ভারত এমন একটি দেশ- যেখানে কয়েক হাজার বছর ধরে এমন সব মানবগোষ্ঠী পাশাপাশি বসবাস করে আসছে, যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাস সরাসরি বিপরীতমুখী। এ-সব বিপরীতমুখিনতা হিন্দু ও মুসলিম অধ্যুষিত দেশটিতে বেশ পুরনো সমস্যা হিসাবে বিরাজমান; বিশেষ করে দুটি ধর্মের বিশ্বাসীদের মাঝখানে গরু একটি ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। এই অতিব সুন্দর প্রাণিটি সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানব জাতির অস্তিত্ব নির্মাণে বোধকরি সর্বাধিক অবদান রেখে আসছে। মায়ের পাশাপাশি মানব শিশুকে দুগ্ধদানে পরিপুষ্ট দান করছে, বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের সর্বাধিক আমিষের চাহিদা পুরণ করছে; আবার মানুষের খাদ্য-উৎপাদনে তার চেয়ে আর বেশি ভূমিকা কে রেখেছে! সুতরাং এই প্রাণিটির পদে মানুষের কৃতজ্ঞতা কম থাকার কারণ নেই। আর এই কৃতজ্ঞতাই হয়তো তাকে দেবত্বের আসনে উন্নীত করেছে; কিন্তু দেবত্বের ধারণা দেশে-দেশে কালে-কালে কখনো এক ছিল না বলেই ইতিহাস প্রমাণ দেয়। সম্প্রতি ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গুরুখাওয়া নিয়ে যে সহিংস পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে; তা নিয়ে বেশ উত্তপ্ত আলোচনা হচ্ছে, অনেক হিন্দু-পণ্ডিত প্রমাণাদি হাজির করছেন, বৈদিক ধর্মেও গরুখাওয়া নিষেধ ছিল না; এমনকি এখনো কোনো কোনো রাজ্যে হিন্দুদের বেশ কিছু বর্ণগোষ্ঠী গরুখাওয়াকে শাস্ত্র বিরোধী মনে করেন না।
এসব যদিও পুরনো কথা, তবু মানুষকে চেনা যায়, তার খাওয়া দেখে; সুতরাং মুসলমান গরু খাবে, হিন্দু খাবে না এটিই স্বাভাবিক। গরু-জবাই নিয়ে, এমনকি গরু-জবাইয়ের গুজব নিয়ে ভারতবর্ষে ইতোপূর্বে, বিশেষ করে মধ্যযুগেও সংঘাত হয়েছে; এমনকি ক্ষমতা পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে; এখনো তার ব্যতিক্রম নয়। মানুষ কৃৎকৌশলের উন্নয়নের ফলে তার ভোগ্যপণ্য ও আরাম আয়েস বাড়িয়ে ফেললেও তার ধর্মীয় বিশ্বাস ও উপাচারের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি; কারণ নশ্বর বস্তুনিচয়ের সঙ্গে মানুষ মরণোত্তর জীবনের অবিনশ্বরতার ধারণাকে ত্যাগ করতে চায় না। বর্তমান সময়ে এই সংঘাতের পেছনে যে রাজনীতি নামক ক্ষমতাবস্তুটি কাজ করছে, তার চারিত্রিক পরিবর্তন ছাড়া কি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব? এটি যে কেবল ধর্মীয় নয়, ইতোমধ্যেই তা প্রমাণিত হয়েছে। এই গো-হত্যার ঘটনা নিয়ে বিজেপি ও শিবসেনার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে শুরু করেছে; মদিজিকে যেহেতু ক্ষমতায় থাকতে হবে সেহেতু গরুহত্যার বিষয়টি তাকে মেনে নিতে হচ্ছে; কারণ সেকুলারিটির যে স্লোগান, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার- ভারতের মতো একটি দেশের কর্ণধার হয়ে এই সত্য বিচ্যুৎ হওয়ার সুযোগ নেই।
তবে আমার আলোচনা অন্যখানে, আমি শুধু বলতে চাচ্ছিলাম, সাধারণ হিন্দুদের গো-দেবতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির একটি মাত্রা সংযোজনের ইতিবাচক অভিপ্রায় থেকে; অর্থাৎ গরু যে মানব জাতির অস্তিত্ব ও উন্নয়নে নানাভাবে অবদান রেখে চলেছে, তা-তো তার জীবনদায়ি ক্ষমতার জন্য, যে প্রাণির দুগ্ধ ও মাংস মানুষের শরীরের মধ্যে বিলীন হয়ে মানুষকে শক্তি দান করে চলেছে, সেটা তো দেবতার গ্রাস না হয়ে দান হিসাবেই বিবেচিত হওয়ার কথা।
প্রাচীনকালে মহিষদেবতার পুজার প্রবর্তন হয়েছিল, সেখানেও এমনই একটা চেতনা কাজ করেছিল বলে ধারণা করা হয়। কারণ, শিকার যুগে মহিষ মানুষকে মাংস দান না করলে মানুষ কিভাবে প্রাণ ধারণ করতো! তাই তাদের ধারণা ছিল, দেবতা মহিষের রূপ ধরে তাদের মধ্যে বিলীন হচ্ছেন। এই ধারণাটি কেবল প্রাচিন যুগে নয়, ম্যাস উৎসবে মদ ও পাও রুটি গ্রহণকে যিশুর রক্ত ও মাংস গ্রহণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, অর্থাৎ ত্রাতার শরীর গ্রহিতার শরীরে মিশে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। বিশ্বাসী হিন্দুরা যদি গরুর এই সেক্রিফাইজের বিষয়টি তার মহত্ব হিসাবে গ্রহণ করেন, তাহলে গরুর দেবত্ব খর্ব না হয়ে বরং বৃদ্ধি পেতে পারে। আর পাশাপাশি বসবাসকারি এই দুটি সম্প্রদায় তো পরষ্পরের জীবনাচরণ, সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতেই পারেন; এই অভিজ্ঞতা তো তাদের রয়েছে। গরু দেবতা মানুষের জন্য যতই জীবন দান করুন না কেন, মানুষের প্রয়োজনে ও যত্নে ক্রমান্বয়ে তার বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে অবিনশ্বর হয়ে উঠবে; কিন্তু যদি তার আমিষদানের ক্ষমতাটি কেড়ে নেয়া হয়, তাহলে খুব শিগগির এই দেবতার বিলুপ্তি ঘটবে; কারণ কলের-লাঙ্গল ইতোমধ্যেই তার ফসল উৎপাদনের ক্ষমতাটি কেড়ে নিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:১২