আগামী মাস থেকে স্টার জলসা সহ আরো একটি ভারতীয় চ্যানেল নাকি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ! তবে এই খবরে দেশের আপা, ভাবী ও খালাম্মা সমাজে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। অনেকেই হুমকি দিয়েছেন, তারা প্রয়োজনে ইন্টারনেট থেকে এই সব চ্যানেল লাইভ দেখবেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হলেও, কেন তাদের এই বিরুপ মনোভাব- এই নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই। যদি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন যে বাংলাদেশে চালু বেসরকারী টিভি চ্যানেলের সংখ্যা প্রায় ১৬টি। আমাদের মত একটা ছোট দেশের জন্য এই সংখ্যাটি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। যতদূর জানি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে প্রায় আরো ১০/১৫ টির মত নতুন টিভি চ্যানেল। মজার বিষয় হচ্ছে এই সব চ্যানেলের প্রত্যেকটাই একে অন্যের কপিপেষ্ট এবং সবগুলোতেই প্রায় একই ক্যাটাগরীর অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। উদহারন- এনটিভিতে ক্লোজাপ ওয়ান চালু হবার পরেই আবার শুরু হলো চ্যানেল আই এর সেরা কন্ঠ! তার ধারা বজায় রেখে বিভিন্ন চ্যানেলে এখনও হচ্ছে এই ক্যাটাগরীর নানারকম অনুষ্ঠান। ফলে একজন সাধারন দর্শক হিসেবে অনুষ্ঠানের তালিকা এবং মান অনুযায়ী তাদের আলাদা করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে একঘেয়েমি কাটাতে দেশীয় দর্শকদের একটা বিরাট অংশ ঝুকে পড়ছে ভারতীয় চ্যানেলের দিকে। যেহেতু তারা সেখানে নিখাদ বিনোদন পাচ্ছে তাই সেই অনুষ্ঠান বা সিরিয়ালগুলো যতই আজগুবি হোকনা কেন, তারা তাই পছন্দ করছে। এর প্রভাব শুধুমাত্র দেশীয় চ্যানেলগুলোর উপর পড়ছে না বরং পোষাক, কসমেটিস, সামাজিক আচরন ইত্যাদির উপরও পড়ছে। ফলে আমাদের দেশে ঈদ এবং পূজার সময় সানি লিউন, কাশিস, পাখি ইত্যাদি ড্রেসের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে এবং আবার ইফতার পার্টির পাশাপাশি সেহেরী পার্টিও হচ্ছে এবং ড্রেস না পেয়ে আবার আত্মহত্যাও হচ্ছে। এই দিকে আমরা আবার সভা সমাবেশে, ফেসবুক স্ট্যাটাসে পাবলিকের এই সব 'দেশবিরোধী চেতনার' মুন্ডপাত করে গালি দিয়ে 'দেশপ্রমের চেতনায়' উজ্জীবিত হচ্ছি।
আমি কখনই বাংলাদেশে এত এত টেলিভিশন চ্যানেল বা মিডিয়ার উন্নতি দেখে লাফানোর মত কিছু খুঁজে পাই না। কেননা আমার মতে এই সব চ্যানেলের কোনটাই দর্শকদের সুস্থ বিনোদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটা টিভি চ্যানেল দেয়ার প্রধান লক্ষ্যই হলো, মূলত অনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ নেয়া, জনগনের সামনে নিজ নিজ এজেন্ডা ও আদর্শ ভিত্তিক খবর তুলে ধরা। উদহারন, একাত্তর টিভি এবং দিগন্ত টেলিভিশন। যেহেতু শুধু নির্লজ্জ ভাবে নিজ নিজ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা যাবে না তাই সেখানে বাধ্য হয়ে দর্শকদের জন্য কিছু অনুষ্ঠানমালা থাকতে হয়। ফলে সাধারন দর্শকদের জন্য অনুষ্ঠানের মান খুব একটা বৃদ্ধি পায় না। যার কারনে এত এত টিভি চ্যানেল থাকা স্বত্তেও নিজ নিজ চ্যানেলের মান উন্নয়নের ব্যাপারে তেমন প্রতিযোগিতামুলক কিছুই একজন সাধারন দর্শক হিসেবে আমার চোখে পড়ে না।
যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি ইরেটেটিং বা বিরক্তকর তা হলো যতই নিম্নমানের টিভি চ্যানেল হোক না কেন তাদের একটা সংবাদ টিম থাকতে হবে আর সংবাদ টিমে থাকবেন কিছু সাংবাদিক। এটা অনস্বীকার্য যে বর্তমানে 'সাংবাদিকতা' শুধু একটি পেশা নয় একটি 'ক্ষমতাও' বটে। এই দেশের সকল দূর্নীতিবাজ হোক সে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী কিংবা সরকারী আমলা তারা সকলেই ধরা আছেই এই সব ক্ষমতাধর সাংবাদিককের কাছে। তবে এই শ্রেনীর লোকরাই আবার বিভিন্ন চ্যানেলেরই মালিক। যার কারনে আপনি এমন কোন টিভি চ্যানেল দেখবেন না যাদের সংবাদ পরিবেশন বিভাগ নেই। ফলে জাতির বিবেক হিসেবে চিহ্নিত ক্ষমতাধর সাংবাদিকরা কতখানি নিজেদের বিবেক সময় মত জাগ্রত করতে পারেন বা আদৌ পারেন কি না সেই বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। যদি কেউ স্রোতের বিপরীতে যেতে চায়, তার পরিনতি হয় খুবই ভয়াবহ, উদহারন - সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর রুনি।
আরো একটি চরম বিরক্তিকর দিক হলো যে কোন অনুষ্ঠানের (টক শো আর খবর ছাড়া) মাঝে অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন বিরতি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজারে প্রচলিত আছে - দর্শকরা এখন আর অনুষ্ঠানের মাঝে বিজ্ঞাপন দেখেন না, বিজ্ঞাপনের মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান দেখেন। সুতরাং বিজ্ঞাপনের বিড়ম্বনা কোন পর্যায়ে গিয়েছে তা নিশ্চয় এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর একটি ভালো অনুষ্ঠানের আবেদন নষ্ট করার জন্য চ্যানেলগুলোর এই অতিবানিজ্যিক মনোভাবই যথেষ্ঠ।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাইলে দেশী চ্যানেলে বিনোদনের উপায় কি?
উত্তর হচ্ছে- প্রতিটি চ্যানেলের এত হাজার হাজার সাংবাদিক সারাদিন রাত খেটে নানাবিধ সংবাদ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নোংরামি আর কাঁদা ছোঁড়াছুড়িকেই জনগনের সামনে বিনোদন হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাই তো প্রতি রাতেই প্রতিটি টিভি চ্যানেলে টকশো আর সংবাদ বিশ্লেষন চলছেই। আমার এক টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, কি রে ব্যাটা তোদের চ্যানেলে এবার ঈদের অনুষ্ঠান কেমন হইব? সে বলল, দোস্ত! - দেশের রাজনীতির যে অবস্থা, পাবলিক তা দেইখাই যে বিনোদন পাইতেছে, আমরা আবার টাকা খরচ কইরা কি বিনোদন অনুষ্ঠান বানামু! সত্যি বলতে হয়ত এটাই বাস্তবতা।
তবে আরো বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশে প্রচুর তরুন নির্মাতা আছেন যাদের অসামান্য দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা রয়েছে আমাদের চ্যানেলগুলোতে দর্শক টেনে রাখার জন্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারা উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষক পাচ্ছে না। একটা ভালো সিরিয়াল বা নাটক বানাতে যে অর্থ লগ্নি করা প্রয়োজন চ্যানেলগুলো তা কোন ভাবেই দিচ্ছে না। এখানে চলে লিংক বানিজ্য। লিংক থাকলেই আপনার অখাদ্য যে কোন নাটক বা অনুষ্ঠান প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দামে কিনে নিবে। আর লিংক না থাকলে আপনার সামনে আসবে - ১০০ টাকার মধ্যে "কাচ্চি বিরিয়ানী মুরগীর মাংস, খাসির রেজালা, চাইনিজ সবজি, সালাদ, বোরহানী, ফিরনী" যদি দিতে পারেন তাহলে ১০০ জন লোকের খাওয়ার অর্ডার এক্ষুনি নিয়া জান, ৩ মাস পরে ৫০% টাকা পাবেন আর বাকিটা পাবেন আরো ৩ মাস পর-- এই টাইপের অফার। এই ধরনের ফাইজলামির হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক প্রতিভাবান পরিচালক/নির্মাতা তাদের কনসেপ্ট নামমাত্র মুল্যে বিক্রি করে দিয়ে সান্তনা খুঁজে অথবা রাত দুপুরে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়ে সিগারেটের টানে টানে নিজের সৃজনশীলতাকে ধোঁয়া হিসেবে উড়িয়ে দেয়।
পাশাপাশি দরকার দর্শকদের কিছুটা উদার মনোভাব। ভারতীয় সিরিয়াল দেখায় সময় আমাদের দেশের দর্শকরা যে তুলনামূলক উদার মনোভাব পোষন করেন, তার সামান্য কিছু এই দেশে দেখাতে গেলে দেশ, জাতি, সমাজ, ঐতিহ্য, নারী, সতীত্ব, কৃষ্টি কালচার সবই গেল গেল রব উঠে যায়। উদহারন ফাস্ট ডেট নামক নাটকে ছেলে তার প্রেমিকাকে রুমে নিয়ে যায় দেখে ছি ছি করেছিল দেশের সুশীল দর্শকগন। অথচ তার কয়েকদিন পরেই 'আকশারা' নামক একটি জনপ্রিয় হিন্দি সিরিয়ালে নায়ক নায়িকার বেশ অন্তরঙ্গ দৃশ্য পরিবারের সবাই মিলে দেখেছিল। তখন তো কিছুই আমরা শুনি নি। এই ধরনের হিপোক্রেসী মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। অবশ্য ব্যাপারটা যদি এমন হয়, ধুর! এরা কি আর আমাদের দেশের কেউ? এরা করলে করুক, দেখলে দেখাক, আমরা মজা পেলেই হলো। তাহলে কিছু বলার নেই। শুধু মনে রাখবেন, এই দেশের তরুন নির্মাতারাও আপনাদের আরো অনেক শালীন ও বর্তমান দেশীয় প্রেক্ষাপটের সাথে মানানসই যথেষ্ট মার্জিত মজা উপহার দিতে পারে।
তাই দেশীয় দর্শকদেরকে যদি সত্যিকারভাবে আমাদের ধরে রাখতে হয়, তাহলে অবশ্যই চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে এবং তারপর আমাদের দর্শকদেরকেও দেশের সামাজিক পরিবর্তন মেনে নিতে হবে। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সুপরিচিত মিডিয়া হ্যাডমদের যে সিন্ডিকেট আছে তা নিস্ক্রিয় করতে হবে। লিংক বানিজ্য বন্ধ করতে হবে। সংবাদ এবং বিনোদন মূলক অনুষ্ঠানের চ্যানেল আলাদা করতে হবে। অনৈতিক ক্ষমতার লোভে যত্রতত্র চ্যানেল অনুমোদন করা যাবে না। এই বিষয়গুলো যদি সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রন করা যায় তাহলে আর বেশি দিন নয় যেদিন দর্শকরা আমাদের দেশের অনুষ্ঠান নিয়ে খুশি থাকবেন। আপা ভাবী আর খালাম্মাদের ভালো অনুষ্ঠান দেখার জন্য কান্নাকাটি করতে হবে না।