টিভিতে রান্না অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে বুঝলাম, যিনি হোটেলে রান্না করেন - তাকে বলা হয় বাবুর্চি আর যিনি টিভিতে রান্না করেন- তাকে বলা হয় রন্ধনশিল্পী। আর যিনি রান্নার বিচার করেন তাকে বলা হয় শেফ। আমাদের দেশে একই পেশার যে শুধু তিন তিনটি নাম আছে তাই নয়, নাম ভেদে তিন রকম পোষাকও আছে। যেমন, বাবুর্চিরা পড়বেন সাদা লুঙ্গি আর সাদা শার্ট। রন্ধনশিল্পীরা পড়বেন শাড়ি আর ভারী মেকাপ। আর শেফ পড়বেন স্যুট এবং মুখে জুয়েল আইচ মার্কা হাসি।
বাবুর্চিরা সাধারনত মুখরোচক খাবার রান্না করেন যেমন কাচ্চি বিরিয়ানী- আমরা সেটার খুঁত ধরার চেষ্টা করি, রন্ধনশিল্পীরা নতুন নতুন রান্না আবিষ্কার করেন, যেমন তরমুজ দিয়ে মুরগীর মাংস - আমরা সেটা খেয়ে স্বাদের চেয়ে শিল্প খুঁজি। আর শেফরা বিদেশী খাবার রান্না করেন যার স্বাদ আমরা জানি না - টিভিতে দেখেই জিভের জল ফেলি।
চলুন প্রথমে একজন বিখ্যাত বাবুর্চি দেখি
হাজী রফিক বাবুর্চি - ফখরুদ্দিন বাবুর্চির ছেলে। উনাদের পারিবারিক বিখ্যাত খাবার প্রতিষ্ঠানের নাম - ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। ১৯৯৫ সালে ফখরুদ্দিন বাবুর্চি মারা যাবার পর তাঁর দুই ছেলে এই প্রতিষ্ঠান বেশ সুনামের চালাচ্ছেন। ঢাকায় ভিকারুননিসা নূন স্কুলের পাশে তাঁদের আদি কেন্দ্রটি ছাড়াও মগবাজার, গুলশান-১, ধানমন্ডি, মতিঝিল, বনানী ও উত্তরায় এবং চট্টগ্রামে রয়েছে এর শাখা। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, দুবাইয় এবং লন্ডনেও ‘ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’-এর শাখা আছে।
এবার একজন বিখ্যাত রন্ধনশিল্পীঃ
রন্ধনশিল্পী কেকা ফেরদৌসী। বলা হয়ে থাকে, প্রতিদিনের রন্ধনকর্মকে দেশে শিল্পকর্মের সম্মান এনে দেয়ার পথিকৃৎ তিনি। এর মধ্যে ফ্রান্স থেকে পেয়েছেন ‘বেস্ট টিভি সেলিব্রেটি শেফ রেস্ট অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল গুরমেন্ড ওয়ার্ল্ড কুক বুক এ্যাওয়ার্ড -২০১০’ এবং যুক্তরাজ্য থেকে পেয়েছেন ‘বৃটিশ কারি এ্যাওয়ার্ড- ২০১১’। আমার মতে সেলিব্রেটি রন্ধনশিল্পী হবার জন্য প্রয়োজন কিছু মিডিয়া সাপোর্ট, যা উনার রয়েছে। তিনি বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের মেয়ে। উনার স্বামী মুকিত মজুমদার বাবু ইমপ্রেস গ্রুপের পরিচালক। ফলে চ্যানেল আইয়ে রান্না বিষয় অনুষ্ঠানে তিনি একজন পরিচিত মুখ।
এবং একজন বিখ্যাত শেফঃ
মিস্টার টনি খান, বিখ্যাত শেফ। দেশ বিদেশের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন। দেশে ফিরে কাজ করেছেন র্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন, ওয়েস্টিন এবং গ্র্যান্ড সুলতান টি রিজোর্টে। একজন সত্যিকারের সেলিব্রেটি শেফ। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তিনি নিয়মিত রান্নার অনুষ্ঠান করেন। সম্প্রতি তিনি একটি রান্নার স্কুলও দিয়েছেন।
যাইহোক, লেখার শুরুতে বলেছিলাম একই পেশার তিনটি ভিন্ন নামকরন সম্পর্কে। আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, একই পেশার ভিন্ন ভিন্ন নাম কেন দেয়া হয়? কারা দেয় এই নাম? যদি আমরা একটু বিশ্লেষন করতে যাই তাহলে বলতে হবে, আমাদের দেশে কাজের মুল্যায়নে জাত ও শ্রেণী চেতনা চোখে পড়ার মত। যার মূলে রয়েছে বাঙালি হিন্দু সমাজের বহুল কথিত জাতের শ্রেনী বিভাজনের প্রভাব। আমাদের দেশে হিন্দু মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় রেখে বসবাস করছে। বাঙালি মুসলমান সমাজের একটি বড় সময় নিয়ন্ত্রিত হয়েছে হিন্দু সমাজের এই শ্রেনী বিভাজনের আলোকে। হিন্দু মুসলমানের যৌথ সমাজ যখন জমিদার ও নবাবদের প্রভাবমুক্ত হলো এবং ধর্মীয় বিভাজনের প্রেক্ষাপট যতদিনে ধীরে ধীরে বিলীন হলো, ততদিনে আমাদের রক্তে ঢুকে গিয়েছে সামন্তবাদী মনোভাব, আমরা শিখে গিয়েছি সমাজের দরিদ্রতম অংশকে নিপীড়ন, অবহেলা আর অবজ্ঞাই সমাজে নিজেদেরকে প্রভাবশালী ও সম্মানিত হিসেবে মূল্যায়নের চাবিকাঠি। সেই চলমান ধারা থেকেই আমাদের দেশে কাজের উঁচু নিচু শ্রেনীবিভাগ। উদহারন স্বরুপ বলা যায়, এখনও অনেক মানুষ রাস্তায় রিকশাওয়ালা, মুচি, হোটেল বয়, বাসের হেল্পার ইত্যাদি পেশার মানুষকে তুই তুকারী করেন। বিষয়টা আমাদের সমাজে এতই স্বাভাবিক যে, অনেক তরুনও একজন বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাকে অবলীলায় তুমি বলে সম্বোধন করেন। এই দেশে ধনী পরিবারের একজন সন্তান বেকার থাকাকালীন সময়ে সমাজে যে সম্মান পায়, গরীব পরিবারের যে সন্তানটি পরিবারের স্বচ্ছলতার স্বার্থে অথবা একটু বাড়তি আয়ের জন্য যখন কোন ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টে যখন ওয়েটার হিসেবে কাজ করে তখন সেই সম্মানের সিকিভাগও তিনি পান না। আমাদের কাছে সে শুধুই একজন সামান্য ওয়েটার। অথচ শিক্ষা বলে কর্মই সকল সম্মানের মানদন্ড। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কাজের এই তথাকথিত শ্রেনী বিভাজন সমাজে শিক্ষিত অংশের সাথে অশিক্ষিত অংশের একটি মনস্তাত্তিক দ্বন্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা আরো প্রমানিত হয় যখন আমাদের দেশের মেধাবী তরুনরা বিদেশে গিয়ে 'ওড' জব করে জীবিকা নির্বাহ করেন। হয়ত ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করতে গিয়ে অনেক তরুনের এই মনস্তাত্তিক দ্বন্দ কিছুটা হলেও অবসান ঘটে।
দুঃখিত পাঠক, ধান ভাঙ্গতে বোধহয় শীবের গীত গাইলাম, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমাদের দেশের প্রচলিত ধারনা, রান্না করা একটি সাধারন কাজ, এটাতে তেমন সম্মানের কিছু নেই। কেউ পড়াশোনা করে রান্নাকে পেশা হিসেবে নিবে, আমাদের দেশে এটা এখনও প্রায় অকল্পনীয়। তাছাড়া আমরা শৈশব থেকে দেখে এসেছি পরিবারের মেয়েরা নিজেরা অথবা গৃহস্থালির কাজে সাহায্যকারী মানুষরা এই রন্ধনের কাজটি সম্পন্ন করছেন। ফলে এই পেশার নাম পাচক, রাধুনী কিংবা বাবুর্চিতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। বলাবাহুল্য, এই নামগুলোতে তেমন সম্মান ছিলোনা। তাই প্রায় এক যুগে আগেও বাংলাদেশে রন্ধনশিল্পী উপাধিটা খুব একটা পরিচিত ছিলো না। তবে দীর্ঘদিন বিদেশে রেস্টুরেন্টে কাজ করে কাজের বিভাজন সম্পর্কিত অযাচিত মনস্তাত্তিক দ্বন্দ কাটানো মানুষগুলো যখন এই দেশে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা খুলে বসল, তখনই ধীরে ধীরে রন্ধনশিল্পী, শেফ ইত্যাদি উপাধির যাত্রা শুরু হলো। সবাই যখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, এই মানুষগুলো ভালো আয় করছে, নিজেদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করছে এবং সর্বপরি সমাজ থেকে সম্মান আদায় করতে সক্ষম হচ্ছে তখনই আমাদের সামন্তবাদী সমাজ একই পেশাকে কয়েকটি শ্রেনীতে ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন নাম উপহার দিচ্ছে। তাই যিনি রান্না করছেন, তিনি কখনও বাবুর্চি, কখনও রন্ধনশিল্পী এবং কখনও শেফ।
এই মানুষগুলো কর্মজীবন আমাদেরকে এটাই শেখায় আপনি যে কাজই করেন না কেন, তা ভালোবেসে করতে হবে। পৃথিবীর কোন কাজই ছোট নয় বরং কর্মবিমুখিতাই ছোট। কিছুদিন আগে ফেসবুকের একটি গ্রুপে দেখলাম জনৈক কিশোর ৫০০০ টাকায় কোন ব্যবসা শুরু করতে চাইছেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অধিকাংশ মানুষই তাঁর এই প্রচেষ্টাকে হাস্যকর হিসেবে দেখছেন, নানারকম নেতিবাচক কথায় তাঁর এই উদ্যোগকে পিছিয়ে দিতে চাইছেন। হাতে গনা অল্প কয়েকজন মানুষ তাকে ইতিবাচক পরামর্শ দিয়েছেন। তাকে বললাম, ভাইয়া, মন খারাপ করবেন না। সবার মাঝে যদি ছোট ছোট প্রচেষ্টাকে উৎসাহ দেয়ার প্রবণতা থাকত, তাহলে এই সমাজ সফল মানুষদের ভীড়ে কোলাহল মুখর থাকত। অথচ বাস্তবে সবাই সফল হয় না, কারন সবাই চেষ্টা করে না। যারা সকল প্রতিকুলতা দূরে ঠেলে সামনে এগিয়ে যায়, তারাই সফল হয়। এটাই এই সমাজের লিখিত নিয়ম, যা আমরা কেউই চোখে দেখি না। আমাদের সবার দেখার চোখ হোক, এটাই সময়ের দাবি।
তথ্যসুত্রঃ
প্রথম আলো, চ্যানেল আই এবং ট্রাভেল বাংলাদেশ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:০২