আমাদের বাঙালিদের ভোজন রস বা রসিকতা মাঝে মাঝে বেশ নির্মমতার উপলব্ধি সৃষ্টি করে। কিছু কিছু প্রানীদের জন্য এই রসবোধ বেশ আতংকের ব্যাপারও বটে। এই যেমন ধরুন গরু! বাঙ্গাল দেশে একটি গরু জবাই হবার পর পরই বেচারা গরুর আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। গরুর মাথা থেকে শুরু করে লেজ পর্যন্ত আমাদের ভোজন রসিকদের নানা রকম মুখরোচক ও রসালো খাবারের আইটেমে পরিনত হয়। মগজ, ফুসফুস, গুর্দা, কলিজা, তিল্লি, হাড্ডি ইত্যাদি তো আছেই, পাশাপাশি গরুর ভূড়ি এমন কি "ওলান" দিয়ে পর্যন্ত ক্ষিরি টাইপের বেশ কিছু রসালো কাবাব আইটেম বানানো হয়। তবে আশার কথা, চামড়া দিয়ে এখন পর্যন্ত কোন খাবারের আইটেম আমাদের সেলিব্রেটি রাঁধুনিগন আবিষ্কার করতে পারেন নি।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হূমায়ুন আহমেদ যখন মারা গেলেন, তখন কয়েকদিন টিভি খুললেই দেখা যেত বিভিন্ন চ্যানেল তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নানারকম অনুষ্ঠান প্রচার করছে। একবার একটি টিভি চ্যানেলে দেখলাম, জনৈক রাঁধুনি গরুর লেজ দিয়ে কিভাবে কাবাব বানাতে হয় তা শেখাচ্ছেন আর গুন গুন করে গাইছেন – “ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়, চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়"। হলি কাউ!! আমি ভয়ানক ভাবে চমকে উঠলাম। এটা কি তবে হূমায়ুন আহমেদের পছন্দের কোন খাবারের রেসিপি? জানা মতে তাঁর কোন বইতে আমি দেখি নি তিনি গরুর লেজের কাবাব খেতে পছন্দ করেন। অপরিসীম আতংক নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন উপস্থাপিকা বলবেন, প্রিয় দর্শক! এতক্ষন আপনাদেরকে দেখানো হলো হুমায়ুন আহমেদের প্রিয় খাবার- গরুর লেজের কাস্মীরি কাবাব।
থ্যাংক্স গড! তিনি এমন কিছুই বলেন নি। হূমায়ুন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি অনুষ্ঠান শেষ করলেন। আমার আবেগে চোখে পানি চলে আসল। একমাত্র গভীর শ্রদ্ধাই হুমায়ুন আহমেদকে এই গরুর লেজের কাবাব হতে উদ্ধার করেছে।
যাই হোক, অভাগা গরুর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কোরবানীর ঈদের কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে, আমাকে গরুর বটের কাবাব খেতে হয়েছিল। সত্যি বলতে আমি কোনভাবেই জিনিসটা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু সে অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে আমাকে সেই দোকানে নিয়ে হাজির করল। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম কোন টং টাইপ দোকান হবে। গরুর বট কোন চেয়ার টেবিল ওয়ালা দোকানে বেচতে দেখি নি। কিন্তু এখানে দেখলাম বসার জন্য টুল আছে। ঠান্ডা ফিল্টার পানি পর্যন্ত আছে। চেয়ে দেখলাম, বড় একটা কয়লার চুল্লিতে সারি সারি করে গরুর বটের কাবাব ভাজা হচ্ছে। বাতাসে দারুন একটা গন্ধ। আমার মত একজন ভোজন রসিক মানুষের পক্ষে এই গন্ধ উপেক্ষা করা বেশ কঠিন। তাছাড়া আমার সারা শরীর বাঙালির ভোজনরস দ্বারা টইটুম্বর। ফলে দোকানের পরিবেশ এবং পরিবেশিত কাবাবের চেহারা দেখে আমি রাজি হয়ে গেলাম।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাবাব বানানো দেখতে লাগলাম। অর্ডার পাবার পর প্রথমে তারা আগে থেকে বিভিন্ন মশলার সংমিশ্রনে মেরিনেট করে রাখা গরুর বটগুলোকে শিকে লাগিয়ে কয়লার আগুনে ঝলসে নেন পাশাপাশি একটি ব্রাশের মাথায় তেল লাগিয়ে কিছুক্ষন পর পর কাবাবের উপর আলতো করে বুলিয়ে দেন। তারপর অন্য একটি শিকে কিছুটা সিদ্ধ করা আলুকে অল্প কিছু সময়ের জন্য কয়লার আগুনে ঝলসে নিয়ে একটা প্লেটে আলাদা করে রাখা হয়। তারপর আলুগুলোকে সামান্য গোলমরিচ, পদিনা পাতা, ধনিয়া, লেবু দিয়ে ভালো করে কচলে তার মধ্যে কাচা মরিচ ও তেঁতুলের একটি মিশ্রন দিয়ে আবারো খানিকটা কচলে তার উপর আগুন গরম গরুর বটের কাবাবগুলো ছেড়ে দেয়া হয়। তারপর পরিবেশন করা হয়।
আমাদেরকে প্রায় ১৫ মিনিট অন্যের জন্য খাবার পরিবেশনা দেখতে হল। বুঝতেই পারছেন, সেই সময়ের মানসিক অবস্থাটা কেমন ছিল। জিনিসটা খেতে কেমন হয় তার জন্য আমি কিছুটা রোমাঞ্চিত ছিলাম। খাবারটা সামনে আসার পর, আমি চোখ বন্ধ করে বিসমিল্লাহ বলে মুখে দিলাম। তারপর আসলেই আর কিছু বলার নেই। শুধুই আহা! আহা! অনুভূতি! অমৃত!! অমৃত !! আমি খেয়েই চলেছি। ঝালে আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম! মাথার তালুতে ঘাম! যখন হুস ফিরল- আমার বন্ধু ততক্ষে ৩ প্লেট নামিয়ে ফেলেছে আর আমি দুই প্লেট। আরো খেতে মন চেয়েছিল! কিন্তু সকালবেলার অনাগত সমস্যার কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট করে নিয়ন্ত্রন করলাম।
খাওয়া শেষ করে একটা বিহারী-পান মুখে ঢুকিয়ে আয়েস করে যখন চাবাতে চাবাতে ঢেকুর তুলছিলাম, তখনই দেখলাম জনৈক ভদ্রলোক একটি গরু কিনে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন আর তার পিছনের গরুর দড়ি হাতে অন্য দুইজন। ভদ্রলোকের চোখে মুখে বেশ পরিতৃপ্তির ছাপ আর পিছনের দুই চোখে কেমন যেন একটা শিকারী শিকারী ভাব। আশেপাশের মানুষকেও দেখলাম, গরু দেখেই কেমন যেন সবাই উল্লসিত হয়ে উঠলো। প্রায় সবার চোখেই ফুটে উঠেছে মাংস "পরিমাপক" বিশেষ দৃষ্টি। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, কোরবানী এলেই কমবেশি আমাদের সকলের চোখেই এই ধরনের বিশেষ দৃষ্টির আবির্ভাব ঘটে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমিও আমার সর্বভূক দৃষ্টি দিয়ে গরুটাকে দেখছি। আহ! কি সুন্দর হৃষ্টপুষ্ট শরীর। কি মিষ্টি গায়ের রঙ! কি সুন্দর পশ্চাৎদেশ। এই অংশ দিয়েই কমপক্ষে একশ লোকের মেজবান খাওয়ানো যাবে। আমি নিশ্চিত, চিত্রনায়িকা মুনমুন সামনে থাকলে এতক্ষনে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরতেন।
মনে মনে আমি যখন গরুটিকে নানা রকম উপায়ে সর্বস্ব খাওয়ার পরিকল্পনা করছি, তখনই জীবনে প্রথমবার কোন গরুর সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল। আর সাথে সাথেই গরুটি সতর্কভাবে থেমে গেল। সাথের লোকজন হাজার চেষ্টা করেও সামনের দিকে গরুটিকে আনতে পারল না। আমি এক পা এগিয়ে সবে মাত্র দাম জিজ্ঞেস করতে যাব, ওমনি হঠাৎ করে গরুটার সে কি প্রানান্ত দৌড়! আচমকা টানে যিনি গরুর দড়ি ধরে ছিলেন, তিনি উল্টে গিয়ে রাস্তায় পড়লেন। বেচারার পায়জামা ছিড়ে গেল। আরো সমস্যা, তার পায়জামার নিচে কিছুই ছিল না। দ্বিমুখী এই বিনোদনে মানুষজন বেশ দ্বিধায় পড়ে গেল। শেষমেষ ভদ্রলোকই গরুর পিছে ছুটলেন।
আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেসা করলাম, কি রে গরুটা এমন করল কেন? বন্ধু বলল, কি জানি! হয়ত কিছু একটা দেখে ভয় পাইছে। আমি এদিক সেদিক তাকালাম। কিছুই দেখলাম না। হঠাৎ রাস্তার পাশের সেলুনের আয়নায় আমার চোখ পড়ল। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠলাম। প্রতিবিম্বের আড়ালে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একজন কালো কন্টকগ্রস্ত কুৎসিত সর্বভূক শিকারী, যার চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে তীব্র লালসা আর লোভের আগুন। এমন দৃশ্য দেখে ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। আমি প্রচন্ড ভয় পেলাম। আমি দৌড়াতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না। আমার চারিদিকে অন্ধকার। আমি জানি ঐ অন্ধকার পথেই ঘাপটি মেরে পড়ে আছে আমার চেয়েও ভয়ংকর দুই মাথা বিশিষ্ট এক দেহের একটি নোংরা দানব। দানবটির সারা দেহ জুড়ে ৩০০ টি ছোট ছোট মুখ! এই মুখগুলো সর্বগ্রাসী, সর্বচোষ্য এবং আজন্ম ক্ষুধার্ত - যা কিনা সুদীর্ঘ বছর ধরে ক্লান্তিহীন ভাবে ভোজন করে ঐ দুটি মাথায় পুষ্টির জোগান দিয়েছে। পুষ্টিতে তাদের স্বাস্থ্য বেড়েছে, মুখের রুচি বেড়েছে সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুই মুখে জমে থাকা পচারসের দূর্গন্ধের মত অতৃপ্তির নিঃশ্বাস। বেয়াল্লিশ বছরের ক্রমাগত ভোজনেও তারা ভাগাভাগি করে খেতে শিখেনি। ফলে আজও চলে খাবারের জন্য মারামারি, ভোজনরসিকতার জন্য হয়ত বা লাল টেলিফোন। দানবকে বলা হয়েছিল, যদি সুস্বাস্থ্য চাও, তাহলে তোমার অতিরিক্ত খাদ্যাভাস বর্জন কর। দুটো মাথা এক সাথে অবজ্ঞার হাসি হেসে বলেছিল, বাঙালীর আবার ডায়েট কিসের?
হঠাৎ আমার মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠল। আমি রাস্তায় বসে পড়লাম। বন্ধ চোখে দেখতে পেলাম, সুন্দর সবুজ মাঠে সেই কালো কন্টকগ্রস্ত কুৎসিত সর্বভূক শিকারীর আস্ফালন। আমার বন্ধু আমাকে দ্রুত একটি বাসে তুলে দিল। বাস ছুটছে প্রবল বেগে। কিন্তু আমার জানালায় মুক্তির বাতাস কেন আসছে না??