(অনলাইন পত্রিকা সংস্করণ- জাগোনিউজ২৪ডটকমঃ Click This Link )
কয়েকদিন ধরে খুব কানে বাজছে শৈশবে শোনা একটা গান। গ্রামবাংলার আদলে আধুনিক মিশ্রনে নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় গান। আমার কাছে অন্তত বহুবার শ্রুত গান। তখনকার সময়কার জনপ্রিয় শিল্পী সেলিম চৌধুরীর গাওয়া “আজ পাশা খেলেবো রে শ্যাম…”। তখন পাশাকে নিছক খেলাই মনে করতাম। পরিনত বয়সে এসে জানতে পারি পাশা ও জুয়া খেলার খুব সামান্যই তফাৎ বিদ্যমান। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা ঢাকা ও চট্টগ্রামের নামকরা বেশ কয়েকটি ক্লাবে আটককৃত জুয়ার আসরের খবর শুনে সমগ্রজাতি হতবিহ্বল। স্বয়্ং ঢাকাতেই পাওয়া গেছে ৬০টির অধিক জুয়ার আসর ক্যাসিনো।
ক্লাব বা সংঘ মানেই হলো একই লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্যে কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর মিলনায়তন। উদাহরণস্বরূপ যেমন- সেবামূলক সংগঠন, যেটা সাধারণত স্বেচ্ছাসেবা অথবা দাতব্য কর্মকান্ড সন্ঞ্চালন ও পরিচালনা করে। শখ ও খেলাধুলা, সামাজিক কর্মকান্ড, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভিত্তিতে নানাধরণের ক্লাব বা সংগঠন থাকতে পারে। তবে কোন সংগঠনই মূলত জুয়া, মাদকাসক্তি বা অপরাধকর্মকান্ডের লক্ষ্যে সাধারণত প্রতিষ্ঠিত হয় না। আমাদের দেশেও গ্রামে-গন্ঞ্জে, শহরের অলিগলিতে ও পাড়ামহল্লায় একসময় অনেক সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠন ছিল। আমাদের সময় আমরা বিদ্যালয়গুলোতে স্কাউট করতাম। পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব করতাম। সেইসব ক্লাব বা সংগঠন থেকে প্রতিবেশি ও সমাজের জন্য নেওয়া হতো নানা উদ্যোগ। গরীব শিক্ষার্থীদের পড়ানো হতো বিনে পয়সায়। বিভিন্ন দূর্যোগকালীন পরিস্থিতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সহায়ক সহযোগিতা করা হতো সকলের। হতো নানা ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতা। আমাদের সময়ে সকলের সামাজিক অন্তর্ভূক্তি ছিল অনেক বেশী। বিভিন্ন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে যুবসমাজের সম্পৃক্ততা ছিল প্রয়োজন মতো। আমাদের সময়ে একই পরিবারের, একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, একই সমাজের বড়তে-ছোটতে ছিল পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বশুলভ, সম্মান ও সহমর্মিতার সম্পর্ক। শহরে মানুষ এখন অনেক ব্যস্ত। যান্ত্রিক জীবনে এই ব্যস্ততা দিন দিন বেড়েই চলছে। ছুটির দিনে কিংবা অবসর সময়ে একটু সরল বিনোদন ও খেলাধুলা করার মতো আজকাল সহজে কোন মাঠ-ঘাট ও পার্ক খুঁজে পাওয়া যায় না্। এতে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক ও ঘরমুখো হয়ে পড়ছে। ক্রমবর্ধমান সামাজিক অস্থিরতা ও সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি, সম্পদের অসমবন্টন, বিকাশমান বেকারত্ব মানুষের মননে ও জীবনে বাড়িযে দিচ্ছে ঘাতক হতাশা ও বিষন্নতা। তাই সামান্য বিনোদনের জন্য মানুষ, মূলত যুব সমাজ আশ্রয় খুঁজছে বিভিন্নধর্মী বিনোদনে। সময় কাটাছে পাঁচতারকা হোটেলের জলসায়, বিভিন্ন বার বা নতুন মোড়কের ক্লাবে যেটা প্রধানত মাদকের আসর। আর এজন্যই এ সুযোগে রাজনৈতিক ছ্ত্রছায়ায় কিছু অসাধু লোক গড়ে তুলছে ক্যাসিনোর মতো জুয়ার আসর। ডাক্তারের পরামর্শে মাসখানেক আগে একটা সাইকেল কিনে ছিলাম ছুটির দিন অথবা অন্যকোন দিন সুযোগ বুঝে সাইকেল চালাবো বলে। কিন্তু বিধিবাম, কোথায় আপনি সাইকেল চালাবেন, কোথাও যে এতটুকু খালি জায়গা নেই শহরে! রাস্তায় চালাতে গেলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। একদিকে ধুলোবালি, নিয়ন্ত্রণহীন বেপরোয়া গাড়ি এবং অন্যদিকে প্রয়োজনহীন অসহনীয় হর্ণের শব্দে আরো অসুস্থ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তথাপি সে প্রচেষ্টাও ব্যার্থ। করপোরেট পেশাদারিত্বের কারনে জিমে আসা যাওয়ার সময় আর সাধ্যইবা হয় কয়জনার। আধুনিকতা আর তথ্যপ্রযুক্তির আগ্রাসনে যুব সমাজ আজকাল টেলিভিশনের বোকা বাকসো আর মুঠোফোনের অর্ন্তজালে আটকা পড়ে আছে। এরা মানবতার কথা বলে না, দেশপ্রেমের কথা বলে না, বলে না মুল্যবোধের কথা, করে না কোন সাহিত্যালোচনা। এরা কোন সামাজিক বা স্বেচ্চাসেবী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততার কথা ভাবে না, বলেনা এবং সম্পৃক্ত নয়। পারস্পপরিক পারিবারিক সম্পর্কও কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ, ছাড়াছাড়া ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ধরনের। এরা সবাই কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পরগাছা। ফলে পাড়ামহল্লায় এখন আর আগের মতো ক্রীড়া সংঘ বা সামাজিক সংগঠন দেখা যায় না। তাই অনিয়ন্ত্রীত তরুণ ও যুব সমাজ গ্যাং তৈরি করছে, লিপ্ত হচ্ছে নানারকম অসামাজিক ও অপরাধ কর্মকান্ডে। অপরাজনৈতিক ছ্ত্রছায়ায় ক্ষমতার লড়াইয়ে খুন-খারাপির সাথে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
এক সময় দেশে ফুটবল লিগের দাপুটে দল ছিলো ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। পরে স্বাধীনতার পর আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথের মধ্যেও বহুদিন ধরে উজ্জ্বল ছিলো আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, ফকিরাপুল ইয়াংমেন্স, এবং ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো দলগুলো। ফুটবলের পাশাপাশি অনেকগুলো দলেরই ক্রিকেট ও হকি দলও ছিলো যেখানে বিশ্বের নামী দামী অনেক খেলোয়াড়ও খেলে গেছেন। তখন ক্লাবের সংগঠকরা রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় ছিলেননা বরং ক্লাবগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিলো, ফলে খেলাধুলাতেও ক্লাবগুলো বেশ ভালো করেছিলো। ফুটবলের সেই জৌলুস এখন আর নেই, এমনকি ক্রিকেট ভালো করলেও এসব দলগুলোর অনেকগুলোই আর তাতে নেই। নেই তারা হকিতেও। এমনকি যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে তৈরি হয়েছিলো ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র’ সেই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছে জুয়ার আয়োজন করা। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার রাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যৌথ অভিযানে দেখা গেছে স্পোর্টস বাদ দিয়ে ক্লাবগুলো মজে আছে জুয়ার এমন আয়োজনে যার আধুনিক নাম ক্যাসিনো। ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণের ভূমিকাতেও আর খেলোয়াড় কিংবা সংগঠকরা নেই, আছেন সরকারদলীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগ আসছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকেই।
বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিরাজমান তাতে সবাই জানে চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট শাসক দলের ছত্রচ্ছায়াতেই সব সময় পুষ্টিলাভ করে। এটা বিএনপি জমানাতেও সহজবোধ্য ছিল, এই জমানাতেও তা সহজবোধ্য। সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার কাউন্সিলরদের সাথে স্থানীয় দুর্বৃত্ত, চাঁদাবাজ ও দুষ্কৃতীদের নিবিড় যোগাযোগ প্রকট। দেরীতে হলেও দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার শুদ্ধী অভিযান শুরু হয়েছে। অনিয়মকারী যে দলেরই হোক তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে র্যাবের অভিযান শুরু হয়েছে। আটক করা হচ্ছে সরকারদলীয় সংগঠনের নেতাকর্মীদের। অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে বলেও সতর্ক করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আমরা আশাবাদী।
লেখকঃ কলামিস্ট
ই-মেইলঃ [email protected]