এক অস্থির শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায় মূলত আর্থিক দিক থেকেই বাংলাদেশে বহুবিধ শিক্ষা ব্যবস্থা। একজন শিক্ষার্থীকে তার অভিভাবক পাঠদানের জন্য কোন ধারায় নিয়ে যাবেন তা সবসময় ওই অভিভাবকের আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। অপেক্ষাকৃত বেশি বেতনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো মানের শিক্ষা কিনতে পাওয়া যায়। পিতা যদি সামর্থ্যবান না হোন, সেক্ষেত্রে সন্তানের জন্য কম বেতনের প্রতিষ্ঠান থেকে সস্তায় নিম্নমানের শিক্ষা ক্রয় করেন।
স্বাধীনতাপূর্ব তৎকালীন পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী মোনায়েম খান একবার তার কোন এক বক্তব্যে বলেছিলেন-‘‘Education is not for all”। কি উদ্দেশ্যে তিনি আমার জন্মোত্তর উক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন তা আমার জানা নেই। তবে তার কথাটার সত্যতা এখন আমি ঠিক বুঝতে পারি। আসলেই আমাদের মধ্যবিত্তের সন্তানদের জন্য শিক্ষা নয়। শিক্ষা এখন উচ্চবিত্তের কেনা দামি পোশাকের মতো। উচ্চবিত্তরা তাদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে কিংবা ইংরেজি মাধ্যমের বেসরকারি দামি প্রতিষ্ঠানে পড়িয়ে তাদের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ কিনে নিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের সন্তানদের কী হবে, তাদের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা কে দিবে! বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব ও শিক্ষাকার্যক্রম নিয়ে সংশয় এখন সবার মনে। তাদের নীতি-নৈতিকা, ধ্যান-ধারণা আর আর্দশ কেন জানি আর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আবেগ বা প্রভাব সৃষ্টি করে না। শিক্ষকদের পড়ানোর মান হয়ে গেছে বাণিজ্যিক ধরনের, এ যেন টাকার বিনিময়ে পাঠদান। তারা এখন প্রাইভেট বা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানে অধিক মনোযোগী। ভবিষ্যতের জাতি গঠনের এমন সুমহান শিক্ষকতা পেশা রূপ নিয়েছে বাণিজ্যিকীকরণে এবং পাসের অপসংস্কৃতিতে। নৈতিকতার প্রশ্নে শিক্ষার মান এখন শুধু চটকদার বিজ্ঞাপনে সীমাবদ্ধ।
সম্প্রতি গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ কলেজের স্টাডি সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনার সাময়িক অনুমতি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই অনুমোদনের পর মঙ্গলবার (১১ মে ) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির পক্ষ থেকে বিরূপ মন্তব্যে বলা হয়, লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনার অনুমোদন দেওয়ায় দেশের ক্রমবিকাশমান উচ্চশিক্ষা খাতে ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনার অনুমোদন প্রসঙ্গে একক নীতি এবং ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধি প্রণয়নের অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি (এপিইউবি) ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি বরাবর চিঠি দেয়।
বৈষম্যমূলক বিধির আওতায় সহজ শর্তে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাভজনক শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনার অনুমোদন কার্যকর হলে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। সম্ভাবনাময় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীর বিপরীতে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিশাল অঙ্কের ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এছাড়া উচ্চশিক্ষা খাতে বৈদেশিক মুদ্রাপাচার রোধের বিপরীতে নিম্নমানের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামসর্বস্ব ক্যাম্পাস পরিচালনার মাধ্যমে সনদ বিক্রির আশঙ্কা রয়েছে বলে এপিইউবি মনে করেন।
যেভাবে শিক্ষা বাণিজ্যিকিকরণের অপসংস্কৃতি বাংলাদেশে শুরু হয়েছে তাতে করে দিনের পর দিন পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে শুরু করেছে। এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান করা সরকারের পক্ষে দায় হয়ে দাঁড়াবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’র ২৯ জানুয়ারি ডাটাবেইস মতে সারা দেশে মোট জনসংখ্যার ৫.৩% এবং বাংলাদেশের সর্বশেষ ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৭’ অনুযায়ী ২৬ লাখ ৭৭ হাজার বেকার লোক আছেন। এই বেকারদের মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার তরুণ-তরুণী উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেও চাকরি পাচ্ছেন না। বেকারদের মধ্যে ৩৯ শতাংশই এমন শিক্ষিত বেকার। চীনের প্রথম প্রিমিয়ার (রাষ্ট্রপ্রধান) চৌ য়েনলাই তার শাসনামলে (১৯৪৯ – ১৯৭৬) আনুমানিক ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৬ সালের দিকে প্রায় ১২ বছর সেদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছিলেন। কারণ, গণচীনে তখনকার সময়ে এতো বেশি সংখ্যক উচ্চশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট বেড়ে গিয়েছিল; যাদের জন্য কর্মসংস্থান করা সরকারের পক্ষে ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই সময়কালীন সরকার দেশে নানাবিধ কারিগরি শিক্ষা কোর্স চালু করে জনগণকে স্বল্পকালীন কর্মমুখী উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রত্যেকের ঘরকে এক একটা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করে দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় চীনা অর্থনীতি ও চীনা পণ্য আজ বিশ্বদরবারে কোন অবস্থানে আছে তা এখন আমাদের সবার কাছেই অনুমেয়। পৃথিবীর হেন কোন দেশ নেই, এমন কোন বাজার নেই, এহেন কোন পণ্য বাকি নেই যা চীনারা আজ উৎপাদন করছে না। তাদের মেধা আর সৃষ্টিশীলতার কারণে বিশ্বের অনেক নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য চীনাদের দিয়ে বানিয়ে নিচ্ছেন। ২০১৪ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের বেসরকারি একটি চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত ভারতীয় রাষ্ট্রপতি মহান ব্যক্তিত্ব ড. আবদুল কালাম আজাদ বলেছিলেন- ‘অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে আমরা সবাই পড়াশোনা করি চাকরি পাবার জন্য, চাকরি দেয়ার জন্য নয়’। কথাটার সত্যতাটা আজ আমরা অনুধাবন করতে পারি অক্ষরে অক্ষরে। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মচারী ও জনসাধারণের মনে চিন্তার উদ্রেক ঘটানোর জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশদ্বারে সুস্পষ্ট ভাষায় লিখা রয়েছে- ‘‘কোন জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক বোমা অথবা দূরপাল্লার মিসাইল ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নেই, শুধুমাত্র দরকার এর শিক্ষার মান নিম্নতর করা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা পরীক্ষায় প্রতারণা করা মেনে নেওয়া”। প্রায় এক দশক আগে ‘ভিশন ২০৩০’এর আওতায় কাতার সরকার অনুধাবন করলো শুধু তেল বিক্রি করে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক কাঠামোকে বহাল তবীয়তে রাখা সম্ভবপর হবে না। তাই বিকল্প পন্থা অবলম্বনে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন ওয়ার্ল্ড রের্ঙ্কিং স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকার সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন সেদেশের শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করার এবং প্রয়োজনে স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা ক্যাম্পাস কাতারে খোলার জন্য। প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করেছিল দেশটি। ‘গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস রির্পোট ২০১৭’ এর বিশ্বের সেরা ১১টি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কাতার এখন ষষ্ঠ অবস্থানে।
২০০১ সালে নোবেল বিজয়ী আমেরিকান অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিট্জ বলেছিলেন- ‘‘বর্তমান বিশ্বে কর্মের সাথে কর্মীর এবং কর্মীর সাথে কর্মের সঠিক সন্নিবেশ ঘটছে না; যদিও সর্বত্রই কর্মীর সংখ্যা যথাযথ আছে, কর্মসংস্থানের সুযোগও যথাযথ বিদ্যমান।” যা সামঞ্জস্যহীনতাজনিত বেকারত্ব। বাস্তবে কর্মী ও কর্মের সামঞ্জস্যতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলেও বেকারত্বের সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরনের বেকারত্বকে কাঠামোগত বেকারত্ব বলা হয়। একটি প্রতিষ্ঠানে যতজন কর্মী কর্মরত আছেন তার কতজন দক্ষ তা একটি বড় প্রশ্ন। কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে কর্মক্ষম কর্মী প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। বস্তুত শিক্ষা ব্যবস্থাকে হতে হবে পদ্বতিগতভাবে কর্মমুখী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাষ্টারস পাস করে চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে শেষ পর্যন্ত একটা ব্যক্তিমালিকানাধীন তামাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ নিয়েছেন সিহাব উদ্দিন। যেটা সিহাব, তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠানের কর্ম চরিত্রের সঙ্গে এক্কেবারেই যায় না। ছদ্মনামে নাম উল্লেখ না করার শর্তে এটি একটি বাস্তব ঘটনা মাত্র। এমন যদি হয় একজন ছাত্র খুব শখ করে দর্শন বিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করলেন কিন্তু শিক্ষামুখী কর্মসংস্থান হলো না, তাহলে হতাশা ছাড়া তার আর কোন সম্বল থাকবে না। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তিজীবনে, সমাজ ও রাষ্ট্রে তিনি হয়ে পড়বেন বোঝা। বাংলাদেশে কর্মের সঙ্গে কর্মীর সন্নিবেশ পাওয়াটা এজন্যই অনেকক্ষেত্রে অস্বাভাবিক। তাই শিক্ষামুখী কর্মসংস্থান এবং কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষা আমাদের দেশের সর্বত্র অপরিহার্য। একজন শিক্ষার্থী তার ৫ থেকে ৬ বছরের সর্বোচ্চ ডিগ্রি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাঠ শেষ করার পরও কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেলে তাকে ধরে নেওয়া হয় “Raw Hand” হিসেবে যা হাসির উদ্রেক করে এবং ব্যক্তির জন্য এটি হতাশা বয়ে আনে।
একটি দেশের জন্য তার প্রধান সম্পদ জনগণ। এই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, সংরক্ষণ, উৎর্কষতা সাধন এবং ব্যবহার উপযোগী করে তোলার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। অধিক মুনাফা লাভের আশায় মানহীন শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ উপহার দিতে পারে অন্তঃসারশূন্য মেধাহীন প্রজন্ম যা একটা সভ্যতাকে পিছিয়ে দিতে পারে কয়েকটা শতাব্দী পেছনে! দেশীয় জনশক্তিকে যুগোপযোগী কর্মদক্ষ করে গড়ে তোলায় ভূমিকা পালন করছে খুব কম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই। এভাবে নানাভাবে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ আমাদের দেশের মানব সম্পদের অবমূল্যায়ন করে কৃত্রিম কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা সৃষ্টি করে হঠকারী আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে যার মাশুল দিতে হবে ভবিষ্যত প্রজন্মকে।
শিক্ষা বলতে ‘মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা’ বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’এই সনাতনী প্রবাদবাণীটিকে অগ্রাহ্য করার মতো সত্যিকারের সময় এসে গেছে এই উপলদ্ধিতা নিশ্চয় এখন আমাদের সবার। প্রকৃত অর্থে আমাদের এখন সুশিক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে মেধাহীন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে অনেক বেগ পেতে হবে আমাদের!
লেখক : কলামিস্ট
(সুত্রঃ মতামত । http://www.jagonews24.com । ১৭ মে ২০২১ । সোমবার )
https://www.jagonews24.com/opinion/article/667826