ইতোমধ্যে সকল মহলে শুরু হয়েছে ঈদের ছুটির পরিকল্পনা। শহরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে নাড়ীর টানে মানুষ ছুটে যাবে মাতৃভুমি, মা-বাবা, সন্তান-সন্তুতি বা আত্মীয় স্বজনদের কাছে। সড়কপথ, রেলপথ ও নদীপথে শুরু হবে যাত্রীদের হিড়িক। ফাঁকা হতে শুরু করবে যান্ত্রিক নগরীগুলো। তবে বিভিন্ন আলোচনা ও তথ্যমতে ধারণা কর হচ্ছে এবারের ঈদযাত্রা যাত্রীদের জন্য হয়ে উঠবে নিরাশার। দেশের বিভিন্ন রুটে সড়ক ও রেলপথে যাত্রীদের হতে হবে হতাশ। বর্তমানে দেশের সর্বত্র বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে সাধারণ মানুষ ও যানবাহনের। অচল হয়ে আছে বহু চলাচলের পথ, সেতু, কালবার্ট ও ব্রীজ। বরাবরের মতো এবারও আসন্ন ঈদ উপলক্ষ্যে অন্যান্য পরিবহন মাধ্যমের চেয়ে বিভিন্ন রুটে যাত্রীদের পছন্দের প্রত্যাশীত প্রধান বাহন রেল। কিন্তু এবারে রেল যাত্রীদের রেল যাত্রা অন্যান্যবারের তুলনায় হয়ে উঠবে চরম দূর্ভোগের। বিশেষত রেলের যাত্রীদের (পশ্চিমাঞ্চলের) পোহাতে হবে দূর্বিষহ কষ্ট। এবারের বন্যায় রেলওয়ের ৭টি রুট ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে রেললাইন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও রেলপথ ভেঙে স্রোতের তোড়ে ভেসে গেছে। আবার কোথাও কোথাও মাটি ও পাথরসহ রেলপথ দেবে গেছে। এ অবস্থায় বর্তমানে রেল চলাচলে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটছে। রেলের কয়েকটি স্টেশনের সঙ্গে ঢাকার এখনও সরাসরি রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন স্থানেও ট্রেন আটকা পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব লাইন মেরামতে আরও মাসখানেক সময় লাগতে পারে। এ অবস্থায় বিভাগীয়ভাবে ছোট ছোট স্পটে মেরামত কাজ শুরু করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, পুরোপুরি কাজ শেষ করতে আগামী ২৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় লাগবে। আর কোরবানির ঈদের ছুটি শুরু হতে পারে আগামী ১০ বা ১১ আগস্ট। ফলে এই রুটে ঈদযাত্রীদের ট্রেনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটবেই।এ রুটে ঈদের আগে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।এদিকে বর্তমানে বন্যার কারণে রেললাইনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিকল্প রুট ব্যবহার করে ট্রেন চলাচল করছে। এতে সবকটি স্টেশন ধরা ট্রেনগুলোর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে রেলযাত্রীদের ভোগান্তি আরও বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, গত ১০ - ১৫ জুলাই প্রায় এক সপ্তাহ চট্টগ্রামে টানা ভারি বর্ষন ছিল। এই সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া সূর্বণ এক্সপ্রেসের যাত্রীদের পোহাতে হয়েছে চরম দূর্ভোগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ভাইরাল হওয়া কিছু ভিডিও ও ছবিতে দেখা গেছে, এক ব্যক্তি তার শিশুকে কোলে নিয়ে ট্রেনের সিটে বসে আছেন। হাতে মাথার ওপর ধরে আছেন একটি ছাতা! তাদের পেছনে দেখা যাচ্ছে আরেক যাত্রীও বসে আছেন একইভাবে ছাতা মাথায়!ভিডিওতে আরো দেখা গেছে, ট্রেনের ছাদ থেকে সরাসরি মেঝেতে পানি পড়ছে বৃষ্টির মতো। সেই পানি যাতে আশপাশের সিটগুলোকে ভিজিয়ে না দেয় সেজন্য একজন যাত্রী সিটে ওপর একটি প্লাস্টিকের বালতি ধরে আছেন। আমি নিজেও গত ১৩ জুলাই সকাল ৯ টায় সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের এসি বগিতে করে অফিসের কাজে কারখানা ভিজিটে লাকসাম গিয়েছিলাম। ভারী বৃষ্টিতে যাত্রা পথে আমাকেও এসি বগিতে ভিজতে হয়েছে ছাদ থেকে পড়া বৃষ্টির পানিতে।
বলা বাহুল্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশে দুটি বিরতিহীণ রেল রয়েছে। যা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে নিয়মিত চলাচলা করে। এর একটি সূবর্ণ এক্সপ্রেস এবং অন্যটি সোনার বাংলা। বাংলাদেশের প্রথম বিরতিহীন আন্তঃনগর ট্রেন সূবর্ণ এক্সপ্রেস চলাচল শুরু করে ১৯৯৮ সালের ১৪ এপ্রিল। সূবর্ণ এক্সপ্রেস সাপ্তাহিক ছুটি সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৭ টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আবার বিকেল ৩ টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সোনার বাংলা ২৬ জুন ২০১৮ সাল থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন মঙ্গলবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৫ টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এবং সকাল ৭ টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছাড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে এই যাত্রা পথে যাত্রীরা কতোটুকু সন্তুষ্ট ও নিরাপদ। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ের এই দু’টি ট্রেনের টিকিট মূল্য তুলনামূলক অনেক বেশী। টিকিট প্রাপ্তি নিয়ে সব সময়ই যাত্রীদের হয়রানি হতে হয়। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়াতে কাউন্টারে গেলে সবসময়ই টিকিট সংকটের কথা শুনা যায়। ব্ল্যাকারদের কাছ থেকে দিগুণ দামে কিনতে হয় টিকিট। শর্ত অনুযাযী অনলাইনে ১০ শতাংশ টিকিট পাওয়ার কথা। কিন্তু খুব দ্রুতই সে টিকিট গায়েব হয়ে যায়। সংঘবদ্ধ চক্র তা লুফে নিয়ে বেশী দামে বাজারে বিক্রি করে। ৭২৫ টাকার এসি টিকিট কিনতে হয় প্রায় ১১০০ টাকায়। রেল কর্মকর্তারাও এই চক্রে জড়িত। বর্তমানে ১৯ টি বছর যাত্রী সেবা সম্পন্ন করেছে চলেছে ট্রেনটি। এখন এর বগির অবস্থা অনেক লক্কর-জক্কর ধরনের। আসনগুলো পুরোনো, ময়লা ও সরু প্রকৃতির। রয়েছে বগির ভিতরকার পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রশ্ন। ঠিক মতো এসি চলে না, চললেও তাপমাত্রা ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সিলিং ফ্যানগুলো কোন রকম চলে তো চলে না অবস্থা। কোন রকম দূর্ঘটনায় রেলের অভ্যন্তরে নেই কোন জরুরী নির্গমণ পথ। অগ্নি নির্বাপণে ফায়ার এক্সটিঙ্গুইসারের পরিমাণ অপর্যাপ্ত। আর যা আছে সেগুলোর বেশীর ভাগই মেয়াদ উত্তীর্ণ। তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ৭ই মে স্টেশনে অপেক্ষারত যাত্রীশূন্য সূবর্ণ এক্সপ্রেসের ৫ টি বগিতে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। সৌভাগ্যক্রমে এতে হতাহতের কোন ঘটনা ঘটেনি। সোনার বাংলা ট্রেনের চড়া দামের টিকিটের (এসি আসন ১০০০ টাকা, নন-এসি আসন ৬০০ টাকা) সাথে যুক্ত থাকে বাধ্যতামূলক নাস্তার দাম। যদিও এর ক্যাটারিং সুবিধা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ রেলওয়ের সাথে সরাসরি জড়িত হয়েছেন। তবুও প্রশ্ন থেকে যায় ৭৪৬ আসন বিশিষ্ট এই রেলটি দৈনিক সকাল-বিকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে দুবার চলাচলে এতো হাজার হাজার লোকের জন্য প্রস্তুতকৃত এই খাবার কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত। রেলগুলোতে যাত্রীসেবায় কারও কোন অভিযোগ বা সুপারিশ করার সুবিধার্থে যোগাযোগ করার জন্য কোন নাম্বার প্রদর্শিত নেই এবং কোন অভিযোগ বক্সও নেই।
জনসার্থে সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে রেলের বগির মেঝের উচ্চতার সাথে স্টেশন প্লাটফর্মের উচ্চতা থাকে সমতলে। কিন্তু আমাদের দেশে স্টেশনগুলোর প্লাটফর্মের সাথে যেকোন রেলের বগিতে উঠার উচ্চতা অনেক বেশি। তাই যাত্রীসাধারণের প্লাটফর্ম থেকে রেলের সিঁড়ি বেয়ে বগিতে উঠা-নামাতে অনেক বেশি বেগ পেতে হয়; বিশেষ করে শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধ যাত্রীদের। একটু অসাবধানতায় তড়িঘড়ি করে চলন্ত বা অপেক্ষারত রেলে উঠা-নামায় ঘটে যেত পারে যে কোন দূর্ঘটনা। হাত-পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হতে পারে যে কোন সময় এমনকি হতে পারে মুত্যুও। বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের পরিবহন ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বর্তমানে ৮৬ চালু আছে। মোট যাত্রীর প্রায় ৩৮.৫ শতাংশই আন্তঃনগর ট্রেনের মাধ্যমে যাত্রা করে এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের মোট আয়ের প্রায় ৭৩.৩ শতাংশই আসে আন্তঃনগর রেল সেবা থেকে।
ঈদে বাড়ি ফিরা ঘরমূখী জনসাধারণের জন্য সুখবর হচ্ছে, আসন্ন পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে ২৯ জুলাই থেকে। প্রতিদিন গড়ে ২৯৫০০ অগ্রিম টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে। ফিরতি টিকিট বিক্রি হবে ৫ আগষ্ট থেকে। এবার ৫০ শতাংশ টিকেট অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে ও বাকি ৫০ শতাংশ টিকেট কাউন্টারের মাধ্যমে বিক্রির জন্য বরাদ্ধ থাকছে। তাই আনন্দদায়ক হোক সবার যাত্রা, নিরাপদে হোক ঈদে বাড়ি ফিরা।
লেখকঃকলামিস্ট
[email protected]