পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ মিইয়ে আসতে শুরু করেছে চারিদিকে।আলো আধারের এ লুকোচুরি খেলাটা দেখতে ভালো লাগে জয়ের।দিনের আলোটা কেমন যেন তরল হয়ে আসতে আসতে শুন্যে মিলিয়ে যায়।সে জানালার পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।জানালার ওপাশেই একটা নদী।অবশ্য এটাকে নদী বলা ঠিক না।এটা একটা বাওড়।নাম বেতনা।বর্ষার মৌসুমে বাওড়ের কানায় কানায় পানি থৈ থৈ করে।তবে এখন বর্ষা কাল না।পুরো বাওড়টা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।বাওড়ের বুকে জন্ম নিয়েছে ভুইচাপাতি ঘাস।
জয়ের কাছে প্রতিদিনের সন্ধ্যে থেকে আজকের সন্ধ্যেটা আলাদা হয় নি।যদিও হবার কথা ছিল।কারণ কাল ঈদ।তবে কেন জানি তার কাছে ঈদের আনন্দ টা ঠিক আনন্দ হয়ে ধরা দেয়না কখনো।এটা ঠিক বন্দিত্ব কিনা যে জানে না।
জয়ের এখনি বই নিয়ে বসতে ভালো লাগছে না মোটেও।মাইকে হরেক রকম গান বাজছে।কিছু সময় ধুম ধাড়াক্কা হিন্দি আবার কিছু সময় বাংলা আবার কখনো পাড়ার শিমুল,সোহেলের,আরো কার কার জানি গলা শোনা যাচ্ছে।সন্ধ্যা থেকেই ঈদগাহ সাজানো শুরু করে ওরা। দুইদিন ধরে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ঈদের চাঁদার ‘কালেকশন’ যদি ভালো হয় তবে আগের দিন বিকেলেই মাইক ভাড়া করে ফেলে ওরা।তারপর চাঁদ দেখা যেতে যতটুকু বাকি।শুরু হয় গানের আসর।ঈদগাহের খুঁটিগুলোতে রঙিন কাগজ কেটে কেটে ফুল বানিয়ে সাজায় ওরা।কিন্তু ঠিক কিভাবে কি করে জয় ঠিক জানে না।সে সকালে নামাজ পড়তে গেলেই দেখে সুন্দর সাজানো গোছানো ঈদগাহ।নিজের পাড়ার মধ্যে তার নিজেকে এলিয়েন এলিয়েন লাগে তখন।
প্রতিবার ঈদ আসার আগে জয় ভাবে এবার সে মজা করবে।পাড়ার ছেলেদের সাথে থেকে ঈদগাহ সাজাবে।কাঁপা হাতে মাইক্রোফোন ধরে গান গাইবে।সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা পর্যন্ত সব ঠিকই থাকে। সবার সাথেই সে রাস্তার মাথায় দাড়িয়ে থাকে চাঁদ দেখার জন্য। অনেক চাঁদ না দেখেও হঠাৎ ‘চাঁদ উঠেছে, চাঁদ উঠেছে’ চিৎকার শুরু করে দেয়। অনেকে নিজে কিছুই না দেখেও হাত উচু করে অন্যকে চাঁদ দেখানো শুরু করে। অসম্ভব মজা হয় তখন।কিন্তু ফাইনালি চাঁদ দেখা হয়ে গেলেই তার ডাক পড়ে বাড়িতে।প্রতিদিনের মতো হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসো।বিচ্চিরি ব্যাপার।চাঁদ রাতে আর কেউ পড়তে বসে কিনা সে জানে না।
জয় অবশ্য এইভাবে চলতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে।বিকেল থেকেই পাড়ার ছেলে গুলো নানা ধরনের খেলার আসর জমায় এই বাওড়ের মধ্যে।লোল্লাছুট, সাতমালা, ফুটবল এমন কি ক্রিকেটও।জয় শুধু দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখে।পাড়ার ছেলেগুলোর দলে সে মিশতে পারে না।তার ঐ দলগুলো থেকে সে যে কবে কিভাবে আলাদা হয় গেছে নিজেও জানে না।ঘরের মধ্যে খুব বেশী হাঁপিয়ে গেলে মাঝে মাঝে সে অবশ্য চলে যায় বাওড়ের মাঝে সৃষ্ঠ হওয়া মাঠে।তবে তখন তার হাতে থাকে গল্পের বই।সবার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে নরম ঘাসের বিছানায় বসে বসে বই পড়ে সে।তখন অবশ্য সবার চোখ বাঁচিয়ে ঘাসের বিছানায় গড়াগড়িও খাওয়া হয় তবে তাতে পাড়ার ছেলেগুলোর মতো আনন্দ পায় না সে।তাকে সন্ধ্যা নেমে যাবার আগেই ঘরে ফিরে আসতে হয়। তারপর হাতমুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে।
নিজেকে কেমন যেন একটু আলাদা মনে হয় তার। বিশেষ করে এ পাড়ার ছেলেদের থেকে।এপাড়ায় তার কোন বন্ধু নেই।স্কুলে তার যে বন্ধুগুলো আছে তারা অন্য গ্রামের।বিকেল বেলা তাদের সাথে খেলা ধুলা করার সুযোগ হয় না।সে কোন ভাবেই নিজেকে কোন ধরনের খেলাধুলার সাথে যুক্ত করতে পারেনি।কারন তার বাবা খেলাধুলা পছন্দ করেন না।তার মতে খেলার মাঠে গেলেই হাত পা কিছু একটা ভাঙবে।অবশ্য জয়ের ও এ পাড়ার ছেলেগুলোকে মোটেও পছন্দ নয়।কেউই স্কুলে যায় না।আর স্কুলে না গেলে তার সাথে বন্ধুত্ব হবে কিভাবে?
জয় অবশ্য এই একাকিত্বতাকে জয় করার জন্য বই পড়ার নেশায় নিজেকে ডুবিয়ে দেয় সে।তবে স্কুলের বই না।গল্পের বই।তাদের গ্রাম থেকে চার কিলোমিটার দূরে একটা পাবলিক লাইব্রেরি আছে।ওটা তাদের স্কুলেরই পাশে। স্কুলের সকলেই ঐ লাইব্রেরির সদস্য।হয় সপ্তাহে দুই তিন দিন বিকেলে বিকেলে লাইব্রেরীতে গিয়ে বই পাল্টে আনে।সত্যজিৎ রায়ের বইগুলো সব পড়া হয়ে গেছে।এখন সে শরৎচন্দ্র পড়া ধরেছে। বই পাল্টাতে বিকেলে বের হলে বাবা কিছু বলেন না।
তবে এই অভ্যস্থতার মধ্যেও এই একটি দিন তার খারাপ লাগে।মনে হয় এটা পরাধীনতা।এটা বাড়াবাড়ি।কিন্ত বাবার মুখের ওপর কিছু বলার মতো সাহস তার নেই।নেই কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার অভ্যাস।তাই শুধু চাঁদ রাত না ঈদের রাতও তাকে পড়ার টেবিলে বসেই কাটাতে হয়।সে জানে না সে বড় হয়ে কি হবে।তবে মনে হয় বাবা মনে করে অনেক বড় কিছু হতে হবে তাকে।তা নাহলে কি পড়ার টেবিল থেকে ঈদের দিনেও তার জন্য ছুটি মেলেনা???
লেখাটি সামুর ব্লগারদের শৈশবের ঈদ-প্রথম পর্বে পূর্বে প্রকাশিত।