বিয়ের পাত্র পাত্রী নির্বাচন নিঃসন্দেহে কঠিন থেকে কঠিনতম একটি কাজ। সারা জীবনের সাথে যাকে জড়ানো হবে তাকে নির্বাচন করাটা আর যাই হোক না কেন, সহজ ব্যাপার নয়। এই সর্ম্পকে কিছু লেখাও একটি দুঃসাহসের ব্যাপার। তবে মাঝে মাঝে কোন কারন ছাড়াই সাহসী হয়ে উঠতে ইচ্ছা করে। তাই তো বিয়ের পাত্র পাত্রী নির্বাচনের মত একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে আমি কিছু প্রচলিত ধারার কিছু মতবাদ, তার পাশাপাশি আমার কিছু পর্যবেক্ষনও তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
আমাদের দেশে যখন ছেলে মেয়েরা বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়, তখন থেকেই ভালো ছেলে বা মেয়ের জন্য তারা উন্মুখ হয়ে থাকেন। অনেক পরিবারে মেয়েদের জন্য ভালো পাত্রের সন্ধান অনেক আগে থেকেই শুরু হয়। প্রত্যেক পরিবারে কিছু চরিত্র থাকেন যাদের কাছে অনেক 'সোনার টুকরা' ছেলে থাকেন। অতি অল্প সময়ে এবং তাড়াহুড়ার সাথে যদি বিয়ে না দেয়া হয় তাহলে সেই সোনার টুকরা ছেলে কর্পূরের মত বাতাসে মিলিয়ে যাবে এমন একটি ধারনা তারা মেয়ের বাবার কানে ঢেলে দেন। কন্যাদায়গ্রস্ত একজন পিতার এই ধরনের দুঃসংবাদ সহ্য করার ক্ষমতা তেমন থাকে না। ফলে পড়াশুনার মাঝখানে একটা মেয়ের বিয়ে দেয়া হয়। এই ধরনের বিয়ে যারা করেছেন তারা সুখী কি অসুখী সেটা মুখ্য বিষয় নয়। মূল ব্যাপার হচ্ছে, পাত্র নির্বাচনে এই ধরনের তাড়াহুড়া অনেক সময় চির কান্নার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। একই কথা ছেলেদের ক্ষেত্রেও জন্যও প্রযোজ্য। তাই এই ধরনের তাড়াহুড়ার বিয়ে না করাই ভালো।
এখন আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করেন ভালো পাত্র বা পাত্রীর সংজ্ঞা কি? আমি এক কথায় বলব, জানি না। জানি না কারন, ভালো পাত্র বা পাত্রীর কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। ভালোর সংজ্ঞা চিরকালই আপেক্ষিক। এক একজনের মন মানষিকতার উপর ভিত্তি করে এই ভালোমন্দের বিষয়টি নির্ধারিত হয়। আপনি যদি পুঁথিগত সংজ্ঞার উপর ভিত্তি করে ভালো পাত্র বা পাত্রী খুঁজতে যান তাহলে আপনাকে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখকদের সাহায্য নিতে পারেন। যেমন হুমায়ুন আহমেদের তাঁর বইতে যে সব সুপাত্র এবং সুপাত্রীর বর্ননা দিয়েছেন তা অনেকটা এই রকম যে, ছেলে বা মেয়ে হবে কোন বনেদী পরিবারের সদস্য। ছেলে বা মেয়ে হিসাবে অবশ্যই তারা অতি রুপবান বা রুপবতী। শহরে নিজেদের বাড়ি, গ্রামে হলে বিশাল সম্পত্তির মালিক, উচ্চ শিক্ষিত ইত্যাদি। যদি এমন কাউকে খুঁজে পান তাহলে দেরি না করে শুভকাজ সেরে ফেলুন।
আপনি যদি প্রেমের মাধ্যমে আপনার সঙ্গী নির্বাচন করে থাকেন, তাহলে মনে রাখবেন, বিয়ে হচ্ছে ভালোবাসার একটি সুন্দর পরিনতি। কিন্তু শুধুমাত্র ভালোবাসার সর্ম্পকের কারনেই বিয়ে করা ঠিক নয়। বাস্তবতা বুঝে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটা ঘটনা বলি, আমার এক ক্লাসমেট ছিল, যে আমার এলাকার একটি ছেলের সাথে প্রেম করত। তাদের প্রেমের বয়স প্রায় ৫/৬ বছর। এলাকায় ছেলের রেপিউটেশন খুব একটা ভালো না। নেশা করে। ব্যাপারটা যখন জানা জানি হলো তখন আমার সেই ক্লাসমেটকে বললাম ব্যাপারটা। প্রথম প্রথম মন খারাপ করলেও পরে বলল, সে আত্মবিশ্বাসী যে ছেলেটাকে সে তার ভালোবাসা দিয়ে এই খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে আনবে। সব শুনে আমার কিছুটা মেজাজ খারাপ হলেও ভালোবাসার উপর এই তীব্র বিশ্বাস দেখে কিছুটা খুশিও হয়েছিলাম। যাই হোক, তারপর কোন এক শুভ দিনে ধুমধামের সাথে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। আমরা সবাই খুশি। কিন্তু আমাদের এই খুশি বেশি দিন ছিল না। প্রচন্ড ভালোবাসাও ছেলেটিকে সেই মরন নেশার হাত থেকে বের করে আনতে পারে নি। দিন দিন বেড়েছে যন্ত্রনা, অত্যাচার। ফলে বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় আমার সেই ক্লাসমেটকে তার বাবা বাড়ি চলে আসতে হয়েছিল। তার ফিরে আসাটা ছিল অনেক কষ্টের। সাথে ছিল তার ৬ মাসের ছোট শিশুকন্যা।
এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ভালোবাসা নিয়ে অনেক অহংকার, অনেক বিশ্বাস আমাদের থাকে। ভালোবাসায় বিশ্বাস আমাদের থাকতেই হবে। কারন বিশ্বাসই ভালোবাসার মূলমন্ত্র। কিন্তু যখন এই মুলমন্ত্রটি নষ্ট হয়ে যায়, তার কষ্ট সহ্য করা একটা সাধারন মানুষের জন্য অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই কারো সাথে ভালোবাসার সর্ম্পক থাকলে তাকে আগে যাচাই করে নিন। তার খারাপ দিক গুলো যথা সম্ভব খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন সবারই ভালো মন্দ দিক থাকে। শুধু মাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে যদি কিছু করেন এবং তার ফলাফল যদি ভালো না হয় তাহলে তার দায়ভার শুধু মাত্রই আপনার।
প্রেমের বিয়ের ক্ষেত্রে আপনি যদি সিরিয়াস থাকেন, তাহলে অবশ্যই আপনাকে আপনাদের স্বীয় স্বীয় প্রেমিক বা প্রেমিকার পরিবার পরিজন, তাদের পারিবারিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থা, ইত্যাদি অবশ্যই জেনে নিবেন। এই তথ্য গুলো সর্ম্পকের শুরুতেই জেনে নিতে হবে। মনে রাখবেন, ভালোবাসার মানুষের সাথে কয়েক ঘন্টা কাটানো আর এক ছাদের নিচে সবসময় কাটানো এক বিষয় নয়। তাই একটু কষ্ট করে হলেও আপনি এই তথ্য গুলো জেনে নেয়ার চেষ্টা করবেন। আপনার সর্ম্পকেও জানাবেন।
যারা পারিবারিক ভাবে পাত্রপাত্রী নির্বাচন করতে যাচ্ছেন, তাদের জন্য ব্যাপারটা সত্যিকার অর্থে কিছুটা কঠিন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আপনাকে জীবনের অন্যতম কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে হবে এবং সেখানে কোন ভূল হোক এটা কোন ভাবেই কাম্য নয়।
একটা সময় ছিল যখন দল বেঁধে মেয়ে দেখতে যাওয়া হত। এটা এখনও হয়। বিয়ের জন্য ডজন ডজন মেয়ে দেখা হয়। এটা খুবই নিম্ন মানের একটি প্রক্রিয়া। যারা এমনটা করেন তারা নিজেকে তো অসম্মান করেনই সাথে সাথে যে মেয়েটিকে দেখতে যাচ্ছেন তার প্রতিও চরম অসম্মান করেন। বিয়ে যদি আপনি করে থাকেন তাহলে মেয়ে দেখার পূর্বে তার জীবন বৃত্তান্ত আগে দেখুন। আপনার সামাজিক, পারিবারিক ইত্যাদি প্রেক্ষাপটের সাথে যদি মিলে তাহলেই আপনি মেয়ে দেখতে যাবেন। অন্যথায় নয়। একজন ছেলে হিসেবে আপনার প্রধান লক্ষ্য থাকবে মেয়েটিকে পরিস্থিতির সাথে সহজ করে ফেলা। একজন মানুষকে সবাই পর্যবেক্ষন করবে, এটা আর যাই হোক কোন সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করে না। মুরুব্বি লেভেলে জানিয়ে রাখুন কেউ যেন অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন না করে। যেমন, মেয়ে রান্না করতে পারে কিনা, গান গাইতে পারে কিনা ইত্যাদি।
আপনি চেষ্টা করবেন জেনে নিতে আপনারা দুইজনের জীবন দর্শন কি একই কিনা। পছন্দ/অপছন্দের অমিল থাকতেই পারে। থাকাটাই ভালো। কিন্তু জীবন দর্শন একই হলে ভালো। যদি জীবন দর্শন একই না হয় তাহলে আপনারা একসাথে থাকবেন ঠিকই কিন্তু জীবন চলবে আলাদা আলাদা।
আপনারা যখন একে অপকে জানার জন্য কথা বলবেন, তখন মূল বিষয় হবে, নিজেদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা গুলো একে অপকে জানানো। আপনার ভবিষ্যত জীবন সংঙ্গীর মানবিক অনুভূতি গূলো কেমন সেটাও যাচাই করে নিতে হবে। সবার সাথে কিন্তু সব কথা শেয়ার করা যায় না। কিংবা ইচ্ছে থাকলেও হয়ত কমর্ফোট ফীল হয় না। আপনার কাজ হবে, আপনার ভবিষ্যত জীবনসংঙ্গী যেন তার সকল কথা আপনাকে বলতে কমর্ফোট ফীল করে।
এরপর যেটা দেখা উচিত অন্য মানুষের সাথে তার আচরন কেমন, বিশেষ করে ভাইবোন, বাবা মা, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রিকশা চালক, হোটেলের ওয়েটার বা গাড়ির ড্রাইভার কিংবা একেবারে অপরিচিত মানুষের সাথে। কারন পাবলিক কমিউনিকেশন একটি গুরুত্বর্পূন ব্যাপার। এর সাথে পারিবারিক, সামাজিক এবং শিক্ষার ব্যাপারটি জড়িত।
অনেক সময় আমরা শুনি, আমাদের বন্ধু বান্ধবীরা বলেন আমি আমার স্বামী বা স্ত্রীর , বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডের কারনে নিজেকে অনেক চেঞ্জ করেছি। অনেকে এই কথা বলে খুব খুশী হন, আবার অনেকে এই কথা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে রাখবেন, যে কোন ভালো পরিবর্তন, যা আপনাকে আরো ব্যক্তিত্ববান করে তুলবে সেটা করতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু কেউ যদি আপনাকে এমন কিছু পরিবর্তন করতে বলে যা আপনার ব্যক্তিসত্তার সাথে জড়িত, তাহলে সেটা না করাই বাঞ্ছনীয়। এই ক্ষেত্রে আপনার মনোভাব শুরুতেই গুছিয়ে বলে দেয়া ভালো। তবে এমন ভাবে বলবেন তা যেন অহংকারের মত না শুনায়। অহংকারী মানুষকে কেউ পছন্দ করেন না।
এরপর আসা যাক, চেহারা বা সৌন্দর্যের ব্যাপারে। আমরা যত যাই বলি না কেন, সৌন্দর্যের জয় জয়কার সেই অনেক আগে থেকেই। তবে মনে রাখবেন, একজন মানুষকে যদি শুধু মাত্র তার সৌন্দর্য দিয়ে বিবেচনা করেন তাহলে আপনি মানুষ হিসেবে নিজেকে এবং সেই মানুষটিকে অসম্মান করছেন। আধুনিক সমাজে সুন্দর বলতে শিক্ষা, স্মর্টনেস, বাচনভঙ্গী, মন মানসিকতা ইত্যাদির সম্মিলিত প্যাকেজকেই বুঝায়। তাই জীবনসংঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাহ্যিক সৌন্দর্যের বিষয়টা যত পরে আসবে ততই ভালো।
এখন একটু ছেলেদের সর্ম্পকে বলি। অনেক পরিবারে ছেলের সর্ম্পকে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে দেখে, ছেলের ব্যাংক ব্যালেন্স কেমন, ঢাকায় বাড়ি গাড়ি আছে কিনা। অনেক সময় এত কিছুর চাপে শিক্ষা বা পারিবারিক মূল্যবোধ চাপা পড়ে যায়। যে পরিবারে আপনার যোগ্যতার চাইতে আপনার বাড়ি গাড়ি কিংবা অর্থ সম্পদের খোঁজ নেয়া হয় সেই পরিবারে বিয়ে না করাই ভালো। এটা অনস্বীকার্য সামাজিক বা আর্থিক নিরাপত্তার একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু বাবা বা পারিবারিক সম্পদ কখনই একটা ছেলের যোগ্যতার মূল মাপকাঠি হতে পারে না। এখনকার ছেলেরা সাধারনত, ২৭ বছরে বিয়ে করা শুরু করে। ২৭-৩১ হচ্ছে ছেলেদের বিয়ের পিকটাইম। এখন কেউ যদি ২৭-৩১ বছরের একটা ছেলের কাছে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট বাড়ি, একটা গাড়ি এবং অন্যান্য আরো অনেক স্বচ্ছলতা আশা করেন তাহলে সেটা তাদের ভূল। নিজের যোগ্যতায় এত অল্প সময়ে এত কিছু বৈষয়িক সম্পত্তি অর্জন করা খুবই কঠিন কাজ। যারা পেরেছেন, তারা নিঃসন্দেহে অতি যোগ্য পাত্র। কিন্তু যারা পারেন নি, তারা যে যোগ্য না এটা ভাবাটা মূর্খতা।
যাই হোক বিয়ে মানুষের জীবনের অন্যতম প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ন একটি কাজ। বিয়ের পাত্রপাত্রি নির্বাচন করা আরো কঠিন একটি কাজ। আমি এই ব্যাপারে শুধু মাত্র আমার নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষন তুলে ধরেছি। অনেকে হয়ত এর চেয়ে আরো ভালো জানেন। তারা এই পোষ্ট কমেন্ট আকারে তা শেয়ার করবেন। আমরা সবাই জানতে পারব। যারা বিয়ে করতে যাচ্ছেন, আশা করি তাদের এই তথ্য গুলো কাজে লাগবে।
_______________________________________________
আগের কিছু লেখাঃ
যারা বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তাদের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় টিপস
'ওয়েডিং ফটোগ্রাফার'-- শিল্পীর ছদ্মবেশে ব্যবসায়ী
মধ্যবিত্তের ঈদ বাজার।
দেশপ্রেমিক জনতার ভীড়ে ফাসি চাই আমার।