোর ৫.৫০ মিনিটে এইটা সিলেট শহরে থামার কথা। কিন্তু কি আশ্চর্য, ট্রেন তো দেখি ৫টায় আমাদের নামাইয়া দিলো। সারারাত একটা মিনিট ঘুমাইতে পারি নাই। কিন্তু আর ঘুম আসলোও না। এই অবস্থায় এই ভোরবেলা ফোন দিয়া বেলালরে জাগাইলাম। বেলাল আমাদের রিসিভ করলো, আম্বরখানা মোরে। এইখানে তার বাসায় ফ্রেস হওয়ার উসিলায় ঢুকার পর শুরু হৈলো ভালোবাসার অত্যাচার। এই ভোরবেলা বেলালের বউ শাশুরি মিলে আমাদের চমৎকার সব পিঠা বানাইয়া দিলো গরম গরম। খাইলাম। টিপটিপ বৃষ্টি পরতেছে। বেলালের আশঙ্কা, আবহাওয়া ভালো না হৈলে তো ভালো ছবি পাওয়া যাবে না। আমি কইলাম, মিয়া চিন্তা কৈরো না। আবহাওয়া ঠিক হৈয়া যাইবো। তার মন তবুও খুত খুত করে। নাস্তা কইরা দুইজন বায়না ধরলো শাহজালালের মাজারে যাবে। নিয়া গেলাম। মাজার থেকে ফেরাও হৈলো। ততক্ষণে সাড়ে সাত বাজে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এখনই রওনা দেই। বেলা থাকতে ফেরত আসা যাবে। কিন্তু ভালোবাসার অত্যাচার তো এখনো শেষ হয় নাই। সবার জন্য বিরিয়ানি রান্না হয়ে গেছে ততক্ষণে। কি আর করা। এক প্লেট করে সাবার করে দ্রুত ছুটলাম। শহর থেকে সিএনজি যায় মোটরঘাট পর্যন্ত। একটা সিএনজিতে পাঁচজন যাওয়া যায়। প্রতি জনে নেয় চল্লিশ টাকা করে। আমরা একটায় উঠলাম ৫জন, একটায় ৬জন। গিয়ে পৌঁছালাম মোটরঘাট। সেখানে পাওয়া গেলো, একই সাথে মাজার আর মন্দিরের দেখা। এখান থেকেই নৌকা নিতে হয়। ছোট ছোট নৌকা। তিনজনের বেশী কেউ নিতে চায় না। আমরা তাই তিনজন করে উঠতে চাইলেও আমাদের তিনটা নৌকায় ১১জন উঠলাম। একটায় তিনজন, বাকী দুইটায় চারজন করে। বনের ভেতরে ঢুকতেই চোখ ভরে গেলো।
কি চমৎকার। আমরা গাছের প্রতিবেশী। তাদের সাথে ভাসছি। ২০ মিনিট চলার পর এক জায়গায় এসে নৌকা পৌঁছাইলো। সেখানটারে মনে হয় পানির স্টেডিয়াম, আর গাছগুলো দর্শক। এই চমৎকার স্টেডিয়াম পেয়ে আশিক হঠাতই তার সাঁতার নৈপুন্য দেখানোর জন্য নৌকা থেকে লাফ দিয়ে পানিতে নেমে গেলো। দেখাদেখি আমিও নামলাম। আমার দেখাদেখি আরও চারজন। আমাদের সাতার নৈপুন্যে রাতারগুল মুগ্ধ। ৩০ মিনিটের মতন সময় এই কর্ম করে, আমরা এবার বনের অন্যপাশে দিয়া ঘুরতে গেলাম।
প্রত্যেকটা দিকই চমৎকার। একেক জায়গায় একেক রকম। কিন্তু পুরোটাই পানির ভেতর থেকে উঠে আসা। আমি আসলেই মুগ্ধ। এক জায়গায় এসে গাছে সাপ বসে থাকতে দেখলাম। কিন্তু আমাদের ফটোগ্রাফাররা এই ওয়াইল্ড দৃশ্য তাদের ক্যানভাসে ধরে রাখতে পারলোনা বলে আফসোস রইলো। এই আফসোস নিয়েই ফিরলাম শহরে। শহরের বাকী সময় রীতিমত ভালোবাসার অত্যাচারে কাটিয়েছি আমরা। আর সাথে ভিন্ন ধরনের কিছু অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই। তবে আমি একদিনের ট্যুরে এখন পর্যন্ত যেখানেই যাই না কেনো, এই রাতারগুলের কথা ভুলবনা কখনো। বেলালকে একটা ধন্যবাদ না দিলেই নয়। সে না থাকলে হয়তো যাওয়াই হতো না।
কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে সিলেট, ট্রেনে শোভন ভাড়া ২৯৫ টাকা অথবা বাসে নন এসি ৪৪০ টাকা। সিলেট বাসে গেলে আম্বরখানা রিকশা নেবে ১০টা ২ জন। এখান থেকে সিএনজি মোটরঘাট প্রতি সিএনজিতে ৫জন নিবে, ২০০টাকা। মোটরঘাট থেকে নৌকা নিবেন, তিনঘন্টার জন্য ২০০ টাকা নিবে। ফেরার সময় মোটর ঘাটেই সিএনজি পাওয়া যায় একই ভাড়ায়।