বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ অনেক বছর, একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে হয়ত অনেক কম। কিন্তু এই কমের মধ্যেও যা আমাদের প্রাপ্য ছিল তার সব কিছু কি আমরা পেয়েছি? পাই নি। এই কয়টি বছরে আমরা কি পারতাম না একটি স্থিতিশীল দেশ গড়তে? সব কিছু না হোক, কিছু বিষয়েও অন্তত এগিয়ে থাকতে? বরং আমরা এই কয়টি বছর দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার জন্য নিলর্জ্জ হানাহানি, দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে সাধারন মানুষের সাথে প্রতারনা, নিজেদের স্বার্থের জন্য দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দেয়া। কষ্টের বিষয় আমাদের নতুজান পররাষ্টনীতি, বিদেশীদের প্রতি অতিমাত্রায় আনুগত্য, জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের অভাব এবং সর্বপরি আমাদের সচেতনতাই আমাদের দেশের এই অস্থিতিশীল অবস্থার জন্য দায়ী।
আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই হচ্ছে মূদ্রার এপিঠ আর অপিঠ। রাজনীতির নামে চলছে দূর্নীতির চর্চা। তাদের এই দূর্নীতির কারনে, রাজনীতি বাংলাদেশে একটি বিনা পুঁজির লাভজনক পেশা। নতুন প্রজন্ম যখন রাজনীতিতে আসতে চায় তখন তাকে শেখানো হয় টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, হত্যাসহ আরো নানা রকম বিষয়। এরা নতুন প্রজন্মকে শেখায় না কিভাবে মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে, কিভাবে ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। এরা শিখায় কিভাবে মানুষকে ভয় দেখাতে হয়, কিভাবে অস্ত্রের মুখে প্রতিবাদী কাউকে থামিয়ে দিতে হয়। ফলে এই রাজনীতি বা রাজনীতিবিদরা সাধারন মানুষের কাছে একটি আতংকের নাম এবং ক্ষেত্র বিশেষে একটি গালিও।
দুঃখের সাথে বলতে হয়, দীর্ঘদিন দূর্নীতির সাথে বসবাস করে আমাদের মনের নৈতিক শক্তিও অনেক অধপতন হয়েছে। আমরা সব কিছুতেই শুধু অন্যদের উপর দোষ চাপাই, দোষ স্বীকার করার ক্ষমতা আমাদের প্রায় নষ্টই হয়ে গিয়েছে। তাই তো একজন মন্ত্রী ঘুষ নিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পরার বিরোধীদলের ষড়যন্ত্রের কথা বলে নিলর্জ্জের মত পদ আঁকড়ে বসে থাকেন, আরেকজন দূর্নীতিবাজ দেশপ্রেমিক খেতাবে ভূষিত হয় এবং দেশবরন্য একজন নেত্রী তার ছেলের দূর্নীতির কথা অস্বীকার করে উল্টা তাকে সৎ এবং মহান বলে অখ্যায়িত করেন। ভাবতে লজ্জা লাগে, আমাদের সাধারন মানুষের মধ্যে কিছু মানুষ এইসব আবার সমর্থনও করেন। এটা কি আমাদের জাতির জন্য লজ্জাজনক নয়? অবশ্য জামাত শিবিরের মত একটি দলের যদি অনুসারী থাকতে পারে তাহলে এইসব কাজের সমর্থক থাকা বিচিত্র কিছু নয়।
ইদানিং পত্রপত্রিকায়, নানারকম টেলিভিশন চ্যানেলে গার্মেন্টস শ্রমিকদের দৈন্যদশা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বিজিএম, রাজনৈতিক দল এবং বিশেষ করে বিদেশীরা অনেক কথাই বলছেন। বাংলাদেশে শ্রমিক হওয়া এমনিতেই পাপ, তার উপর যদি হয় আরো গার্মেন্টসকর্মী তাহলে তো কথাই নেই। বাংলাদেশে একজন মানুষ যখন নিজেকে মানুষ হিসেবে আর পরিচয় দিতে চান না, তখন সে নিজেকে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকে রুপান্তরিত করে। গ্রার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে বিদেশীদের উৎকন্ঠা চোখে পড়ার মত। যখনই আমাদের দেশে কোন দূর্ঘটনা ঘটে তখনই দেখি তারা কত আহা উহু করছে। আমরা আমাদের দেশের শ্রমিদের মর্যাদা দিতে পারি না, ন্যায্য মুজুরী দিতে পারি না, নিরাপত্তা দিতে পারি না ইত্যাদি আরো অনেক অভিযোগে অভিযুক্ত হই। আমরা তাদের আবেগীয় আহা উহু এবং অভিযোগ শুনে নিজেরাই লজ্জাবোধ করি আর দেশের সরকার, মালিক এবং সিস্টেমের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করি। তবে মজার বিষয় এই আহা উহু করা বিদেশীরাই বাংলাদেশ থেকে পন্য কিনার সময় একজন হিসেবী ক্রেতায় অবতীর্ন হন। আমাদের দেশের মেয়েরা যেভাবে বাজারে কিছু কিনতে যায়- অনেকটা সেই রকম। একই মানের পন্য তারা যে দামে চায়না, ভারত কিংবা ভিয়েতনাম থেকে কিনেন, সেই একই পন্য বাংলাদেশ থেকে কিনলে তার অর্ধেকও ঠিকভাবে দিতে চান না। কারন তারাও জানেন, আমাদের এইখানে শ্রমের বাজার সস্তা, আমাদের দেশে শ্রম আইনের তেমন কঠোর প্রয়োগ নেই
তাই আমি মনে করি, গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে বিদেশীদের এই সকল আবেগ এবং উৎকন্ঠা একটি সুন্দর অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নয়। যে দামে তারা চায়না, ভারত কিংবা ভিয়েতনাম থেকে পন্য কিনেন, তার অর্ধেকও তারা বাংলাদেশকে দিতে চান না। কেন রে বাবা? বাংলাদেশ কি মন্দিরের ঘন্টা নাকি যে যার ইচ্ছে মত বাজিয়ে যাবে? ভাবতে অবাক লাগে এরাই আবার মানবতার কথা বলে এবং মানবিকতার জন্য নাকি যুদ্ধ করে।
শ্রমিকদের এই দূর্গতি শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিদেশেও হচ্ছে। অনেক বেশি কঠিন পরিশ্রম করা স্বত্তেও আমাদের দেশের শ্রমিকরা বিদেশে তার সঠিক শ্রমের মূল্যায়ন পান না। একজন ভারতীয় শ্রমিকের বেতন প্রায় আমাদের দেশীয় একজন শ্রমিকের দ্বিগুন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে তখন সেই বিদেশীদের এই সব মানবিকতার প্রশ্ন কোথায় থাকে? তারা দেখেন না আমাদের শ্রমিদের বড় একটি অংশ কিভাবে অবহেলার স্বীকার হচ্ছেন? উত্তর হচ্ছে, আরে ভাই আমরা নিজেরাই নিজেদের দেখি না, অন্যদের কি ঠেকা পড়েছে।
তাই নিরাপত্তা কিংবা ন্যায্য মুজুরী কিংবা সাধারন মানুষের জীবনের তথাকথিত উন্নতি নিয়ে আমাদের নেতাদের বড় বড় আশ্বাস যখন শুনি তখন আমার বড্ড হাসি পায়। তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, মানুষের অধিকার আদায় হবে, এই কথা আর যাই হোক বিশ্বাস অনেক কষ্টের। আমি একজন দূর্বল মানুষ। আমার হৃদয় আরো বেশি দূর্বল। তাই ইচ্ছা করেই কোন চাপ নিতে চাই না।
তবে আমি বিশ্বাস করি, এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, নতুন প্রজন্মই হয়ত এই অবস্থা পরিবর্তন ঘটাবে। তাদের কোন ভালো বা যোগ্য নেতার উদহারন লাগবে না। তারা নিজেরাই শিখবে আদর্শ এবং দেশপ্রেম। যেমনটি শিখেছি আপনি এবং আমি। আমি এটাও বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের সব রাজনীতিবিদরা একই রকম নন। এখনও হয়ত কিছু ভালো মানুষ আছে, যাদের আমরা এখনও চিনতে পারিনি। তারাও হয়ত অপেক্ষা করছেন নতুন একজন নেতার জন্য। যার নেতৃত্বে আমরা এই অবস্থা থেকে বের হতে পারব। যতদিন পর্যন্ত আমরা এই একই সিস্টেমে চলব, যতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা সহঅবস্থানে আসবে না, ততদিন পর্যন্ত আপনি আমি যতই মায়া কান্না কাঁদি না কেন, এই হতভাগা শ্রমিকগুলোর তথা আমাদের দেশের কোন উন্নতিই আমরা আশা করতে পারি না।