স্বরুপ দাস, প্রশি, আজমপুর সপ্রাবি, কেন্দ্রিয় যুগ্ন আহবায়ক, আহবায়ক খুলনা বিভাগ, সাধারন সম্পাদক, দামুড়হুদা
view this link
অনেক শিক্ষক আছেন, সম্মান হারানোর ভয়ে সঠিক কথা বলতে পারেন না। যে শিক্ষক সমাজে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র, সেই শিক্ষককে অপমানিত হতে হয় ব্যবস্থাপনা কমিটির শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ব্যক্তির কাছে। যে শিক্ষকের মাথা উঁচু করে থাকার কথা, সেই শিক্ষককে সইতে হয় অপমান আর গ্লানি। বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাতের জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা অনেক সময় বিদ্যালয়ে অনভিপ্রেত পরিস্থিতি তৈরি করেন। অনেক সময় এতে শিক্ষক নামের কলঙ্করূপী কিছু শিক্ষকের যোগসাজশও থাকে। ফলে স্কুলের আর উন্নয়ন হয় না।
তবে বিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটির ইতিবাচক দৃষ্টান্তও আছে আমাদের দেশে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যালয় অবিরত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পথে এগিয়ে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
শিক্ষাদান করার ক্ষেত্রে শিক্ষকের যে আয়োজন থাকার কথা তার প্রতিফলন কি সব স্কুলে সব শিক্ষক ঘটান? উত্তর অবশ্যই আশাব্যঞ্জক হবে না। প্রতিটি স্কুলে উপকরণ সরবরাহ করা হয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু নির্দেশনা অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন হয় না। এই সত্যটা উল্লেখ করলে সংশ্লিষ্ট কর্মে নিযুক্ত পেশাজীবীরা আবার ক্ষেপে ওঠেন। যেন মানুষ সব দোষের ঊর্ধ্বে। তারা তো কোনো অন্যায় করতে পারে না। যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখেই বলছি। ক’জন শিক্ষক নিজের কর্মের আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মোপলব্ধি করেন? ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শ্রেণী পরিদর্শন করবেন। সেজন্য উপকরণ ও পাঠ পরিকল্পনা ক্লাসে নিতে হবে; স্বভাবত প্রশ্ন জাগে—তাহলে অন্য সময়? অন্য সময়ের গুরুত্ব কি বৃথা যাবে? ওই বিষয়টি কি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পাঠ দেয়া হবে না শিক্ষার্থীকে? যদি শিক্ষার্থীর উদ্দেশে পাঠ দেয়ার কথা থাকে, তাহলে তো সেটা চলমান থাকার কথা। তবে সব ক্ষেত্রে এই বক্তব্য সঠিক নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো দৃষ্টিগোচর হয়। এছাড়া পেশার প্রতি আন্তরিকতা কর্মের মানকে বহুগুণ সমৃদ্ধ করে। আন্তরিকতা দিয়ে অনেক অসাধ্য কাজও সম্পন্ন করা যায়।
শিক্ষকরা পেশার প্রতি কতটা আন্তরিক তা দেখা যায় তার কর্মতত্পরতার মধ্য দিয়ে। এছাড়া অনেকে রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগান। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা সে দলের পরিচয় দিয়ে হোমরা-চোমরা বনে যান। এ কারণে শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করেন না। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশনা মানেন না।
আবার কিছু শিক্ষক আছেন, পেশাগত জীবনের চেয়ে নিজের ব্যক্তিজীবনকে বেশি প্রাধান্য দেন। ফলে গল্প-আড্ডা ও উপরি পাওয়ার বিষয়গুলো তাদের মনে স্থান পায় বেশি। শ্রেণীর পাঠদান প্রক্রিয়া সফল করার বিষয়টা হয়তো তাদের মনেই থাকে না।
শিক্ষক ক্লাসে গিয়ে শুধু শিক্ষার্থীদের কাজই দিল কিন্তু বিষয়ের ধারণা দিল না, তাহলে শিক্ষার্থী বিষয়টা বুঝবে কীভাবে? বিষয়ের উপস্থাপনা যদি শিক্ষার্থীর মনে চিন্তার ডানা না মেলে তবে তো যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরে রয়ে যাবে। অনেক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে বলতে শোনা যায়, এগুলো একেবারে গাধা। স্বীকার করি এরা গাধা। কিন্তু গাধাকে তো প্রয়োজনীয় খাবার দিতে হবে। না হয় বোঝা টানবে কীভাবে? তবে এটা ধ্রুব সত্য, বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের আর্থ-সামজিক অবস্থার কারণে যথাযথ সাড়া দেয় না। যা অনেক সময় শিক্ষককে হতাশায় নিমজ্জিত করে। শিক্ষক শুধু পড়িয়ে যাবেন, পরিশ্রম করে যাবেন, সে অনুযায়ী ফল না এলে কষ্ট লাগারই কথা। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর গৃহে শিক্ষার যে তদারকি ব্যবস্থা চালু থাকার কথা তা পরিচালিত হয় না।
মা-বাবা, বড় ভাই-বোন অনেক সময় খোঁজখবরও রাখেন না। বাবা-মা মনে করেন, জন্ম দেয়ার কাজ ছিল জন্ম দিলাম। মানুষ করার দায়িত্ব শিক্ষকের। শিক্ষক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন, পাঠ্য বিষয় বোধগম্য করে দিতে পারেন, প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করতে পারেন; কিন্তু শিক্ষা অর্জনের প্রাথমিক স্তর হলো পরিবার। পরিবার থেকে যদি শিক্ষার্থী আচরণ না শেখে, মানব চরিত্রের মহত্ গুণগুলো না শেখে, পরিবারেই যদি থাকে অনিয়ম, মিথ্যা, কলহ ও জরাজীর্ণ পরিবেশ—তবে সেই পরিবেশ শিক্ষার্থীর মনে কী প্রভাব ফেলবে তা তো সহজেই অনুমেয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই পরিবার থেকে যে সহযোগিতা পাওয়ার কথা তা পায় না। উপরন্তু পরিবারকে শিক্ষার্থীর সহায়তা করতে হয়। সেটা হতে পারে পাতা কুড়িয়ে, লাকড়ি সংগ্রহ করে কিংবা গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে। ফলে শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে এসে বইগুলো যেভাবে বাড়িতে রাখে, আবার বিদ্যালয়ে আসার পথে সেভাবেই বইগুলো নিয়ে নেয়। বাড়িতে অবস্থানকালে বইগুলো পড়া ও চর্চা করা শিক্ষার্থীর কর্মের পরিসরে পড়ে না। হয়তো খেলাধুলা করে, কাজ করে, ঘোরাফেরা, মারামারি কিংবা কলহ সৃষ্টি করে সময় কাটায়।
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে আরও একটি অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে শিক্ষকদের শিক্ষাবহির্ভূত কর্মে সম্পৃক্ত করা। ভোটার তালিকা তৈরি, জরিপ, বিভিন্ন তথ্য ছক পূরণ—এসব কর্মে শিক্ষকদের ওপর বিরাট চাপ পড়ে। এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত। একদিকে ছোট ছোট শিশুদের প্রতি দায়িত্ব পালন, বিভিন্ন নির্দেশনা মেনে চলাম তার ওপর এত সব কর্ম—এত নৌকায় পা দিয়ে কোন নৌকায় করে গন্তব্যে যাবেন শিক্ষকরা। শিক্ষকরা সমাজে শ্রদ্ধার পাত্র। জরিপের কাজে, ভোটার তালিকার কাজে কিংবা অন্য কোনো কাজে যখন বিভিন্ন বাড়িতে গমন করেন, তখন অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা অসৌজন্যমূলক আচরণের মুখোমুখি হন।
এটা অবশ্যই আশার কথা, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে অনেক যোগ্য লোকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যোগ্য লোক যদি যোগ্য জায়গায় স্থান না পায় তবে সেক্ষেত্রেও মরিচা ধরার সন্দেহ উড়িয়ে দেয়া যায় না। অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে অনেকে এখানে প্রবেশ করে, পরে নিস্পৃহ হয়ে পড়ে। হারিয়ে যায় আলোর কণাগুলো। এই আলোর বিন্দুগুলোকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। এদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। বিকশিত করার জন্য অবস্থান তৈরি করতে হবে। তবেই অগ্নিবিন্দু শিখায় শিখায় আলো ছড়াবে। আর এই আলোর সমাহার আমাদের সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবে।
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি হলেও এর অগ্রযাত্রা অব্যাহত গতিতে চলছে। বেশকিছু সংখ্যক মানুষের ইচ্ছা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এগোচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে কর্মরত প্রত্যেকের মনে দেশের প্রতি যদি থাকে ভালোবাসা ও মমত্ববোধ, ছোট ছোট শিশুগুলোকে আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দীক্ষা দেয়া যায়, তাহলে এদেশ হয়তো অতীতের গ্লানি মুছে ভবিষ্যতের জন্য সোনালি দিন উপহার দিতে পারবে। তখন যদি আমরা পৃথিবীতে নাও থাকি, নাও দেখতে পারি সেই সোনালি প্রভাত, তবুও দুঃখ থাকবে না। কারণ এই বীজটা যে আমাদের শিক্ষকরাই বুনেছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:১৪