বর্তমান সময় চাকুরী একটি সোনার হরিন। পড়াশুনা শেষ করার সাথে সাথেই এই সোনার হরিনের পিছনে সবাইকে দৌড়াতে হয়। এই দৌড়ে জয় পাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ন। সমাজে টিকে থাকতে হলে এই দৌড়ে জিততেই হবে। আমাদের পড়াশুনা, ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া, ভালো রেজাল্ট করা ইত্যাদি যতটা না শিক্ষিত হওয়ার জন্য করি, তার চেয়ে অনেক বেশি করি সোনার হরিন লাভের আশায়। কিন্তু অনেক সময় সঠিক তথ্য এবং পরিকল্পনার অভাবে এই সোনার হরিন ধরা কিছুটা কঠিন হয়ে যায়। ব্যক্তিজীবনে অনেকে পরিকল্পনাহীন থাকলেও, প্রফেশনাল জীবনে আপনাকে কিছুটা পরিকল্পনা করে এগুতেই হবে। আর তাই আমি ব্যক্তিগত এবং প্রফেশনাল অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। কারো যদি কাজে লাগে তাহলেই কেবল এই পোষ্টের সার্থকতা।
একটি ভালো চাকুরীর জন্য প্রস্তুতি কিন্তু মূলত এসএসসি এবং এইচএসসি থেকেই শুরু হয়। মানুষের জীবনটা যদি একটি বহুতল ভবনের সাথে তুলনা করেন তাহলে এই এসএসসি এবং এইচএসসি হচ্ছে তার ফাউন্ডেশন। তাই যারা এখনও এই সময়টা পার করেননি তাদের জন্য এটা খুবই গুরত্বর্পূন একটি সময়। মনে রাখবেন এই সময়ের রেজাল্ট যতো ভালো হবে ভবিষৎ এ আপনার কর্মজীবনের স্বাধীনতা তত বাড়বে।
আপনি কোন বিষয়ে পড়তে চান, এটা একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। আপনার অবস্থান এবং আগ্রহ বিবেচনা করে আপনি সেই বিষয়ে পড়ুন। মনে রাখবেন, কোন সাবজেক্টই খারাপ নয়। আর ভালো সাবজেক্টের কোন সংজ্ঞা নেই। প্রয়োগ করতে পারলে সব সাবজেক্টই ভালো। সঠিক প্রয়োগ না করতে পারলে কোন সাবজেক্টই ভালো নয়। যেমন আমার এক পরিচিত আছেন, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে চান্স পেয়ে পরের বছর মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। অনেক কষ্টে তিনি মেডিকেল পাস করেছেন। এবং এখন যে খুব ভালো অবস্থানে আছেন, তা একটা বলা যায় না। কারন তার সহপাঠীরা তার তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে আছে। শুধুমাত্র পারিবারিক কারন এবং তার নিজের সিদ্ধানহীনতায় তার অবস্থান কিছুটা নড়বড়ে। তিনি অবশ্যই মেধাবী কিন্তু তিনি তার মেধাকে সঠিক মূল্যায়ন করেননি। তাই অবশ্যই আপনাকে বিষয়টি সঠিক ভাবে নির্বাচন করতে হবে। আর এই ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি অপশন থাকা ভালো। তাতে প্রথম পছন্দের বিষয়ে পড়তে না পারলে যেন তার পরের অপশন কাজে লাগানো যায়।
যাই হোক আপনার পছন্দের বিষয়ে আপনি যখন পড়ছেন, তখন থেকেই আপনাকে চোখ কান খোলা রাখতে হবে। নিয়মিত পত্রিকা পড়বেন, বিশেষ করে চাকরীর বিজ্ঞাপনগুলো দেখবেন। লক্ষ্য করে দেখবেন, বিজ্ঞাপনে কি ধরনের যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। সাধারন যোগ্যতার পাশাপাশি বিশেষ কোন যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে কিনা। যেমন, কোন ডিপ্লোমা, বা সার্টিফিকেট কোর্স ইত্যাদি। যদি আপনার সাবজেক্টের সাথে যায় এবং প্রফেশনালী কাজে আসতে পারে তাহলে নিয়মিত পড়ার পাশেপাশে কোর্সগুলো করে ফেলুন। আর যদি নাই বা করতে পারেন, নূন্যতম ধারনা নিয়ে রাখুন। একজন ফ্রেস গ্রাজুয়েট হিসাবে এতে আপনার সিভি ভারী হবে। এর পাশাপাশি যদি বিশেষ কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আপনার দুর্বলতা থাকে তাহলে আপনি সেখানে যোগাযোগ করতে পারেন কোন খন্ডকালীন কাজের জন্য। অনেক প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের সুযোগ থাকে। মনে রাখবেন সুযোগ আপনাকেই তৈরি করে নিতে হবে। তৈরীকৃ্ত সুযোগ কাজে লাগানোই হচ্ছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে একজন স্মার্ট মানুষের সংজ্ঞা।
তবে ছাত্রজীবনে আপনি যে কাজই করুন না কেন, তাতে আপনার পড়াশুনার ক্ষতি যেন না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এখানে মূল লক্ষ্য কিন্তু পড়াশুনা। আর একটি বিষয়, আপনাকে এখন থেকেই কিছু কিছু জানাশোনা বাড়াতে হবে। যাকে আমরা বলি লিংক। বর্তমান সময়ে এই লিংক থাকা খুবই কাজের জিনিস। লিংক থাকাটা খারাপ কিছু না।
সময় যত যাবে লিংক তত বাড়বে। ধরুন কারো সাথে আপনার নতুন পরিচয় হলো। হয়ত তিনি কোন ব্যবসা করেন। তার ব্যবসা সর্ম্পকে জানলেন। তার সাথে একটা ফরমাল সর্ম্পক তৈরি করলেন। পরবর্তীতে ধরে নিন আপনি এমন একটি কোম্পানীতে যোগদান করলেন যারা বিভিন্ন কেমিক্যাল, পার্টস ইম্পোর্ট করে নিয়ে আসে। আপনি যদি সেই কোম্পানীর সেলসে থাকেন তাহলে সেই ব্যবসায়ী আপনার একজন লিংক হতে পারে। যা আপনি নিজেই তৈরি করেছেন।
বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ট্রেনিং একটি গুরুত্বপূর্ন যোগ্যতা হিসেবে কাজ করে। যারা গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন এবং চাকুরী খুঁজছেন, তারা যদি তাদের বিষয় সংশ্লিষ্ট একটি ট্রেনিং নিতে পারেন তাহলে এটা তাদের সিভিতে কিছুটা ভিন্নমাত্রা তৈরী করবে। যাকে আমরা তথাকথিত ভাষায় সিভি ভারী করা বলে থাকি। বিডিজবস সহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই ধরনের ট্রেনিং এর আয়োজন করে থাকে।
এরপর আসি সিভি রাইটিং প্রসঙে। সিভি রাইটিং নিয়ে আমাদের কম বেশি দুঃচিন্তা আছে। ভালো সিভি কিভাবে বানানো যায় এটা নিয়ে অনেকে প্রচন্ড টেনশনে ভোগেন। মনে রাখবেন, ভালো বা আদর্শ সিভির কোন একটা উদহারন নেই। আপনার অবস্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আপনার সিভি লিখতে হবে। তাই আপনি আপনার সিভি নিজেই লিখুন। খুব বেশি অন্যের সিভি দেখার দরকার নেই। একজন ফ্রেস গ্রাজুয়েট হিসেবে আপনার সিভি কোন ভাবেই এক পৃষ্ঠার বেশি কাম্য নয়। অনেক ফ্রেস গ্রাজুয়েটকে দেখি ৩/৪ পৃষ্টার সিভি বানাতে। আমি দুঃখের সাথে বলছি এটা একজন চাকরীদাতাকে যথেষ্ট বিরক্ত করে।
এরপর আবার দেখা যায় অনেকে, চার পাঁচ লাইন ধরে তার অবজেক্টিভ বা ভিশন নিয়ে লিখেন। এটা অনেক ক্ষেত্রেই বিরক্তির উদ্রেক করে। একজন চাকুরীদাতা প্রথমেরই একজন চাকরীপ্রার্থীর অবজেক্টিভ বা ভিশন নিয়ে মাথা ঘামান না। তারা দেখতে চান, আপনার মূল যোগ্যতার ভিত্তি। এই ক্ষেত্রে আপনি অবজেক্টিভ বা ভিশন নিয়ে বেশি বড় করে না লিখে অল্প কথায় গুছিয়ে লিখুন। এবং সেটা ২ লাইনের মধ্যে হলেই ভালো। যদি কোন অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে সেটাই আগে লিখুন। জব রেস্পন্সিবিলিটস গুলো সর্ম্পকে লিখুন। তারপর লিখুন আপনার এরিয়া অব এক্সপার্টিজ নিয়ে। ধরুন, আপনি মানুষজনকে ভালোভাবে সামলাতে পারেন, কিংবা আপনি অনেক পরিশ্রম করতে পারেন, প্রেসার নিতে পারেন ইত্যাদি। এই গুলো হচ্ছে আপনার এরিয়া অব এক্সপার্টিজ, যা সর্ম্পকে পয়েন্ট আকারে লিখতে পারেন। এতে প্রথমেই আপনার সর্ম্পকে একটা ধারনা হয়ে যাবে।
তারপর লিখবেন যদি আপনি কোন ট্রেনিং করে থাকেন, সে সর্ম্পকে। কয় দিনের ট্রেনিং, কোন প্রতিষ্ঠান থেকে করেছেন, কারা সার্টিফিকেট প্রভাইড করছে ইত্যাদি সর্ম্পকে ছক আকারে বিস্তারিত তথ্য।
তারপর লিখবেন আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা। সর্বশেষ যোগ্যতার কথা আগে লিখবেন। শিক্ষাজীবনে প্রাপ্ত বিভিন্ন ডিসটিংশন কিংবা স্কলারশীপ এর কথা এইখানে উল্লেখ্য করবেন।
তারপর লিখবেন যদি অন্যান কোন যোগ্যতা থাকে, সেই সর্ম্পকে। এখন হচ্ছে মাল্টি টাস্ক এর জয় জয়কার। আপনি যত বেশি মাল্টি টাস্ক অপশন দেখাতে পারবেন, আপনার জন্য তত বেশি ভালো। যেমন কেউ গ্রাফিক্স ডিজাইন পারেন, কিংবা ভালো ছবি তুলতে পারেন, কিংবা লিখতে পারেন ইত্যাদি এইসবই আপনার এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটি। ফ্রেসারদের জন্য
এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটি অনেক সময় গুরুত্বপূর্ন হয়ে দাঁড়ায়।
আর যদি কাজের অভিজ্ঞতা না থাকে এবং যদি আপনার রেজাল্ট ভালো থাকে তাহলে রেজাল্ট অংশটাই প্রথমে লিখুন। কিছু কিছু ব্যাপার সবার মধ্যেই থাকে, যেমন পরিশ্রম করার মন মানসিকতা, নিয়মানুবর্তীতা ইত্যাদি উল্লেখ্য করে দিবেন। যদি তেমন কিছুই বলার না থাকে তাহলে অপ্রয়োজনীয় তথ্য না দেয়াই ভালো।
সবশেষে দুইটা রেফারেন্স দিবেন। তবে অনেকে রেফারেন্স পরেও দেয়ার কথা বলে। যদি আপনি আগে দিতে পারেন তাহলে দিয়ে দিবেন। ফ্রেস গ্রাজুয়েটদের জন্য শিক্ষকরাই ভালো রেফারেন্স হতে পারেন।
চাকুরীপ্রার্থীদের জন্য আরো একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে কাভার লেটার। অনেক ভালো ছাত্রছাত্রীই কাভার লেটার লিখতে জানেন না। মনে রাখবেন কাভার লেটার চাকুরীর ধরন বা পোষ্ট এবং কোম্পানীর উপর নির্ভর করে চেঞ্জ হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ন। কারন কাভার লেটারের মাধ্যমেই মূলত একজন চাকরীদাতা আপনার সর্ম্পকে জানতে পারেন। কাভার লেটার লিখার সময় চেষ্টা করবেন এইচআর ম্যানেজার বা যিনি নিয়োগ সংক্রান্ত কাজ করেন তার নাম লিখতে। এতে একটা পারসোর্নাল সর্ম্পক এর ইমেজ তৈরী হয়। তবে কাভার লেটারে পারসোর্নাল সর্ম্পক বলতে আবার আপনি কাউকে ভাই বা বোন বলে সম্বোধন করবেন না । তাহলে হিতে বিপরীত হবে। এটা গুরুত্বপূর্ন কারন, অপরিচিত মানুষ আমাদের নাম জানেন না। যখন একজন চাকুরীদাতা দেখবেন যে আপনি তার নাম জেনেছেন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই অন্য কাভার লেটারের চাইতে আপনারটাই কিছুটা মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। এটা একটি মনস্থাত্বিক পদ্ধতি।
কাভার লেটারে আপনার সর্ম্পকে তথ্য দিন, কোথা থেকে পাস করেছেন, কোথায় কাজ করেছেন, কেন ভাবছেন আপনি এই পোষ্টের জন্য উপযুক্ত অল্প কথায় তা গুছিয়ে লিখুন। গ্রামার এবং বানান সর্ম্পকে সচেতন থাকুন। শেষে লিখে দিন আপনি কাভার লেটারের সাথে কি কি সংযুক্ত করেছেন, যেমন, সিভি, ছবি ইত্যাদি। এভাবে বানানো একটি কাভার লেটার নিঃসন্দেহে চাকুরীদাতার দৃষ্টি আকর্ষন করে।
জব ইন্টারভিউতে চেষ্টা করবেন নিজেকে সুন্দর এবং গোছানো ভাবে উপস্থাপন করতে। যে প্রতিষ্টানে যাচ্ছেন আগে থেকে তাদের সর্ম্পকে কিছুটা ধারনা নিয়ে যান। ফ্রেস গ্রাজুয়েটদের মাঝে মাঝে তাদের পড়াশুনার সাবজেক্ট থেকে প্রশ্ন করা হয়। তাই কিছু বেসিক বিষয়ে ধারনা নিয়ে যান। যদি কিছু না পারেন তাহলে সরাসরি বলে দিন, আপনার এই মুর্হুতে মনে পড়ছে না। ভনিতা করার দরকার নেই। চেষ্টা করুন সঠিক এবং আঞ্চলিকতার প্রভাবমুক্ত শব্দ চয়নের। কনফিডেন্ট রাখুন। আপনি পারবেন।
এই প্রসঙ গুলো নিয়ে পরে আরো বিস্তারিত পোষ্ট দিব ইনশাল্লাহ।
আরো একটা বিষয় না বললেই নয়, অনেকে চাকরী পাবার জন্য লিংককে খুবই গুরুত্বপূর্ন মনে করে থাকেন। এটা সব সময় যেমন বাধ্যতামূলক নয় তেমনি লিংক তৈরী করতে না পারার ব্যর্থতা কিছুটা তাদের উপরই বর্তায়। আমি ব্যাক্তি গত ভাবে লিংক তৈরী করাটাকে খারাপ ভাবে দেখি না এবং আবার অতিআবশ্যকও মনে করিনা। নিজের সর্ম্পকে আত্মবিশ্বাসী থাকতে হবে এটাই হচ্ছে মূল কথা। আমি কাজ জানলে আজ না হোক কাল আমি জব পাবোই, এই ধরনের একটি মনোভাব থাকা বাঞ্ছনীয়।
অনেকে প্রথম থেকেই ভালো বেতনের চাকরী খুঁজেন। ঠিক আছে এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু এই লক্ষ্যে পৌছতে গিয়ে অনেকে দীর্ঘদিন বেকার থাকেন। নানা রকম হতাশা কাজ করে তাদের মাঝে। আমি বলি কি, শুরতে আপনি যাই পান না কেন, জয়েন করে ফেলবেন। কম বেতনের চাকুরীতে মূল বেতন হচ্ছে অভিজ্ঞতা। মোটামুটি যাওয়া আসার ভাড়া হলেই কাজ শুরু করে দেয়া উচিত। ভার্সিটি পাশ করে ঘরে বসে থাকার চাইতে কোন একটা কাজের মধ্যে থেকে নতুন কাজ খোঁজা বেশি যুক্তিযুক্ত।
যাই হোক পরিশেষে, সবার জন্য অনেক শুভ কামনা রইল। আরো অনেক তথ্য দেয়ার ছিল, কিন্তু তা করতে হলে এই পোষ্টের আকার আরো বড় হয়ে যাবে। যদি কোন প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে এই খানে আপনারা করতে পারেন। সামুতে অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন, আমি দিতে না পারলেও তারা হয়ত আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন।
আর এই পোষ্টটি যারা চাকুরী খুঁজছেন তাদের সবার জন্য উৎসর্গ করলাম।