শুক্রবার রাতে টিভির রিমোট টিপতে টিপতে জি আফলাম আরবী চ্যানেলের ঊপড় থামলাম।সেখানে তখন একটি হিন্দি ফিল্ম মাত্র শুরু হয়েছে।কয়েকটা কিশোর একটা পাহাড়ী মাঠে ফুটবল খেলছে। সেখানে আর্মির কনভয় এসে থামলো এবং ছেলেদেরকে ভবিষ্যতে এখানে আর না খেলার নির্দেশ দিল।
দেখছি ছেলেরা প্রতিবাদ করছে, এতোবছরের খেলার মাঠ আর্মীদের জন্য কেন ছেড়ে দেবে।কিন্তু আর্মীরা তাদের বাধ্য করলো মাঠটা ছাড়তে।এদের মধ্যে একজন মাস্টারজীর নিকট গিয়ে নালিশ জানানোর কথা বললো।আমার কান এবং চোখ তখন সতর্ক হয়ে গেল,তবে কি মাস্টারদা সূর্যসেনের কাহিনী? কিন্তু নাম এমন কেন? খেলে হাম জি জান সে!
মাষ্টারদা সূর্য সেনের সংগ্রামী জীবন নিয়ে আমাদের দেশে সিনেমাতো দুরের কথা কোন প্রামাণ্যচিত্র হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।ছোটকালে বই পড়ে জেনেছিলাম ব্রিটিশ বিরোধী অন্দোলনে একজন শিক্ষক সূর্য সেন (যাকে সবাই মাস্টারদা বলতেন) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে শহীদ হয়েছিলেন।কিন্তু আমাদের পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের (মুক্তিযুদ্ধ্ব) সঠিক ইতিহাস নিয়েই যখন আমরা ঘুরপাক খাই তখন ব্রিটিশ আমলের কথা মনে করে কে !
যাই হোক প্রবাসে বসে যখন বিদেশী ভাষায় নিজের দেশের কাহিনী নিয়ে তৈরী মুভি দেখছিলাম, বিশ্বাস করুন আমি মুভিটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেশ উত্তেজিতই ছিলাম। ভেবে পাচ্ছিলামনা ৬০জনেরও বেশী বিপ্লবী যাদের বেশির ভাগের বয়স নয় থেকে আঠারো হবে, সূর্যসেন কিভাবে তাদের একত্রিত করেছিলেন। আর কি অসম্ভব মোটিভেশন থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পরাক্রম শালী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আক্রমণ বা বিদ্রোহের সাহস রাখা যায়!
মহান বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন তার সঙ্গী অম্বিকা চক্রবর্তী ,বিনোদ বিহারী,নির্মলসেন,গনেশ ঘোষ,লোকনাথ, অনন্তকে নিয়ে ১৯৩০ সালে ব্রিটিসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার এক মাস্টার প্লান করেন।এর সঙ্গে আরো যোগ হয় কল্পনা দত্ত আর প্রীতিলতা যোয়াদ্দার এবং অর্ধশত টিনেজার মুক্তিকামী বিপ্লবী সেনা।
এই মিশনে মাস্টারদা চাননি মেয়েরা অংশ নিক কিন্তু কল্পনা দত্ত আর প্রীতিলতার চাপে তিনি রাজি হন।প্রথমেই প্রীতিলতা আর কল্পনা দত্তকে পাঠানো হয় অস্ত্রাগারের ভেতর কোথায় কি আছে দেখে(রেকি) আসার জন্য।ওরা ক্লিনার সেজে ভেতরে গিয়ে সমস্ত কিছুর নকসা একে নিয়ে আসেন।তারপর মাস্টারদার প্লান অনুযায়ী সবাইকে চট্টগ্রামের পাহাড়ে নিয়ে ট্রেনিং দেয়া হয়।অর্থাৎ বোমা তৈরী,অস্ত্র চালনা ও শারীরিক কসরত শেখানো হয়।
১৮ এপ্রিল ১৯৩০, শুক্রবার রাত ৮টা বিদ্রোহের দিন হিসাবে ঠিক হয়। একই দিনে পাচটি স্থান আক্রমন এবং কে কোন স্থানে যাবে তা নির্ধারিত হয়।
১।নাঙ্গলকোট রেল লাইন বিচ্ছিন্ন করনঃ লোকনাথ,লালমোহন,তারেকেশ্বর প্রমুখ আর কল্পনা দত্ত তাদেরকে সাহায্য করবে।কিন্তু পরবর্তিতে বোমা বানাতে গিয়ে আহত কল্পনাকে মাস্টারদা কলকাতা চলে যেতে বলে।তাই কল্পনা ও প্রীতিলতা দুজনেই এই মিশনে অংশ না করে কলকাতা চলে যায়।
২।টেলিগ্রাম অফিস আক্রমনঃ অম্বিকা চক্রবর্তী , বিরেন , দেবা, আনন্দ প্রমুখ।
৩।দামপাড়া পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক আক্রমনঃ মাস্টারদা সূর্যসেন নিজে,গনেশ,বিনোদ বিহারী প্রমুখ, সঙ্গে প্রীতিলতা থাকার কথা ছিল।
৪।পাহাড়তলী ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্ট অস্ত্রাগার লুন্ঠনঃ নির্মল সেন, লোকনাথ, প্রীতিলতা প্রমুখ।
৫। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমনঃ অনন্ত,রজত,নরেশ প্রমুখ কিন্তু গুড ফ্রাইডে থাকায় সেদিন ঐ ক্লাবে কেউ ছিল না। মাস্টার’দা সূর্য সেন পরে স্থির করেন ২৩ সেপ্টেম্বর (১৯৩২ সাল) ইউরোপীয় ক্লাবে প্রীতিলতার নেতৃত্বে হামলা করা হবে।প্রীতিলতা ঐ ক্লাব আক্রমণ করেন। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল। গুলিতে আহত প্রীতিলতা দৈহিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার চাইতে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নেন। তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। যদিও ছবিতে দেখানো হয় সে নির্মল সেনের প্রেমে আত্মহুতি দেন!
১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারী মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের একই মঞ্চে ফাঁসী কার্যকর হয়।
আমার নিকট সম্পুর্ন ছবিটা হলিঊডের একশন ছবির মতোই গতিময় লেগেছে। অর্থাৎ প্রতিটা দৃশ্য আমি রুদ্ধ্বশ্বাসে দেখেছি একটুও বিরক্ত ফিল করিনি।জুনিয়র বচ্চনের অভিনয় এককথায় ভাল। যদিও এখানে প্রীতিলতা থেকে কল্পনা দত্তকে বেশী হাইলাইট করেছে।আর হিন্দি ছবি বলেই হয়তো কাহিনীতে কিছুটা প্রেম ঢুকে পরেছে।এছাড়া কলকাতার রিক্সাকে চট্টগ্রামের রিক্সা বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। শুনেছি গোয়াতে চিত্রায়িত হয়েছে ছবিটা,তাই চট্টগ্রামের সঙ্গে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও বুঝা যায়নি। শেষে আবারো বলছি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক এই ছবিটা সবাইকে দেখা উচিৎ।
ছবিটা টরেন্ট থেকে ডাউনলোড করলে এখানে ক্লিক করুন Click This Link
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি !! সূর্য সেনের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানোও হয়নি। ফাঁসীর পর লাশ ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown” এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।
কিছু ভাল লাগা স্ক্রিন সট দেখুনঃ
আর্মীর তারা খেয়ে কিশোরেরা মাস্টারদাকে খুজছে
অম্বিকা চক্রবর্তী,নির্মলসেনের সঙ্গে মাস্টারদা সূর্য সেন
বিনোদ বিহারীর সঙ্গে মাস্টারদা সূর্য সেন
প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তদের অস্ত্র শিক্ষা দেয়া হচ্ছে
পাহাড়ে কিশোরদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে
কিশোর বিপ্লবীরা
পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমন
অস্ত্রাগার লুণ্ঠনকারী কিশোরদের দেখে পালিয়ে থাকা ব্রিটিশ সেনা অবাক হলেন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে প্রথম ভারতীয় পতাকা উত্তোলন।
বিপ্লবীদের সাফল্যের খবর দেখছেন চট্টগ্রাম শহরবাসী
প্রীতিলতারা কলকাতায় খবরটা পড়ছেন
ব্রিটিশসেনারা পালিয়ে যাওয়া বিপ্লবীদের খুজে ম্যাপ দেখছেন
জালালাবাদ পাহাড়ে আম্বিকারায় আহত
জালালাবাদ যুদ্ধে শহীদ কিশোর বিপ্লবীরা
রেলস্টেসনে আটক বিপ্লবীরা
কলকাতা থেকে খবর পড়েই ছদ্মবেশে ছুটে আসে প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত
ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমনের পর প্রীতিলতা
কোর্টে বিচার হচ্ছে মাস্টারদার
ফাসিতে ঝুলানো হচ্ছে মাস্টারদাকে
একমাত্র জীবিত আছেন বিনোধ বিহারী