(আমার নিজের হাতে যত্নের সাথে অতি দরদ করে ছবিটি তোলার চেষ্টা করেছি। ৩০ জুন ২০২১ সকাল ৮:৫২ মিনিট)
বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলতে ভারতীয় উপমহাদেশের বন্দীত্বের চিহ্ন সীমানা প্রাচীরের এপার ও ওপার বাংলার গণমানুষের সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, ভোজনরীতি, পোষাক, উৎসব ইত্যাদির মিথষ্ক্রীয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এই সংস্কৃতি পারস্পরিক রীতিনীতি থেকে ধার করা কিংবা প্রভাবান্বিত। তবুও স্বকীয় কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এই বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে একত্রীভূত করার প্রয়াস পাওয়া যায়। অপরাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক সার্বভৌমত্বের দেয়াল যখন ঠিক মতো গড়ে উঠেনি তখনো এখানকার মানুষের নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বাস, আচার, ধর্ম, ধর্মকে কেন্দ্র করে উৎসব, পার্বণ সব কিছুতেই ছিল একাত্মা। এটাতো ঠিক যে, সংস্কৃতি কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনা। সংস্কৃতি চলমান পক্রিয়া। জানায় বা অজানায়, চেতনে বা অবচেতনে প্রতি মুহুর্তে সংস্কৃতি বদলায়। কিন্তু এই বদলে যাওয়ার ধরন কখনো এতোটা নীরবে, নিঃশব্দে ঘটে যে টের পাওয়া মুশকিল আবার প্রকাশ্য রূপ ভিষণ লজ্জাকর যা নিজ নাড়ী ও সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। বাঙ্গালীর সংস্কৃতি ত্যাগের, রক্তের বিনিময়ে নির্মিত এর ঐতিহ্যের স্তম্ভ। বাঙ্গালীর সংস্কৃতির উদাহরণে যেমন রয়েছে ভাতৃত্বের ঐতিহ্য, তেমন অনেক প্রতিয়মান দৃষ্টান্ত আছে মীরজাফরিপনার।
দেশ মাতৃকার মাটির টানে, স্বাধীন দেশের বাসনায় শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে বাংলার দামাল সন্তানেরা অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের বুকের তাজা রক্ত। নিঃশেষে করেছেন দান সবুজ সতেজ প্রাণ। ভেঙ্গেছেন কপাট, কেটেছেন ললাট। কৃতজ্ঞ করেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সাধনায় কালে কালে ঘটেছে বহু বিদ্রোহ। ফরাজী আন্দোলন থেকে শুরু করে সিপাহী বিদ্রোহ, নীল চাষীদের নীল বিদ্রোহ, পাবনার কৃষক বিদ্রোহ, মাস্টারদার স্বদেশী আন্দোলনসহ ছোট বড় নানা অনেক বিদ্রোহ। উপমহাদেশের স্বাধীনতার প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারিত হয়েছিল সর্বাধিনায়ক সূর্য সেনের কন্ঠ থেকে। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর যোদ্ধা, বাংলা স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্ন দ্রষ্টা চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসিতে আত্মাহুতি দেন যা কালের প্রবাহে আজ সুদীর্ঘ অতীত।
ভৌগোলিক সীমারেখার দূরুত্ব আমাদের নাড়ী বা শিকড়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা আর দায়বদ্ধতার অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিয়েছে। নাড়ীর বন্ধনেও যোগ করেছে র্স্বাথপরতা। স্বার্থান্বেষী কিছু গোষ্ঠী মাস্টারদার স্বদেশী আন্দোলনকে আজো সাম্রাজ্যবাদীতার দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্যবাদী বলে নেতিবাচক আখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর আত্মোত্যাগ, দেশপ্রেম, দেশজোড়া তাঁর ভাতৃত্ব বোধকে হিন্দুয়ানী আন্দোলন বলে ফলাও করে যাচ্ছে নিজ স্বার্থ চরিতার্থে। অথচ মাস্টারদার ডাকে, দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ব হয়ে মা ও মাটির সোঁদা গন্ধে মত্ত মুলসমানদের মধ্যেও তখন বিদ্রোহের আলো জ্বলে উঠেছিলো।
ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম আরেক মুক্তিযোদ্ধা ও বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব বীর বাঙালি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে তিনিই প্রথম বিপ্লবী নারী শহীদ, যিনি সর্ব প্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তৎকালীন ভারতের স্বাধীনতার জন্য। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ২৪ সেপ্টেম্বর রাতের অনধকারে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব (যার সাইনবোর্ডে লিখাছিল, ‘‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ”) দখলের সময় ১৫জনের একটি বিপ্লবীদল পরিচালনা করেছিলেন তিনি। গুলিবিদ্ধ বীরকন্যা পুলিশের কাছে আটক না হতে প্রায় একশ গজ দূরে সায়ানাইড খেয়ে রক্তাত দেহখানি সমর্পণ করেন মা-মাটির বুকে।
ফাঁসির পর সূর্য সেনের লাশ তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। মৃত্যুর পর লাশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও হয়নি। সূত্র মতে জানা যায়, বিট্রিশ ক্রুজার যুদ্ধজাহাজ ‘দি রিনাউন’ এ করে বঙ্গোপসাগরে পাথর বেঁধে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল শক্তিমান পুরুষ সুর্য সেনকে। কি দূর্ভাগা উত্তরসূরি আমরা! কি নির্মম ভাগ্য আমাদের! আমাদের পূর্বপুরুষ, মুক্তির অগ্রদূত, পথিকৃত, ভারত উপমহাদেশের অবিস্বংবাধিত নেতা, বাঙ্গালীর বাঙ্গালী সত্ত্বা সূর্য সেনের পায়ে সামান্য পুষ্পার্ঘ অর্পণের সৌভাগ্যটুকুও আমাদের পাওয়া হয়নি! অন্তত সঠিক তথ্য উদঘাটনের মধ্যে দিয়ে সামান্য স্বীকৃতিটুকুও আমরা দিতে পারছি না তাঁর অবদানকে, তাঁর আত্মত্যাগকে। এ আমাদের বড় ব্যর্থতা, বড় গ্লানি। নিশ্চিয় বিচক্ষণ মহাআত্মা সূর্য সেন ঠিক বুঝতে পারছেন আমরা আসলে বড্ড অকৃতজ্ঞ। আর কিইবা কারার করার আছে আমাদের। ১৭৫৭ সাল থেকে এতো আমাদের উত্তরাধীকার সূত্রে পাওয়া। সীরাজদ্দৌলার নুন খাওয়া বিশ্বাসঘাতক সেনাপতির বংশধর আমরা। স্বভাবতই কবি গুরু যথার্থই বলছেনে, ‘‘সাতকোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি ’’।
অভিন্ন বাংলার যে তরুণী নিজের মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদের কবল মুক্ত করার জন্য যে ‘‘মরণ-স্বপন”দেখেছিলেন, তার কর্মপন্থা যুগের সঙ্গে সঙ্গে নিঃসন্দেহে আজ পরিত্যক্ত হয়েছে। এখন স্বাধীন দেশের ধনবান কর্তার ধনবতী বিবিরা আজ যারা ‘নারী অধিকার’নামে আমাদের ‘গোপাল ভাঁড়ের গল্প’ শুনিয়ে যাচ্ছেন, তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা- “কোথায় আমার নারী- আমার মা, আমার কণ্যা অথবা আমার বোন শ্রীমতি প্রীতিলতার আত্মাহুতির স্বীকৃতিসূচক অধিকার?! প্রীতিলতা তার আত্মাহুতির মধ্যে দিয়ে উপমহাদেশের মুক্তিকামী ‘ভারতীয়’কে মানুষ বানিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু ‘কুকুরগুলো’ এখনও ঠিক তখনকার মতোই রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তাঁর অপারগতা অনুস্বীকার্য।
যাকজমকহীণ অনাড়ম্বর ও ভাবলেশ ছাড়াই ওই আবক্ষ দেহখানি আজো পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়! সর্বশেষ প্রায় ৮০ বছর পর ২রা অক্টোবর ২০১২ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তাঁর আবক্ষ অবতার নির্মাণ করেছে দায়মুক্তির বাসনায়। সমগ্র ভারত উপমহাদেশকে যে ভগবান স্বাধীন ভুখন্ড দান করেছেন নিজের জীবনের বিনিময়ে, তাঁর কপালে জুটেছে মাত্র ১০০ (প্রায়) বর্গফুটের বেদী। স্থানীয় পর্যায়ে মে মাসে তাঁর জন্মবার্ষিকীতে শুধু একটা দায়সারা গোছের ফুলের মালা লক্ষ্য করা যায় প্রতিবছর। কে নিবে এই দায়? স্বাধীন ভারত না শুধু স্বাধীন বাংলাদেশ? মানুষের মাঝে প্রকৃতিকে খুঁজে বেড়ানো আমার শখ। কোন অভৌত সম্পর্কে আমি অনুগামী ভক্ত নই। আমার ভালো লাগা রক্ত-মাংসের মানুষের সর্ম্পকায়নে। আমি সার্বজনীনতায় বিশ্বাসী। তিনটি ভিন্নপথে আমার কর্মস্থলের পথপরিক্রমা। প্রতিদিন ইচ্ছে করেই পাহাড়তলী রেলওয়ের পথ দিয়ে স্বদেশী ভগবানদের আত্মাহুতির ইতিহাস রোমন্থনে দেবী রাণী প্রীতিলতার আবক্ষ মুর্তির সামনে দিয়ে লজ্জ্বিত অবনত মাথায় সমগ্র ভারবর্ষের পক্ষে দায় মুক্তির বৃথা চেষ্টা করি।
এখনকার যামানায় রাজনীতি একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, দেশ তার বিকিকিনি পণ্য, দেশপ্রেম সে ব্যবসার শর্তসাপেক্ষে পরিবর্তনশীল র্ধম, আর সার্বভৌমত্ব একটা পরিবারতন্ত্র বা রাজতন্ত্র কর্তৃক ভূসম্পত্তির পরিসীমা।
শুনেছি পুঁজীবাদি চাটুকার বুর্জুয়া কর্তৃক ওপার বাংলায় মাষ্টারদা এবং এপার বাংলায় প্রীতিলতাকে নিয়ে ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে। আচ্চা বলুনতো মশাই, এদের কারো কি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছাড়া আর কোন লক্ষ্য রয়েছে তাতে? যদি আছে বলেন, তাহলে আমি বিস্মিত হবো বইকি। তবে সে উপার্জিত অর্থে দেবী প্রীতিলতা অথবা মহাত্মা মাষ্টারদা গবেষণা বা জাদুঘর নির্মিত হয়েছে কিংবা হবে? নাকি, প্রীতিলতার বেদীমূলে সোনার মাল্য খচিত হবে যা প্রায় শত বছরেও আজ অব্দি হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিম বঙ্গ প্রশাসন অথবা ভারত সরকার কিইবা অবদান রেখেছেন সেই রক্তীম সোনালী স্মৃতি অম্লানে! এ দায় কি শুধু বাংলাদেশের? আপনারা বাকহীন হয়ে পড়বেন এই শুনে যে, চট্টগ্রামে বর্তমান ভারতীয় হাইকমশিন থেকে শ্রীমতি প্রীতিলতার আবক্ষ মুর্তির দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটারের মধ্যে। কখনতো দেখেনি, শুনিনি যে, তারা প্রাতিষ্ঠানিক কোন উদ্যোগ, অনুষ্ঠান বা কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন। যে জাতি তার পূর্বপুরুষকে সম্মান দিতে জানে না, সে জাতি কখনও পৃথিবীর বুকে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারবে না। পারলেও তা দীর্ঘস্থায়ী বা সম্মনজনক হয় না।
পরিশেষে, ইংরেজ কবি Robert Browning এর The Patriot নামক কবিতা থেকে উদৃতি দিয়ে শেষ করবঃ
‘‘মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দৃশ্যপট সর্ম্পূণ বদলে যায়। সহর্সে, পরম উচ্ছ্বাসে একদিন যে দেশ প্রেমিককে জনগণ পুষ্পার্থে বরণ করে নিয়েছিল, মাত্র এক বছর পর সেই দেশ প্রেমিককেই জনগণ প্রস্তরাঘাতে রক্তাক্ত করে। জনগণ তাঁকে ভুল বুঝল। তার উপর সব ভালোবাসা, সম্মান ফিরিয়ে নিল, পুষ্পস্তবকের পরিবর্তে প্রস্তরাঘাত করল, ব্যঙ্গবদ্রিুপে জর্জরিত করল। ফাঁসির মঞ্চে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তার ভাগ্য বিড়ম্বনায় দেশ প্রেমিক মোটেও হতাশ নন, বরং তিনি ঈশ্বর বিশ্বাসে অটল থেকে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেন যে, জনগনের বিচার যাই হোক মরণোত্তর জীবনে ঈশ্বর তার প্রতি অবশ্যই ন্যায় বিচার করবেন, তার প্রাপ্য তাকে দেবেন।”
বোধ আছে বলেই এর উদয় হয়। আর বোধোদয় হয় বলেই আমরা অপরাধ বুঝতে পারি, বুঝতে পেরে তা মোছনের চেষ্টা করি। বোধ, মানে মূল্যবোধ আমাদের ভাবিত করুক আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্য প্রেরণার সন্ধানে, ইতিহাস চেতনার উদ্ভাবনে। তবেই সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজীবাদ ও পরাধীনতার ছোবল থেকে উদ্ভাষিত হবে মুক্তির সূর্যালোক, আন্দোলোক ও মঙ্গলালোক।
মোহাম্মদ রাহীম উদ্দিন
লেখক ও কলামিস্ট
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০২১ সকাল ১১:২৮