এস কে দাস: আজ মহান বিজয় দিবস।index বহু লক্ষ মানুষের; নারী ও পুরুষের রক্তের অক্ষরে লেখা আমাদের এই অনির্বচনীয় বিজয়ের ইতিহাস। ত্যাগে ও সংগ্রামে সমুজ্জ্বল রক্তাক্ত সেই ইতিহাস। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়া অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়। অবসান ঘটে স্বাধীনতাকামী অবরুদ্ধ জনগণের অবর্ণনীয় রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার। হাজার বত্সরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রাণ ভরিয়া স্বাধীনতা ও মুক্তির আস্বাদ পায় এই জনপদের মানুষ। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করিয়া নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কাহারও বিজয়ের এই দিনটি একদিকে যেমন অমলিন আনন্দে ও গৌরবে ভাস্বর, অন্যদিকে তেমনই স্বজনহারা শতসহস্র মানুষ এবং সম্ভ্রমহারা বহু মা-বোনের দুর্বিষহ স্মৃতি ও বেদনায় ভারাক্রান্ত। এই দিনে বিজয়ের আনন্দ উদযাপনের পাশাপাশি জাতি তাই তাহার বীর সন্তানদের স্মরণ করে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। বিশেষভাবে স্মরণ করে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে—যাহার জাদুকরী নেতৃত্ব ছাড়া এই বিজয়ের কথা ভাবা যায় না। তবে অনিবার্যভাবে যেই বিষয়টি সবকিছুকে ছাপাইয়া উঠে, তাহা হইল প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চুলচেরা হিসাব-নিকাশ।
বিজয় অর্জনের পর ৪৩ বত্সর অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। একটি রাষ্ট্রের জীবনে ইহা একেবারে কম সময় নহে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে যে, যেইসব আদর্শ, উদ্দেশ্য ও স্বপ্নকে সামনে রাখিয়া অগণিত মানুষ জীবন দিয়াছিল, বিপুল ত্যাগ স্বীকার করিয়াছিল এই দেশের সর্বস্তরের মানুষ—তাহার কতখানি অর্জিত হইয়াছে? তবে হয় নাই, হয় নাই করিয়াও ৪৩ বত্সরে আমরা অনেক কিছুই অর্জন করিয়াছি। ৪৩ বত্সরে আমাদের বাজেটের আয়তনই কেবল বড় হয় নাই, দৃষ্টিগ্রাহ্য উন্নতি হইয়াছে জীবনমানের। গড় আয়ু বাড়িয়াছে, বৃদ্ধি পাইয়াছে মাথাপিছু আয়। নূতন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আরও স্পষ্ট ও শাণিত হইয়াছে।
গণতন্ত্র ও মৌলিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরাজমান বাস্তবতা আমাদের যতোই পীড়িত করুক না কেন, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেই বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হইয়াছে—তাহাও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। সমাজ ও অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাহা এতোটাই দৃশ্যমান যে, এই বিষয়ে বিশদ বর্ণনা অনাবশ্যক। একদা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলিয়া পরিহাস করা হইয়াছিল—সেই বাংলাদেশই এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখিতেছে। আর ইহা যে অলীক কল্পনামাত্র নহে নামিদামি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিও তাহা অকপটে স্বীকার করিতেছে। তরুণদের মধ্যে আজ যে কর্মোদ্যোগ ও উদ্ভাবনী শক্তি দেখিতে পাওয়া যাইতেছে তাহাতে আমাদের আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রহিয়াছে। সামনে পড়িয়া আছে অফুরন্ত সম্ভাবনার হাতছানি। এই সম্ভাবনার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করিতে হইলে নিশ্চিত করিতে হইবে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন। আমাদের বীর শহীদেরা যেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন—সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে ইহাই যে প্রধান চ্যালেঞ্জ তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।