একদিন রহিম সিদ্ধান্ত নিল, তার বহুল পরিচিত ভালো মানুষের মুখোশটির আড়ালে থাকা কদর্য নোংরা চেহারাটিকে ও সবার সামনে প্রকাশ করবে। সত্যকে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিতে পেরে সে বড়ই আনন্দিত এবং কিছুটা উত্তেজিতও বটে। মিথ্যে মুখোশের আড়াল থেকে মুক্তির অপেক্ষা নিদারুন যন্ত্রনাময়। সত্য প্রকাশের সাহসে যখন কোন মানুষ নেশাগ্রস্থ হয়, তখন তা পরিনত হয় পৃথিবীর ভয়ংকর নেশাতে। রহিম আজকে সেই নেশায় আচ্ছন্ন।
পরদিন ভোরে রহিম যখন তার ঐ দীর্ঘদিনের পরিচিত মুখোশটা খুলে একমাত্র নিজের চেহারার উপর ভর করে রাস্তায় বের হল, তখন মনে মনে ও আশংকা করল, এই বুঝি সবাই ভয় পাবে। বিরুপ প্রতিক্রিয়া বলবে, ছিঃ তুমি এত জঘন্য, নোংরা, কুৎসিত? আগে কেন বুঝতে পারি নাই।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সম্পূর্ন ভিন্ন চিত্র। চারিদিকে উৎসবের আমেজে শহরের সব মানুষ পরেছে নানা রঙের মুখোশ। হাস্যকর ব্যাপার সবাই পরেছে নিজ নিজ চেহারারই মুখোশ। রহিম বুঝতে পারল না, মুখোশ যদি পরতেই হয় তাহলে নিজেদের চেহারার মুখোশই পড়া কেন? মানুষের স্রোত পাশ কাটিয়ে যাবার সময় পরিচিতজনরা সবাই হাসি মুখে সম্ভাষণের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, অন্যদের চোখেও নেই কোন আলাদা দৃষ্টিকটু শীতল অভিব্যক্তি। রহিম মনে মনে ভাবল, তবে কি এই শহরে মুখোশের আড়ালে থাকা কদর্য রুপ একটি পরিচিত দৃশ্য?
রহিম মাথা নিচু করে হাটতে থাকে। রাস্তার মোড়ে একটা পরিচিত টং দোকান দেখে ও সিগারেট ধরাবার জন্য দাঁড়ালো। পাশেই ছোট্ট একটা মেয়ে নিজের হাসিখুশি প্রতিচ্ছবির মুখোশ পরে হাড়ি পাতিল খেলছে। চোখাচোখি হতেই মিষ্টি একটা হাসি দিলো। উত্তরে রহিমেরও হাসা উচিত, কিন্তু সে হাসতে পারল না, মনের গভীরে কোথাও যেন একটা অশনি সংকেত বেজে উঠল।
সিগারেট ধরাতে গিয়ে চোখ পড়ল দোকানদারের উপর। বিশাল দেহ নিয়ে এই লোক কিভাবে এই ছোট্ট দোকানে প্রবেশ করল তা রহিমের মাথায় ঢুকল না। আরো হাস্যকর ব্যাপার এই লোকটাও নিজের পান খাওয়া বিকশিত দাঁত সমৃদ্ধ টাক মাথার একটি মুখোশ পড়ে আছে। চায়ের কথা বলার আগেই দোকানদার বলে উঠল, কি রহিম ভাই! আজকের দিনে অন্তত একটা মুখোশ পড়তেন? টাকা পয়সার সমস্যা হলে বলতেন, আমি দিতাম।
রহিম প্রচন্ড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, মুখোশ পড়ব মানে? আমি কি কোন মুখোস পড়ে আছি নাকি? দেখেন না আমি আজকে মুখোশ ছাড়া রাস্তায় বের হয়েছি।
দোকানদার হো হো করে হেসে উঠে, বলল, ভাই কি সকাল বেলা আমারে মফিজ বানাইতে চান? আপনার এই চেহারা তো আমরা সেই কবে থেকে দেখে আসতেছি! মনে নাই, আপনার বাসায় যে আমার বউ কাম করত? চুরির অপরাধে যে গর্ভবতী বানাইয়া বিদায় কইরা দিসিলেন? বউটা মইরা গেলেও একটা মাইয়া দিয়া গেছে। ঐ যে দেহেন, পাশেই বইসা খেলতেছে। এরেও চাইলে ঘরে নিতে পারেন। কেউ কিছু বুঝব না, তয় এইবার একটু ট্যাকা বেশি দিয়েন। আমার পালতে কষ্ট হয়।
হঠাৎ রহিমের হাত পা অবশ হয়ে আসতে লাগল। ছোট্ট মেয়েটার সাথে আবারও চোখাচোখি হল। মুখোশের অন্তরালে এবারও মেয়েটার চোখে মিষ্টি কৌতুহলের হাসি। ওর আর সহ্য হলো না। চারিদিক প্রচন্ড গতিতে ক্রমাগত ঝাপসা হয়ে আসছে। প্রচন্ড আতংক বুকে নিয়ে ও ছুটে পালাতে শুরু করল। একদৌড়ে বাসায় ফিরে খুঁজে বের করল আলমারিতে খুলে রাখা তার জীবিকার একমাত্র সম্বল ভালো মানুষের মুখোস। প্রচন্ড বিস্ময়ে ও লক্ষ্য করল, তার হাতে ধরা একটা নোংরা, হিংস্র, কদর্য মুখের তেল চিটচিটে মুখোশ।