বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত কাজে বা চাকরীসুত্রে আমাকে প্রচুর ভ্রমণ করতে হয়েছে। আমি এই কাজটি আনন্দ নিয়ে করতাম, ভ্রমণ করতে আমার খুব একটা খারাপ লাগে না। এই চলার পথে আমার অনেক মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে, অনেক অঞ্চলের মানুষের সাথে মিশেছি, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, রীতি রেওয়াজ, আতিথিয়েতা দেখেছি। অধিকাংশই আমার কাছে খুব উপভোগ্য ছিলো। এর মধ্যে সবচেয়ে দাগ কেটেছে মানুষের আতিথিয়েতা। আমাদের বাঙালিদের আতিথেয়তার গল্প নতুন করে বলার কিছু নেই, বিরুপ পরিস্থিতিতেও আমি এমন সব আতিথিয়েতার মুখোমুখি হয়েছিলাম, যা বুঝি শুধুমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব।
বছর কয়েক আগের এক শৈত্যপ্রবাহের রাতে আমি কয়েকজন পাগলের খপ্পরে পড়েছিলাম। তারা বলল, এখন যৌবন যার উত্তরবঙ্গে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। ফলে যৌবনগ্রস্থের প্রমাণ স্বরুপ আমার নিজেকে সে যাত্রায় সপে দিতে হয়েছিল। সন্ধ্যা ৭টার দিকে রওনা হয়ে যখন যমুনা সেতু পার হচ্ছি, তখন ঘড়িতে রাত প্রায় ১১টা। সিরাজগঞ্জ বাইপাস ফেলে সামনে এগিয়ে যেতেই পড়লাম কুয়াশার খপ্পরে। কুয়াশার রসবোধে বেশ মুগ্ধ হলাম। যেখানেই পথ কিছুটা বাঁক খেয়েছে সেখানেই কুয়াশা ঘন হয়ে যাচ্ছে আর যেখানে কিছুটা মোটামুটি সোজা যেখানে হালকা পেঁজা মেঘের মত। আমরা চেষ্টা করছিলাম কোন যাত্রীবাহী বাস খুঁজে পেতে কিন্তু কপাল খারাপ সামনে কোন বাসও পেলাম না। অগত্যা গতি কমিয়ে পিছন থেকে আসা কোন যাত্রীবাহী বাসের জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম।
নির্জন রাত, মাঝে মাঝে বিপরীত দিক থেকে আসা দুই একটি বাস ট্রাকের তীব্র হর্ণ দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া, মুখোমুখি সংঘর্ষের ভয়ে কিছুটা ধীর গতি সব মিলিয়ে অদ্ভুত রোমাঞ্চকর এক পরিবেশ। আপনি যদি সিগারেট খোর হয়ে থাকেন, তাহলে এমন পরিবেশে সিগারেট না খাওয়াটা আপনার জন্য রীতিমত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। আমরা কোন অপরাধ করতে চাই নি। তাই গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে সিগারেট ধরাতে গেলাম। কিন্তু জানালার কাঁচ নামাতেই ঠান্ডা বাতাস এমন নিষ্ঠুরভাবে মুখে আঘাত করল যে, মনে হলো মোহাম্মদ আলির হাতে একটা ঘুষি খেলাম। অগত্যা, চলন্ত অবস্থায় গাড়িতে সিগারেট খাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিলাম। বেশ কিছুদুর যাবার পর রাস্তার সাইডে একটা ছোট দোকান চোখে পড়ল। যদিও দোকান বন্ধ কিন্তু সামনে কম পাওয়ারের বাতি টিমটিম করে জ্বলছিলো। আমরা দোকানের সামনের ফাঁকা জায়গায় গাড়ি পার্ক করলাম। গাড়ি থেকে বের হতেই শীতের প্রকোপ টের পেলাম। আমাদের মধ্যে একজন হালকা হতে একটু সাইডে গেলো। আমি সিগারেট ধরিয়ে যখনমাত্র প্রাণভরে টান দিতে যাবো তখনই দোকানের ভেতর থেকে পরিচিত আঞ্চলিক টানের ঘুম জড়ানো একটা বিরক্ত কন্ঠস্বর কানে ভেসে এলো।
কেগারে? এত রাইতে ইয়ান্দি কেগা হাডের?
আমি হাসতে হাসতে আমার বন্ধুদের বললাম, বুঝলেন, পৃথিবীর যেখানে অক্সিজেনও নাই, সেখানে একজন হলেও নোয়াখাইল্লা আছে। হাসতে হাসতে আমি বললাম, কাগু অ্যাঁইও না।
তিনি বললেন, আন্নে কেগা?
আমি বললাম, অ্যাঁই আন্নের দেশী, খোয়া হড়ি এক্কেরে ছাই গ্যাছে। এক্কেরে কিচ্ছু দেন যায়ের না। এরলাই এক্কানা খাড়াইছি ইয়ানদি।
তারপর বেশ কিছুক্ষন সাড়াশব্দ নেই। আমাদের গন্তব্য ছিলো নওগাঁ। সত্যি বলতে কুয়াশার মধ্যে গাড়ি চালানো বেশ পরিশ্রমের ব্যাপার। আমাদের সবারই কম বেশি ক্ষুধা পেয়েছিলো। তাই আমরা দোকানের সামনেই সিগারেট খেতে খেতে গরমভাত আর মুরগীর ঝাল ঝাল মাংস পেলে কে কয় প্লেট খেতে পারত তা নিয়ে বাহাস চলছে। হঠাৎ দোকানের পাশে ছোট একটা দরজা দিয়ে ছোটখাটো একটা মানুষ মাফলার দিয়ে কান পেচিয়ে, হাতে টর্চলাইট বের হয়ে আসলেন। বললেন, ইয়ানে তো কোন হোডেল মোডেল নাই। এত রাইতের বেলা আন্নেরা কিচ্ছু হাইতেনওন।
আমার বন্ধু সাব্বির হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, কথা শুইনা তো বুঝন যায় আপনে নোয়াখাইল্লা কিন্তু এই অঞ্চলে আপনে কেমনে আইলেন?
হাতের চাদরটা ভালো করে শরীরে জড়িয়ে নিতে নিতে আমাদেরকে কিছুটা ভালো করে দেখলেন। তারপর কিছুটা শুদ্ধভাষায় বললেন, আমি ব্যবসা করি। ব্যবসার সন্ধানে ইদিক আসি আটকি গেছি। ইয়ানে বিয়া করি হালাইছি।
আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিসের ব্যবসা করেন?
লোকটা হাতে হাত ঘষতে ঘষতে বলল, ডিমের ব্যবসার করি। ইয়ানতুন ডিম লই আড়তে পাডাইডি।
যাইহোক, এই লোকের সাথে আমাদের গল্প বেশ জমে উঠল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, কুয়াশায় আমাদের সবারই মাথা আর পোষাক প্রায় ভিজে গেছে। তিনি হঠাৎ কাচুমাচু করে বললেন, আন্নেরা মনে হয় হোডেল টোগানের। এইক্কা টাইমে তো আন্নেরা কোন হোডেল হাইতেন ন। অ্যাঁর বাড়িত চলেন, হিয়ানে যাই ছা খাই লন। খোয়া কমি লোক, হেরপারদি যাইয়েনগৈ। আন্নে অ্যাঁর দেশি মানুষ।
'আন্নে অ্যাঁর দেশি মানুষ' শুনে আমার বন্ধুরা সবাই আমার পিঠ চাপড়ে একেবারে হই হই করে উঠল। গাড়িটাকে রাস্তা থেকে আরো কিছুটা ভিতরে সাইড করে আমরা তাঁর সাথে রওনা দিলাম। অন্ধকার এবং কুশায়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। পরিবেশটা যে খুবই রোমাঞ্চকর তা আমরা বন্ধুরা এক বাক্যে স্বীকার করে নিলো। রাস্তা থেকে অল্প কিছু দূরেই আমার দেশী ভাইয়ের বাড়ি। যখন উনার বাড়িতে পৌছলাম, রাতের তখন প্রায় একটা বাজে। সত্যি বলতে ঠিক ঐ মুহুর্তেই আমাদের সবার মধ্যেই একটা অপরাধবোধ বা নূন্যতম সৌজন্যবোধ সৃষ্টি হলো। রোমাঞ্চের গন্ধে আমরা স্বাভাবিক আচরন ভুলে গেছি। এতরাতে কারো বাসায় যাওয়া কতটা যে অনুচিত তা শহরের বাসিন্দাদের প্রেক্ষাপট থেকে চিন্তা করে লজ্জিত হলাম। আরো লজ্জিত হলাম উনার নামটাই এতক্ষন জিজ্ঞেস করা হয় নি। আমরা যতবারই উনাকে বলি যে থাক, এত রাতে আর বাড়ির মানুষকে কষ্ট দেয়ার প্রয়োজন নাই, আমরা রওনা দিতে চাই। কিন্তু তাঁর আন্তরিক অনুরোধ এবং মাঝরাত্রিতে চা খাবার লোভ আমাদের থামিয়ে দিলো।
এই পর্যায়ে এসে উনার নাম জিজ্ঞেস করলাম। উনার নাম নুরুল হক, ডাক নাম নুরু। তিনি আমাদেরকে তাঁর বাড়ির সামনের একটা ছোট ছাউনির মত ঘরে বসতে বললেন। বাড়ির ভেতরে কোথাও নারী কন্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা প্রায় অন্ধকারে বসে আছি। বাড়ির বাইরের জ্বালানো বাতির আলো ঘরে এসে পড়ছে। বেশ কিছুক্ষন পরে নুরু ভাই একটা ব্যাটারী লাইট আমাদের রুমে দিয়ে বসতে বলে তাড়াহুড়া করে আবার চলে গেলেন। আমরা লাইট নিভিয়ে দিলাম। কুয়াশা মাখা অন্ধকার পরিবেশটাই ভালো লাগছে। কোথায় যেন পাতা পুড়ছে, কুয়াশার সাথে সাথে পাতার পোড়ার গন্ধ এক অদ্ভুত ভালোলাগা তৈরী করল।
প্রায় ঘন্টাখানেক পার করে ফেললাম। আমরা একটা মোহচ্ছন্ন পরিবেশে আছি। ভালো লাগছে। নওগাঁতে যার বাসায় যাবো, সে আমাদের বর্তমান অবস্থার কথা শুনে সে মহা বিরক্ত হয়ে বলল, শালার পোলারা!! বুইড়া হইছস! আর কত পাকনামি করবি? কার না কার বাড়িতে গেসছ ব্যাটা!!! পরে পাবলিক ডাকাত মাকাত কইয়া মাইর দিলে বাঁচানোর কেউ থাকবো না। এক্ষুনি রওনা দে।
সত্যি বলতে সাময়িক উত্তেজনায় আমরা এই ব্যাপারটা মাথায়ই আনি নাই। কিন্তু এই সম্ভবনার কথা মাথায় আসার পর সবাই কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লো। সাব্বির বললো, বাদ দে! চা খাওন লাগবো না। এক চা বানাইতে যদি এক ঘন্টা সময় লাগে, তাইলে ঘটনা খারাপ।
হঠাৎ আমাদের ৪ জনের মধ্যে একটা দ্বিধা দেখা দিলো। আমার কিছুটা মেজাজ খারাপ হলো। এতক্ষন অপেক্ষা না করে যদি সামনে এগিয়ে যেতাম তাহলে ভাত না হোক এককাপ চা অন্তত খেতে পারতাম। এই সব ভাবতে ভাবতে আমরা যখন চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম, তখনই দেখলাম নুরু ভাই হাতে কি নিয়ে যেন উঠানের ঐ মাথা থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছেন। কাছে এসে তিনি বললেন,
ভাইছা! এক্কানা দেরী হই গেছে। হোলার আম্মা মোরগ ছিলতে দেরীগরি হালাইছে।
আমরা ৪জনই প্রবল বিস্ময়ে প্রায় এক সাথে জিজ্ঞেস করলাম, মোরগ মানে?
-আন্নেরা অ্যাঁর দোয়ানের সামনে খাঁড়াই হোডেলের টোগাইতেছিলেন না? ইয়ানে তো কোন হোডেল মোডেল নাই। আন্নেরা অ্যাঁর দেশী মানুষ। হেইল্লাই অ্যাঁই দুগা ডাইল ভাত রাইঞ্ছি আন্নেগো লাই।
অপ্রত্যাশিত এই আতিথিয়েতায় আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। যেখানে আমরা খারাপ কিছু চিন্তা করছিলাম, সেখানে এমন আন্তরিকতা আমাদেরকে ভীষন লজ্জা দিলো। যে নারী কন্ঠ আমরা শুনেছিলাম, সেটা আর কেউ নয় তার স্ত্রী, পাতা পোড়াবার গন্ধ যা পেয়েছিলাম সেটা তাদের রান্না ঘর থেকে আসাই গন্ধ ছিলো। উঠানে পায়ের শব্দ পেয়ে দেখি নুরু ভাইয়ের ছোট ছেলেটা নাক টানতে টানতে একটা পরিষ্কার গামছা সাবান নিয়ে আসছে। নুরু ভাই হাতের জগ থেকে গরম পানি দিলেন হাত ধোয়ার জন্য। আমি জগ থেকে পানি নিয়ে হাত ধুচ্ছি আর পাশে নুরু ভাইয়ের ছোট ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। তার কৌতুহলি চাহুনীতে পারিবারিক আন্তরিকতার ছাপ। আমার চোখে পানি চলে আসলো। আমি ভীষন দুর্বল একজন মানুষ। আমার প্রতি অন্য মানুষের সামান্যতম ভালোবাসা, আন্তরিকতা আমাকে প্রচন্ড স্পর্শ করে। আমি আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ি। এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না। মুখে পানি দেয়ার ছলে চোখের পানি মুছলাম।
ঘরে ফিরে দেখি মেঝেতে খাবার সাজানো। আইটেম দেখে চক্ষু চড়ক গাছ। গরম ধোঁয়া উঠা ভাত। আলু দিয়ে দেশী মুরগীর ঝোল, ডিম সিদ্ধ সাথে কাঁচা মরিচ আর লবন। বাচ্চাটাকে সাথে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম, প্রথমে না করলেও পরে বাবার চোখের অনুমুতি পেয়ে বসল। শীতের রাতে গরম ধোঁয়া উঠা ভাত, ঝাল ঝাল করে মুরগীর মাংশের ঝোল দিয়ে যে কি পরিমান ভাত খেয়েছিলাম আমার সত্যি তা জানা নেই। গলা পর্যন্ত খাওয়ার পর দেখলাম সকলেই কম বেশি ঘামছি।
খাওয়া শেষ হবার পর ভাবী বারান্দার আড়াল থেকে বললেন, হামাকের গরীবের বাড়িত আসিছেন। সোবগুলি কি খায়াছেন কবার পারি না।
ভাবীকে কৃতজ্ঞতা জানালাম, আমাদের অন্তরের গভীর থেকে ধন্যবাদ জানালাম এই অভাবনীয় আতিথিয়েতার জন্য। তাদের সুখী আর তৃপ্তি চেহারা দেখে এই দম্পত্তিকে আমার বড় হিংসা হলো। আসার সময় নুরু ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম। তাঁকে বাচ্চাটাকে খেলনা কিনে দেয়ার জন্য কিছু টাকা দিলাম। তিনি কোনভাবেই নিতে চাইলেন না। অনেক অনুরোধ করে শেষমেষ রাজি করালাম।
যখন গাড়ি স্টার্ট দিলাম তখন ঘড়িতে প্রায় পৌনে তিনটা। পথের এই অংশটায় কুয়াশা এখন প্রায় কেটে গেছে। আমি জোরে গাড়ি টান দিলাম। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা বাতাসের শো শো শব্দ গাড়ির ভেতরের জমাট বাঁধা নিরবতাকে আরো তীক্ষ্ণ করছে। আমার হঠাৎ শহরের কথা মনে পড়ল। এই শহর রাত দুপুরে কোন অপরিচিত ব্যক্তিকে বাসায় আনার অনুমুতি দেয় না। বাসায় যদি আসেও সেখানে আন্তরিক আতিথিয়েতা পাবার নিশ্চয়তা প্রদান করে না। এখানে সবাই যান্ত্রিক, অনুভুতি শূন্য। এই শহরে নিশ্চয় অনেক আন্তরিক মানুষ আছে, কোমল হৃদয়ের মানুষ আছে যারা হয়ত শহরের ইট, কাঠ আর কংকৃটের মাঝে চাপা পড়ে আছেন। আমি জানি, একদিন তারা জেগে উঠবেন আর এই শহরে শুরু হবে মানুষের বসবাস। ততদিন পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তাটি দীর্ঘ, পেঁচানো অন্ধকার আর কুয়াশাচ্ছন্ন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:০০